প্রধান উপদেষ্টার সফরসঙ্গী হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়া বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, এনসিপি সদস্য সচিব আখতার হোসেন ও যুগ্ম-সদস্য সচিব তাসনিম জারাকে লাঞ্ছিত ও কটূক্তি করেছে আওয়ামী লীগের প্রবাসী নেতাকর্মীরা। নিউইয়র্কে জনএফ কেনেডি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে বের হওয়ার সময় এই মব সৃষ্টি করা হয়। এ সময় আখতারকে লক্ষ্য করে ডিম ছুড়ে মারে বাংলাদেশে রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের নেতারা।
এ নিয়ে বাংলাদেশ ও নিউইয়র্কে চলছে তোড়পাড়। এসব নেতাকে নিরাপত্তা দিতে না পারার জন্য বাংলাদেশ সরকার ও নিউইয়র্কের বাংলাদেশের কনস্যুলেট অফিসকে দায়ি করছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে এই ঘটনাই প্রথম নয়, স¤প্রতি সুইজারল্যান্ডের জেনেভা বিমানবন্দরে আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুলকে একদল আওয়ামী লীগ সমর্থক হেনস্তা করে।
সম্প্রতি লন্ডনে তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের ওপর হামলার চেষ্টা করেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। ওই সময় হাইকমিশনের গাড়িতে মাহফুজ আছেন, এই সন্দেহে গাড়ির ওপর ডিম নিক্ষেপ করা হয়। তারও আগে গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য কিংবা ইউরোপে গেলে তাকে ঘিরেও বিক্ষোভ করতেন বিএনপির নেতাকর্মীরা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এসব ঘটনা নতুন নয়, বিশেষ করে ইউরোপ-আমেরিকায় এই কালচার দীর্ঘদিন থেকে চলে আসছে। তবে আগে শুধু বিক্ষোভ কিংবা কালো পতাকা প্রদর্শন করা হতো। এখন সহিংস আচরণ করা হচ্ছে। প্রবাসে এসব রাজনৈতিক সহিংসতা শুধু রাজনীতিকে অস্থিতিশীল করছে না বরং দেশের ভাবমূর্তিকেও বিদেশের মাটিতে নষ্ট করছে। রাজনীতিবিদদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে দূতাবাসগুলোকে আরও সক্রিয় হওয়ার পরামর্শ তাদের।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. স. ম. আলী রেজা রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, এমন ঘটনায় দারুণভাবে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। যারা এ ধরনের কাজগুলো করেছে, এটা তাদের রুচি, রাজনৈতিক শিক্ষণের বহিঃপ্রকাশও বটে। তিনি বলেন, যেহেতু আমরা একটি সংকীর্ণ রাজনৈতিক সংস্কৃতির আবহে বেড়ে উঠি; ফলে সহনশীলতা এবং অন্যের প্রতি শ্রদ্ধা দেখানোর বিষয়টি খুবই কম থাকে। আমরা যারা বিদেশে থাকি তারা দেশকে উপস্থাপন করি। ফলে আমাদের ব্যবহারের ওপর দেশের ভাবমূর্তি, রাজনৈতিক চিত্র ফুটে ওঠে। ফলে এমন ঘটনা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
যদিও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায় এ ধরনের কর্মকাণ্ড এক ধরনের প্রতিবাদের ভাষা। তবে তা এমন ঘটনাকে জায়েজ করারও কোনো সুযোগ নেই। কারণ যখন বিদেশের মাটিতে এমন ঘটনা ঘটে তখন দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করে।
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৮০তম অধিবেশনে যোগ দিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সফরসঙ্গী হিসেবে গত সোমবার যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছান বিএনপি-জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপির দুজন করে প্রতিনিধি। প্রধান উপদেষ্টার যুক্তরাষ্ট্র আগমনের প্রতিবাদে যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগ আগেই ‘যেখানে ইউনূস-সেখানেই প্রতিরোধ’ কর্মসূচি ঘোষণা করেছিল। সে অনুযায়ী এয়ারপোর্ট পুলিশের প্রহরায় দুপুর ১টা পর্যন্ত ৮ নম্বর টার্মিনালের কাছে একটি নির্দিষ্ট স্থানে তারা বিক্ষোভ-সমাবেশ করেন। এরপর তাদের সেখান থেকে সরিয়ে দিয়ে বিএনপির নেতাকর্মীদের সেখানে ‘স্বাগত সমাবেশ’ করার সুযোগ দেওয়া হয়।
প্রধান উপদেষ্টা সরকারপ্রধান হিসেবে বিশেষ নিরাপত্তায় অন্য একটি গেট দিয়ে বেরিয়ে গেলেও তার সফরসঙ্গী বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি নেতারা সাধারণ যাত্রীদের সঙ্গে বের হওয়ার সময় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বিক্ষোভের মধ্যে পড়েন।
স্থানীয় সময় বিকেল ৫টার দিকে বিমানবন্দরের ৪ নম্বর টার্মিনালে জড়ো হওয়া আওয়ামী লীগ কর্মীরা এ সময় ইউনূসকে ‘জামায়াত-শিবিরের নেতা’ আখ্যা দিয়ে নানা স্লোগান দিচ্ছিলেন। মির্জা ফখরুল ও হুমায়ূন কবির, আখতার হোসেন ও তাসনিম জারা পাশাপাশি হেঁটে পার্কিং স্পটের দিকে যাওয়ার সময় তাদের ‘বাংলাদেশের দুশমন’ আখ্যা দিয়ে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের ‘হত্যা’, বাড়ি-ঘরে অগ্নিসংযোগ এবং লুটতরাজের জন্য দায়ি করে স্লোগান দেওয়া হয়।
এ সময় তাদের কয়েক দফা থামিয়ে দেওয়া হয় এবং অকথ্য গালাগালের মধ্যে পরপর কয়েকটি ডিম ছুড়ে মারা হয়। সেসব ডিম আখতার হোসেনের পিঠে লেগে ফেটে যায়। বাংলাদেশে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা এ সময় তাদের ঘিরে ‘জঙ্গি, সন্ত্রাসী, একাত্তরের রাজাকারের পোষ্যপুত্র’ ইত্যাদি কট‚ক্তি করতে থাকেন। তাদের কয়েক ফুট পেছনে ছিলেন জামায়াত নেতা মুহাম্মদ তাহের। ৩০-৩৫ জন প্রবাসী জামায়াত কর্মী তাকে স্বাগত জানিয়ে উচ্চস্বরে স্লোগান দিয়ে গাড়ির দিকে যান।
এ ঘটনায় বাংলাদেশে বিএনপি, এনসিপি, জামায়াতসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা ক্ষোভ প্রকাশ করে বিক্ষোভ করেছেন। বিবৃতিও দিয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। সরকারের পক্ষ থেকেও এই ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করা হয়েছে। গত মঙ্গলবার প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইংয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়, এটি শেখ হাসিনার আমলে বিকশিত সহিংস রাজনৈতিক সংস্কৃতির এক বেদনাদায়ক স্মৃতি। এ সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে এসে শান্তিপূর্ণ, গণতান্ত্রিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশ গড়ে তোলাই অন্তর্বর্তী সরকারের লক্ষ্য। প্রধান উপদেষ্টা ও সফরসঙ্গী রাজনৈতিক নেতাদের নিরাপত্তাঝুঁকি মাথায় রেখে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিল। তবে শেষ মুহূর্তে ভিসাজনিত জটিলতার কারণে প্রতিনিধি দলকে বিকল্প পথে যেতে হয়।
এ সময় ভিভিআইপি প্রবেশাধিকার অব্যাহত রাখার অনুরোধ জানানো হলেও বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ তা নাকচ করে। ফলে নিরাপত্তায় ঘাটতি তৈরি হয়। ঘটনার পর নিউইয়র্ক পুলিশ বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ করে বাংলাদেশ মিশন। ইতিমধ্যে এ ঘটনায় মিজানুর রহমান নামে এক যুবলীগ কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।
রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশের সরকারপন্থি কারো বিরুদ্ধে বিদেশের মাঠিতে বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ সমাবেশ নতুন কিছু নয়। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে যখনই ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুক্তরাজ্যে রাষ্ট্রীয় বা ব্যক্তিগত সফর করেছেন, প্রতিবারই তার অবস্থানস্থল, এয়ারপোর্ট ও অনুষ্ঠানস্থলের সামনে বিভিন্ন ধরনের বিক্ষোভ ও প্রতিবাদী কর্মসূচি পালিত হয়েছে। যুক্তরাজ্যের বিএনপি মূলত এর আয়োজন করে।
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর বিভিন্ন দেশে শাখা রয়েছে। দেশে এসব দলের মধ্যে যে রাজনৈতিক প্রতিদ্বদ্ধিতা দেখা যায় তা প্রবাসী শাখাগুলোতেও একইভাবে প্রতিফলিত হয়ে থাকে। এসব কর্মকাণ্ড বিদেশে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করে।
তিনি বলেন, প্রবাসী বাংলাদেশিদের অবদানকে আরও কৌশলগতভাবে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশের জন্য একটি সুসংহত এবং ইতিবাচক ইমেজ তৈরিতে আমাদের মনোযোগ দিতে হবে। একজন ভারতীয় যখন অন্য কোনো দেশ সফর করেন তখন প্রবাসীরা তাদের নেতাদের লক্ষ্য করে প্রকাশ্যে কোনো বিক্ষোভ করেন না। আমাদের ক্ষেত্রে এটি বিপরীত এবং এটি অনেকদিন ধরেই চলে আসছে। বিশেষ করে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে দেশের যেকোনো রাজনৈতিক ইস্যুতে মিছিল, পাল্টা মিছিল, হুমকির ঘটনা নিয়মিত। এসব রাজনৈতিক সহিংসতা কেবল বিদেশের মাটিতে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করবে না, দেশেও উসকে দেবে আরও সহিংসতা।