শারদীয় দুর্গাপূজার মহানবমীতে ঢাকঢোলের বাদ্য, অঞ্জলিতে মুখর ছিল রাজধানীর পূজাম-পগুলো। নবমীতেই দেবী দুর্গা তীব্র লড়াইয়ের মাধ্যমে অসুর বিনাশ করেন। মহিষাসুর বধের এই বিজয় দিবসটি তাই দেবীভক্তদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দেবী এই দিনে ভক্তদের মনোবাসনা পূরণ করেন। সে কারণে এই দিনের প্রধান ধর্মীয় আচার হলো অসুরবিনাশী দেবীকে অঞ্জলি নিবেদন। ভক্তরা ফুল হাতে দেবীর পদে এই অঞ্জলি নিবেদন করেন। এদিকে মহানবমীতে এসে শুরু হয় দেবীর বিদায় ঘণ্টা। দশমীতে কৈলাশে (স্বামীর বাড়ি) ফিরে যাবেন দেবী দুর্গা। এদিন বিশেষ কোনো পর্ব না থাকলেও সকালে তর্পণে দুর্গার মহাস্নান হবে, ষোড়শ উপাচারে পূজা করা হবে। নবমীর সন্ধ্যায় দেবীদুর্গার ‘মহাআরতি’ করা হয়। মহানবমীতে বলিদান ও নবমী হোমের রীতি রয়েছে। এদিন ১০৮টি নীলপদ্মে পূজা হবে দেবীদুর্গার। পূজা শেষে যথারীতি থাকবে অঞ্জলি নিবেদন ও প্রসাদ বিতরণ।
গতকাল বুধবার নবমীর দিনে রাজধানীসহ সারা দেশের পূজাম-পগুলোতে ছিল ভক্তদের বিপুল সমাগম। বৃষ্টি উপেক্ষা করে সকাল থেকে নবমীর তিথিতে সন্ধিপূজায় ম-পে ম-পে দেবীর বন্দনা চলে ভক্তদের আরাধানায়। ঢাকের বাদ্য, উলুধ্বনি, শঙ্খনাদ আর কাঁসর ঘণ্টায় মুখরিত হয় প্রতিটি ম-প। নবমী তিথি শুরুই হয় সন্ধিপূজা দিয়ে। সন্ধিপূজা হয় অষ্টমী তিথির শেষ ২৪ মিনিট ও নবমীর সূচনার প্রথম ২৪ মিনিটজুড়ে। মূলত দেবী চামু-ার পূজা হয় এই সময়ে। ১০৮টি মাটির প্রদীপ জ্বালিয়ে ও ১০৮টি পদ্মফুল নিবেদন করা হয় দেবীর চরণে। আর ঠিক এই কারণে পূজার মন্ত্রেও সেই বিশেষত্ব উল্লেখ করা হয়েছে।
মহা নবরাত্রিতে দেবী দুর্গার আরাধনায় অনেক গুরুত্ব রয়েছে। যদিও সারা বছর যে উৎসবের জন্য অপেক্ষা করা হয়, তার বিদায়ঘণ্টা বাজিয়ে দেয় এই নবমী নিশি। তাই নবমী নিশিকে সবাই ধরে রাখতে আকুতি জানায়। বাজতে থাকে একটাই সুরÑ ‘ওরে নবমী-নিশি, না হইও রে অবসান।’
পুরোহিতদের মতে, মহানবমীতে ভক্তদের দেওয়া ষোড়শ উপাচারের সঙ্গে ১০৮টি নীলপদ্মে পূজা হবে দেবী দুর্গার। এ ছাড়া আজ নীলকণ্ঠ, নীল অপরাজিতা ফুল ও যজ্ঞের মাধ্যমে মহানবমীর বিহিতপূজা হবে।
জানা যায়, মহানবমীর দিনে যজ্ঞের মাধ্যমে দেবী দুর্গার কাছে আহূতি দেওয়া হবে। ১০৮টি বেলপাতা, আম কাঠ, ঘি দিয়ে এই যজ্ঞ অনুষ্ঠিত হবে। আজ বিজয়া দশমীতে বিসর্জনের মধ্য দিয়ে দেবী দুর্গাকে বিদায় জানাবেন হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা।
এদিকে মহানবমীর দিনে এসেই ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে ভক্তদের হৃদয়। ম-পে ম-পে প্রাণের উৎসবে ভক্তদের মাঝে বয়ে ওঠে বিষাদের সুর। কারণ দশমীতে প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে হবে শারদীয় দুর্গাপূজার সমাপনী। এদিন প্রার্থনার সময় ভক্তকুল অশ্রুসিক্ত হয়ে দেবী দুর্গার কাছে কান্না করতে থাকেন।
মহানবমী সম্পর্কে পুরান ঢাকার বাসিন্দা রাশেজ কৈরি বলেন, নবমীর বিশেষত্ব হচ্ছে ১০৮ পদ্মের পূজা। বলা চলে এটাই শেষ পূজা, কারণ আজ বিসর্জন। আবার বছর পেরিয়ে দেবী আসবে আমাদের মাঝে। তাই দেবী দুর্গার বিদায়ের কথা ভেবেই সবার মন ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে।
বিসর্জনের কথা মনে করে আবেগে আপ্লুত হয়ে বংশালের বাসিন্দা নিকুঞ্জ দাস বলেন, পূজার প্রথম তিন দিন সবার মাঝে অনেক আনন্দ-উচ্ছ্বাস থাকলেও চতুর্থ দিনের সন্ধিপূজার পর সবার মন বিষাদে ভরে যায়। কারণ তখন সবার জানা হয়ে যায় দেবী দুর্গা আমাদের ছেড়ে চলে যাবেন।
আজ বিজয়া দশমী, দেবী দুর্গার বিসর্জন
আজ বিজয়া দশমী। প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘটবে ৫ দিনের সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসবের। তাই ম-পে ম-পে এখন বাজছে বিদায়ের ঘণ্টা। কাল সকালে হবে দশমীর বিহিত পূজা। পূজা শেষে হবে দর্পণ ও বিসর্জন। এদিন দেবী মর্ত্য ছেড়ে কৈলাসে ফিরে যাবেন দোলায় চড়ে।
সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস, মানুষের মনের আসুরিক প্রবৃত্তি, কাম, ক্রোধ, হিংসা, লালসা বিসর্জন দেওয়াই মূলত বিজয়া দশমীর মূল তাৎপর্য। এ প্রবৃত্তিগুলোকে বিসর্জন দিয়ে একে অন্যের সঙ্গে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠা করাই এ আয়োজনের উদ্দেশ্য।
বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের তথ্য মতে, এ বছর সারা দেশে ৩৩,৩৫৫টি পূজাম-প হয়েছে। এর মধ্যে রাজধানীতে ম-প হয়েছে ২৫৯টি। বিজয়া দশমীতে সকালে দর্পণ বিসর্জনের পর থেকে শুরু হবে দেশব্যাপী প্রতিমা বিসর্জনের প্রস্তুতি। প্রত্যেকে নিজ নিজ জেলায় দেবী বিসর্জন করবেন। রাজধানীর অধিকাংশ ম-পের প্রতিমা বিসর্জন হবে বুড়িগঙ্গায়।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন