শনিবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


সব্যসাচী দাস

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১৯, ২০২৫, ১১:১৭ পিএম

বড় সংকটে পড়িয়া...

সব্যসাচী দাস

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১৯, ২০২৫, ১১:১৭ পিএম

বড় সংকটে পড়িয়া...

লালন সাঁইয়ের সৃষ্ট ‘বড় সংকটে পড়িয়া..’ গানের মর্মার্থ ভিন্ন হলেও ফরিদা পারভীনের অনুপস্থিতি আমাদের কাছে এক গভীর সংকটের সৃষ্টি করেছে। এই সংকট সীমাহীন অন্তরীক্ষের মতো। জীবিত ফরিদা পারভীন আর গান গেয়ে শোনাবেন না। কিন্তু আমরা তাকে খুঁজব, আরও বেশি করে খুঁজব- তার সৃষ্ট অমৃত ধারায়..।

এই যেমন, বিগত সময়ে যারা লালন সংগীত শুনতেন বিশেষ করে ফরিদা পারভীনের গলায় তারা তার মৃত্যুর পর তাকে নতুন করে খুঁজবেন এবং এই খোঁজ চলবে নিরন্তর। অনেকটা রবীন্দ্রনাথের কবিতার লাইনের মতো, আজি হতে শতবর্ষ পরে কে তুমি পড়িছ বসি আমার কবিতাখানি কৌতূহলভরে..শরীরে না থাকলেও যে সুরের ধারা তিনি অসংখ্য শ্রোতার কর্ণকুহরে দিয়ে গেছেন তা ভোলা সম্ভব নয়! নিজে তো ভাব জগতের শিরোমণি লালন সাঁইয়ে মজেছিলেনই সঙ্গে অসংখ্য ভক্তদেরও এই দরিয়ায় ডুবিয়েছেন। 

জীবদ্দশায় ফরিদা পারভীনের পয়ষট্টিতম জন্মদিন এবং সংগীতের পঞ্চাশ বছর উপলক্ষে এক সাক্ষাৎকারে জানতে চেয়েছিলাম- সাঁইজির ‘ভাব’ বা ‘গানে’ না মজলে তার সাধন-ভজন হয় না, আপনি আসলে কোন বয়সে এই সাধন-ভজনে আত্মনিবেশ করেছিলেন? উত্তরে তিনি বলেছিলেন- দেখেন, ‘একটা গানের সঙ্গে প্রথমে ভালোবাসা হয় না বা প্রেমও হয় না। গাইতে গাইতে তার ভাবার্থ বা অন্তর্নিহিত মর্মার্থ যখন একজন শিল্পী অনুধাবন করেন, তখন সেটি তার প্রাণের মধ্যে আন্দোলিত হয়। আর হৃদয় আন্দোলিত না হলে নিজেকে সায় দেওয়া যায় না। আমি যখন আমার গুরুর কাছে শিখেছি তখন গানের সংখ্যা বাড়ানোর দিকে বেশি মনোযোগী ছিলাম। কিন্তু যখন, পরবর্তীতে আস্তে আস্তে বুঝতে শিখলাম, বাংলা সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করতে শুরু করলাম এরপর গুরুর কাছ থেকে গানের মর্মার্থ বা আবিধানিক মরমীবাদ একটু একটু করে নেয়ার চেষ্টা করেছি, বোঝার পর আবেগাপ্লুত হওয়ার যে প্রক্রিয়া সেটা কিন্তু ওই বোঝার সময় থেকেই হয়েছে। আগেই তো হয়নি আস্তে আস্তে হয়েছে। আর পরিপক্বতা একদিনে আসে না। চেষ্টা করতে করতে যখন ওইটার সঙ্গে ভাবে ভাব মিলে যায় তখনি সেটা মহিমান্বিত হয়।’

কোনো ভণিতা ছাড়াই এমন সরল উত্তরে মুগ্ধ হয়েছিলাম। আসলে সত্যান্বেষিরা ভণিতা বোঝেন না। অভিব্যক্তি শুনলে বোঝা যায় ফরিদা পারভীন গুরুদিক্ষায় ছিলেন জলের মতো সহজ। যে কারণে, গুরুর শেখানো গান নিজের প্রেমে মন্থন করে গেয়ে শোনাতেন। একটা স্মৃতি কথা মনে পড়ে গেল। একবার ফরিদা পারভীন গান গাইতে গেলেন স্পেনে।

সংগীতানুষ্ঠানের প্রধান অতিথি স্পেনের রানী সয়ং। তিনি সাঁইজির গান গাইছেন, বাংলার তেরস নদীর সব জল এককরে ¯শ্রোতে ভাসিয়ে.. লালন কন্যার হৃদয়গ্রাসী সুর শুনে মহারানীর চোখ জলে ভোরে ওঠে।

অনুষ্ঠান শেষে অনুভূতি ব্যক্ত করে বলেছিলেন, গানের কথাগুলো আমি বুঝিনি কিন্তু, তার সুরের ভেতর একটা অসীম শূন্যতা অনুভব করেছি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন সংগীত রচনার জন্য পশ্চিমা দেশ চষে সুরের অনুরণন খুঁজতেন তখন শিলাইদহে গগন হরকরা মাধ্যমে বাউল গান এবং লালন সাঁইয়ের রচিত গানের সন্ধান পান। আধ্যাত্মবাদে দুজনের দর্শন খুব কাছাকাছি অবস্থানে। রবীন্দ্রসংগীতের একটা বড় অংশ লালনগীতি দ্বারা অনুপ্রাণীত। জীবদ্দশায় ফরিদা পারভীন অনুভব করে গেছেন, বারংবার বলে গেছেন। যদিও এই মহীরুহের সংগীত জীবন লালনগীতি দিয়ে অভিষেক হয়নি। গানের প্রতি অগাধ ভালোবাসা যা কিনা তিনি তার বাবা-মার কাছ থেকে পেয়েছেন।

তার কথায়- বাবা খুব ভালো গান করতেন। মা ছিলেন সুচিত্রা সেনের ভীষণ ভক্ত। তার অভিনীত সিনেমার অনেক গান তিনি প্রায়শই গাইতেন। আমার মনে আছে মায়ের কোলে দুধ খেতে খেতে গান শুনতাম। এভাবেই মস্তিষ্কের ভেতর, রক্তের অণুপরমাণুর ভেতর সংগীত ঢুকে যায়। 

নজরুলসংগীত গাইতেন জীবনের প্রথম ভাগে। কিন্তু পারিবারিক এক শুভাকাক্সক্ষী তাকে প্রায়ই অনুরোধ করতেন লালনের গান গাইতে। প্রথম দিকে তিনি ও সব ফকিরের গান বলে অবজ্ঞা করতেন, এ কথা নিজে বলেছেন এবং ক্ষমাও চেয়েছেন। একবার এক ঘটনাচক্রে তিনি এক অনুষ্ঠানে লালন সাঁইয়ের সত্য বল সুপথে চল.. গুরুর কাছে শিখে ভরা মিলনাতায়নে গাইলেন, দর্শক মুগ্ধ হলো ভীষণভাবে। অবার অনুরোধ করলে তিনি বলেন, আমি এই একটি গানই শিখেছি! আর এই একটি গানের মধ্য দিয়ে তিনি নিজের ভেতর এক ঐশ^রিক পরিবর্তন লক্ষ্য করেন। এরপর ধিরে ধিরে নিমজ্জিত হন ভাব সাগরের অতলে।  

৭১ বছর বয়সে ফরিদা পারভীন গত হয়েছেন। শিল্পী জীবনে তার কোনো অপ্রাপ্তি ছিল না। এই গানপাগল দেশের মানুষ তাকে ভালো বেসেছে, ভীষণভাবে। এতেই তিনি তৃপ্ত ছিলেন। সুযোগ পেলে দর্শকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতেন বিনয়ের সঙ্গে। দেশে-বিদেশে বহুখ্যাতি তিনি অর্জন করেছেন।

‘ফরিদা পারভীন ফাউন্ডেশন’ নামে তার গড়া একটা একাডেমি আছে, এর তত্ত্বাবধানে ‘অচিন পাখি’ নামে সংগীতের একটা বিদ্যাপীঠ আছে। এখানে গানের যে আবিধানিক প্রক্রিয়াকরণ সেগুলো শেখানো হয়। পাশাপাশি একোয়েস্টিক যন্ত্র যেমন, গিটার, বাঁশি, তবলা, সেতার এই বিষয়গুলোর সঙ্গে পরিচয় করানো হয়। এখানে নজরুল, রবীন্দ্র, ক্ল্যাসিকাল, লোকজ এবং অবশ্যই লালন সাঁইয়ের গান এই ফাউন্ডেশনের আওতায় চর্চা করা হয়। এসব তথ্য তিনি জানিয়েছিলেন। তবে, এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য রাষ্ট্রীয় কোনো পৃষ্ঠপোষকতা তিনি বা তার প্রতিষ্ঠান পাননি বলেও জানিয়েছিলেন। এ নিয়ে অবশ্য তার কোনো আফসোসও ছিল না। তিনি ছিলেন আশাবাদী এবং সব বিষয়ে আত্মপ্রত্যয়ী একজন মানুষ। 

আজ এক সপ্তাহ গত হতে চলল, ফরিদা পারভীন অনন্তলোকে তার মনের মানুষের আশ্রয়ে চলে গেছেন। মেঘ শূন্য অসীম আকাশে রোজ জ¦লে ওঠা নক্ষত্র তার কথা আমাদের মনে করিয়ে দেবে আর সাঁঝবাতি জ¦ালিয়ে  আমরা গাইতে থাকব ধন্য ধন্য বলি তারে..।

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!