চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি কিছুটা বেড়ে ৪ দশমিক ৮ শতাংশে পৌঁছাবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। গত অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি ছিল ৩ দশমিক ৯৭ শতাংশ, আর তার আগের অর্থবছরে ছিল ৪ দশমিক ২২ শতাংশ। গতকাল মঙ্গলবার ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটির সদ্য প্রকাশিত বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট প্রতিবেদনে এই পূর্বাভাস জানানো হয়। অনুষ্ঠানে প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন বিশ্বব্যাংকের সিনিয়র অর্থনীতিবিদ নাজমুস সাদাত খান। উপস্থিত ছিলেন সংস্থার দক্ষিণ এশিয়ার প্রধান অর্থনীতিবিদ ফ্রানজিসকা ওহসরজে এবং বাংলাদেশ ও ভুটানের কান্ট্রি ডিরেক্টর জঁ পেসমে।
বিশ্বব্যাংক বলছে, মূল্যস্ফীতি হ্রাস ও বেসরকারি ভোগব্যয় বৃদ্ধির ফলে প্রবৃদ্ধি বাড়বে। তবে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও ব্যাংকিং খাতের দুর্বলতা বিনিয়োগে মন্থরতা আনতে পারে। বৈশ্বিক বাণিজ্য উত্তেজনা চলমান থাকলেও যুক্তরাষ্ট্রের নতুন শুল্ক কাঠামোর অধীনে বাংলাদেশের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বজায় থাকবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আমদানি স্বাভাবিক হওয়ায় চলতি হিসাব পুনরায় ঘাটতিতে পড়তে পারে। তবে রাজস্ব সংস্কারের ফলে বাজেট ঘাটতি জিডিপির ৫ শতাংশের নিচে থাকবে। সরকারি ঋণ ২০২৬-২৭ অর্থবছরে জিডিপির ৪১ দশমিক ৭ শতাংশে পৌঁছাতে পারে।
বিশ্বব্যাংক অর্থনীতিতে ছয়টি প্রধান ঝুঁকির কথা উল্লেখ করেছে। এগুলো হচ্ছেÑ ব্যাংকিং খাতের দুর্বলতা, নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, সংস্কার বাস্তবায়নে বিলম্ব, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বিঘœ, প্রত্যাশার তুলনায় ধীর মূল্যস্ফীতি হ্রাস ও জ্বালানি সরবরাহে সীমাবদ্ধতা। সংস্থাটি বলছে, সংস্কার ও বিনিয়োগ কার্যক্রম জোরদার হলে আগামী অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি বেড়ে ৬ দশমিক ৩ শতাংশে পৌঁছাতে পারে। তখন মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৫ শতাংশে নেমে আসবে এবং দারিদ্র্যের হার ১৯ দশমিক ১ শতাংশে কমবে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৬ সালের নভেম্বর মাসে বাংলাদেশের এলডিসি থেকে উত্তরণ রপ্তানিতে তাৎক্ষণিক নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে না। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ২০২৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের জন্য অগ্রাধিকারমূলক শুল্কহার বহাল রাখবে। বিশ্বব্যাংকের মতে, এলডিসি উত্তরণ হবে অর্থনীতির কাঠামোগত সংস্কার, প্রতিযোগিতা বাড়ানো ও বৈচিত্র্যায়নের জন্য বড় সুযোগ।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৫ সালের মার্চ নাগাদ ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের হার বেড়ে দাঁড়ায় ২৪ দশমিক ১ শতাংশেÑ যা দক্ষিণ এশিয়ার গড় ৭ দশমিক ৯ শতাংশের চেয়ে অনেক বেশি। সরকার ব্যাংকিং খাতের ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা জোরদার ও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর শাসনব্যবস্থা উন্নত করতে সংস্কার কার্যক্রম শুরু করেছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীনতা বাড়াতে আইনি কাঠামো সংশোধনের কাজ চলছে।
বিশ্বব্যাংক জানায়, প্রবাসী আয় ২৬ দশমিক ৮ শতাংশ এবং রপ্তানি আয় ৮ দশমিক ৮ শতাংশ বেড়েছে। বিশেষ করে পোশাক, চামড়া, জুতা, প্লাস্টিক ও কৃষিপণ্যে প্রবৃদ্ধি এসেছে। আমদানি বেড়েছে ৪ দশমিক ৩ শতাংশ। উন্নয়ন সহযোগীদের বাজেট সহায়তা ও প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ ২০ শতাংশের বেশি বৃদ্ধি পাওয়ায় আর্থিক ভারসাম্য ঘাটতি থেকে উদ্বৃত্তে পরিণত হয়েছে। এতে রিজার্ভ স্থিতিশীল রাখতে সহায়তা পেয়েছে বাংলাদেশ।
২০২৪-২৫ অর্থবছরে কর-জিডিপি অনুপাত ৭ দশমিক ৪ শতাংশ থেকে কমে ৬ দশমিক ৮ শতাংশে নেমেছে। মূল কারণ হিসেবে বিশ্বব্যাংক উল্লেখ করেছে, কর আদায়ে মন্থর প্রবৃদ্ধি ও ভর্তুকি এবং সুদ পরিশোধজনিত ব্যয় বৃদ্ধি। তবে রাজস্ব আয় বাড়াতে সরকার কর নীতি ও প্রশাসনের পৃথকীকরণ, কর ব্যয় ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন এবং ব্যক্তিগত করদাতাদের জন্য অনলাইন রিটার্ন বাধ্যতামূলক করার মতো সংস্কার শুরু করেছে। বিশ্বব্যাংকের সার্বিক মূল্যায়ন অনুযায়ী, বাংলাদেশের অর্থনীতি ধীরে ধীরে স্থিতিশীলতার পথে এগোলেও টেকসই প্রবৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন আর্থিক খাতের পুনর্গঠন, কার্যকর সংস্কার বাস্তবায়ন এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন