আজ থেকে ৭১ বছর আগে পাকিস্তান আমলে ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠায় প্রাণবাজি রেখে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্র ভাষাসৈনিক, কবি, প্রাবন্ধিক ও রবীন্দ্রবিশেষজ্ঞ আহমদ রফিক। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি প্রতিষ্ঠিত হয় ভাষার অধিকার। ভাষার অধিকার আদায়ের পথ ধরেই সশ্রস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালে আসে স্বাধীনতা। অধিকার অর্জনের পরও সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালুর স্বপ্নপূরণ করতে না পারার আক্ষেপ নিয়েই গত বৃহস্পতিবার রাত ১০টা ১২ মিনিটে রাজধানীর বারডেম হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) মারা গেছেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন) কীর্তিমান এ ব্যক্তিত্ব।
গণমাধ্যমে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করতে না পারার আক্ষেপ নিয়ে এ ভাষাসৈনিক বলেছিলেন, ‘আক্ষেপ তো একটাই, যে সর্বস্তরের বাংলা চালু করÑ এ সেøাগানটা কার্যকর হলো না।’
বারডেম হাসপাতালের চিকিৎসকরা জানান, গত বৃহস্পতিবার মৃত ঘোষণা করার সাত মিনিট আগে তার কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়। এর আগে শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় গত বুধবার বিকেলে তাকে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়। হাসপাতালের আইসিইউ বিভাগের প্রধান ডা. কানিজ ফাতেমার তত্ত্বাবধানে তার চিকিৎসা চলছিল। কিডনির সমস্যার পাশাপাশি সম্প্রতি কয়েকবার ‘মাইল্ড স্ট্রোক’-এরও শিকার হন তিনি।
এদিকে কীর্তিমান এ ব্যক্তিত্বের অকালপ্রয়াণে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। শোকবার্তায় প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আহমদ রফিক ছিলেন ভাষা আন্দোলনের এক অগ্রগণ্য সাক্ষী ও সংগ্রামী কণ্ঠস্বর। একই সঙ্গে তিনি ছিলেন একজন অনন্য কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও রবীন্দ্রতত্ত্বচর্চার দিশারি। প্রধান উপদেষ্টা ছাড়াও এই ভাষাসৈনিকের অকাল মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন একাধিক উপদেষ্টা, বিএনপির মহাসচিব ফখরুল ইসলাম আলমগীর, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের উপাচার্য ও শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক।
এদিকে ভাষা সংগ্রামীকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে তার মরদেহ আজ শনিবার বেলা ১১টায় শহিদ মিনারে নেওয়া হবে। সর্বসাধারণের শ্রদ্ধা নিবেদনের পর এই গুণীজনের মরদেহ বারডেম হাসপাতাল মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হবে। মৃত্যুর আগে তিনি তার মরদেহ এ হাসপাতালে দান করে গেছেন।
ভাষাসৈনিকের মৃত্যুতে শোক :
সমাজকল্যাণ এবং মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ ভাষাসৈনিকের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে এক বার্তায় বলেছেন, আহমদ রফিক আমাদের মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার সংগ্রামে এক অবিস্মরণীয় ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি আজীবন মুক্তচিন্তা, মানবিক মূল্যবোধ ও প্রগতির পক্ষে কলম চালিয়েছেন এবং প্রজন্মকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন।
আহমদ রফিকের প্রয়াণে জাতি এক সত্যিকারের জ্ঞানী মানুষকে হারাল বলে মন্তব্য করেন তিনি। সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী শোকবার্তায় বলেন, ভাষা আন্দোলনের একজন অগ্রণী সংগ্রামী হিসেবে আহমদ রফিক মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার সংগ্রামে অবিস্মরণীয় ভূমিকা পালন করেছেন। পাশাপাশি সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সমাজচিন্তায় তার অবদান ছিল অনন্য।
আহমদ রফিকের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, আহমদ রফিক ছিলেন মহান ভাষা আন্দোলনের একজন বীর সেনানী। মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা রক্ষায় ও সাহিত্য-সংস্কৃতি বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। আহমদ রফিকের কর্মময় জীবন দেশের মানুষকে সব সময় প্রেরণা জুগিয়ে যাবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমদ খানও গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করে বলেছেন মহান ভাষা আন্দোলনে তিনি অসামান্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। তার এই অবদান জাতি চিরদিন শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ রাখবে। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক শেখ রেজাউদ্দিন আহমেদ (কবি রেজাউদ্দিন স্টালিন) শোক প্রকাশ করে বলেছেন, আহমদ রফিকের জীবন ও কর্ম আগামী প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করার পাশাপাশি জাতির সাংস্কৃতিক অগ্রযাত্রায় অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
ভাষাসৈনিক আহমদ রফিককে গত ১১ সেপ্টেম্বর হেলথ অ্যান্ড হোপ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। ১২ সেপ্টেম্বর এ হাসপাতালের বিছানায় শুয়েই তার ৯৭তম জন্মবার্ষিকী কাটে। তার আগে এক মাসে দুই দফা ল্যাবএইড হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন তিনি।
আহমদ রফিকের জন্ম ১৯২৯ সালের ১২ সেপ্টেম্বর, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। এই ভাষাসৈনিক ২০০৬ সালে স্ত্রীকে হারান এবং নিঃসন্তান। রাজধানীর নিউ ইস্কাটনের গাউসনগরের একটি ভাড়া বাসায় তিনি একাই বসবাস করতেন। ১৯৫৮ সালে আহমদ রফিকের প্রথম প্রবন্ধের বই ‘শিল্প সংস্কৃতি জীবন’ প্রকাশিত হয়। তারপর লেখালেখিতেই জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন তিনি। পেয়েছেন একুশে পদক, বাংলা একাডেমি পুরস্কারসহ অনেক সম্মাননা। এ ছাড়া কলকাতার টেগোর রিসার্চ ইনস্টিটিউট তাকে ‘রবীন্দ্রতত্ত্বাচার্য’ উপাধিতে দিয়েছে। কবিতা, প্রবন্ধ, ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস, গবেষণা মিলিয়ে তার লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা শতাধিক। সর্বশেষ ২০২৩ সালের একুশের বইমেলায় দুটি বই সময় প্রকাশন থেকে ‘ভারত-পাকিস্তান বাংলাদেশ কথা’, এ সময় পাবলিকেশনস থেকে প্রবন্ধগ্রন্থ ‘শিল্প-সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য’ প্রকাশিত হয়।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন