বর্তমান বিশ্বে জনস্বাস্থ্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে ভাইরাল হেপাটাইটিস। এটি মূলত যকৃতের একটি সংক্রামক রোগ, যা বিভিন্ন ধরনের ভাইরাসের মাধ্যমে সৃষ্ট হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডঐঙ)-এর তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে প্রতি বছর প্রায় ১.৪ মিলিয়ন মানুষ ভাইরাল হেপাটাইটিসের কারণে মৃত্যুবরণ করে। দুঃখজনক হলেও সত্য, এই রোগটি সম্পর্কে অনেকেরই পর্যাপ্ত জ্ঞান নেই, ফলে এটি একটি ‘নীরব ঘাতক’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।
ভাইরাল হেপাটাইটিসের প্রকারভেদ
ভাইরাল হেপাটাইটিস সাধারণত পাঁচটি ভিন্ন ভাইরাস দ্বারা সৃষ্ট হয়Ñহেপাটাইটিস অ, ই, ঈ, উ এবং ঊ । প্রতিটি ভাইরাসের সংক্রমণের ধরন, লক্ষণ, চিকিৎসা ও প্রতিরোধ পদ্ধতি আলাদা।
১. হেপাটাইটিস অ (ঐঅঠ)
সংক্রমণ: দূষিত পানি ও খাবারের মাধ্যমে ছড়ায়।
প্রকৃতি: সাধারণত স্বল্পমেয়াদি এবং আত্মসীমাবদ্ধ (ংবষভ-ষরসরঃরহম)।
প্রতিরোধ: নিরাপদ খাদ্যাভ্যাস, বিশুদ্ধ পানি, এবং টিকাদান।
২. হেপাটাইটিস ই (ঐইঠ)
সংক্রমণ: সংক্রমিত রক্ত, শারীরিক তরল, যৌন সম্পর্ক ও মাতৃগর্ভে সন্তানের মধ্যে ছড়ায়।
প্রকৃতি: তীব্র এবং দীর্ঘমেয়াদি (ক্রনিক) উভয় রূপে হতে পারে।
জটিলতা: যকৃত সিরোসিস ও যকৃত ক্যানসার পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে।
প্রতিরোধ: নবজাতক থেকে প্রাপ্তবয়স্ক সবাই এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে টিকা দেওয়া উচিত।
৩. হেপাটাইটিস ঈ (ঐঈঠ)
সংক্রমণ: প্রধানত রক্তের মাধ্যমে ছড়ায় (যেমন: ইনজেকশন শেয়ারিং, অস্বাস্থ্যকর রক্তসঞ্চালন)।
প্রকৃতি: অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দীর্ঘমেয়াদি এবং মারাত্মক।
চিকিৎসা: বর্তমানে এটির জন্য কার্যকর ওষুধ রয়েছে যা রোগ নিরাময় করতে পারে, তবে টিকা নেই।
৪. হেপাটাইটিস উ (ঐউঠ)
সংক্রমণ: এটি শুধুমাত্র হেপাটাইটিস বি ভাইরাসের উপস্থিতিতে সংক্রমিত হয়।
প্রতিরোধ: হেপাটাইটিস বি টিকাদানের মাধ্যমে এই ভাইরাস প্রতিরোধ করা সম্ভব।
৫. হেপাটাইটিস ঊ (ঐঊঠ)
সংক্রমণ: দূষিত পানি ও খাদ্যের মাধ্যমে।
বৈশিষ্ট্য: সাধারণত স্বল্পমেয়াদি, তবে গর্ভবতী নারীদের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।
রোগের লক্ষণ
ভাইরাল হেপাটাইটিসের লক্ষণগুলো প্রাথমিকভাবে সাধারণ জ্বর বা গ্যাস্ট্রিক সমস্যার মতো মনে হলেও, তা ধীরে ধীরে জটিল হতে পারে। লক্ষণগুলো হলো:
- ক্লান্তি ও দুর্বলতা
- ক্ষুধামান্দ্য
- বমি বমি ভাব বা বমি
- পেট ব্যথা (বিশেষত ডান পাশে)
- চোখ ও চামড়া হলুদ হয়ে যাওয়া (জন্ডিস)
- প্রস্রাবের রং গাঢ় হওয়া
- হালকা বর্ণের মল
অনেক সময় হেপাটাইটিস বি ও সি রোগীরা দীর্ঘসময় উপসর্গহীন থাকতে পারেন, যা রোগের নীরবতা ও ভয়াবহতা বাড়িয়ে তোলে।
বৈশ্বিক চিত্র ও বাংলাদেশ
বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি মানুষ এই ভাইরাসগুলোর সংস্পর্শে রয়েছেন। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, সাব-সাহারান আফ্রিকা ও পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে এই রোগের প্রকোপ বেশি। বাংলাদেশে হেপাটাইটিস বি এর প্রাদুর্ভাব জনগোষ্ঠীর প্রায় ৪% এবং সি-এর ক্ষেত্রে প্রায় ০.২-১%। দেশের বিভিন্ন এলাকায় এখনো নিরাপদ রক্ত সঞ্চালনের ব্যবস্থা নিশ্চিত না হওয়ায় অনেকেই অজান্তেই সংক্রমিত হচ্ছেন।
প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ
ভাইরাল হেপাটাইটিস প্রতিরোধ করা সম্ভব, যদি আমরা সচেতন হই এবং সঠিক ব্যবস্থা গ্রহণ করি।
টিকাদান:
হেপাটাইটিস অ ও ই-এর জন্য কার্যকর টিকা রয়েছে।
- রক্ত গ্রহণের আগে পরীক্ষা নিশ্চিত করা।
- সুরক্ষিত যৌন সম্পর্ক বজায় রাখা।
- ইনজেকশন ও অস্ত্রোপচারে জীবাণুমুক্ত যন্ত্রপাতির ব্যবহার।
- বিশুদ্ধ পানি ও নিরাপদ খাদ্য গ্রহণ।
চিকিৎসা:
হেপাটাইটিস সি এখন সঠিক ওষুধের মাধ্যমে নিরাময়যোগ্য।
হেপাটাইটিস বি নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য দীর্ঘমেয়াদি ওষুধ রয়েছে যা যকৃতের ক্ষয় রোধ করে।
সচেতনতা এবং শিক্ষা
প্রতিরোধের জন্য সবচেয়ে কার্যকর উপায় হচ্ছে সচেতনতা ও শিক্ষা। স্কুল, কলেজ ও কমিউনিটি পর্যায়ে ভাইরাল হেপাটাইটিস সম্পর্কে প্রচার, স্বাস্থ্য শিবির, বিনা মূল্যে টিকাদান কর্মসূচি এবং গণমাধ্যমে নিয়মিত প্রচারণা এই রোগ মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
উপসংহার
ভাইরাল হেপাটাইটিস একটি নীরব মহামারির মতো বিস্তার লাভ করেছে। এই রোগের বিপরীতে আমাদের সবচেয়ে বড় অস্ত্র হলো সচেতনতা, টিকাদান এবং স্বাস্থ্য সচেতন আচরণ। সরকার, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, চিকিৎসক ও জনগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমেই আমরা এই ভয়াবহ সংক্রমণকে রুখে দিতে পারি।
আমাদের এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে-আগামী প্রজন্মের একটি সুস্থ ও সংক্রমণমুক্ত ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে।
ডা. মোহাম্মাদ আবদুল্লা আল ফারুক
সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান
হেপাটোলজি (লিভার) বিভাগ
চেম্বার: আলোক হেলথকেয়ার, মিরপুর-১০, ঢাকা।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন