জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনাপর্ব শেষ হয়েছে। দীর্ঘ কয়েক মাসের আলোচনার পরও গণভোটের সময় ও পদ্ধতি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মতভেদ কাটেনি। তবুও একটি ইতিবাচক অগ্রগতি হলো, আগামী ১৫ অক্টোবর জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’ স্বাক্ষরিত হবে। এই পদক্ষেপ হয়তো এখনই সব প্রশ্নের সমাধান আনবে না, কিন্তু রাজনৈতিক সংস্কারের পথে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হবে।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা নতুন কিছু নয়। প্রায় দুই দশক ধরে ক্ষমতা পরিবর্তনের প্রতিটি পর্যায়েই দেখা গেছে পরস্পরের প্রতি অবিশ্বাস, প্রতিশোধমূলক রাজনীতি এবং গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য দীর্ঘদিন ধরে একটি জাতীয় ঐকমত্যের দাবি উঠেছে। সেই আহ্বানের প্রতিক্রিয়ায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গত বছর ১১টি সংস্কার কমিশন গঠন করে। নির্বাচনব্যবস্থা, পুলিশ, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন, সংবিধান ও দুর্নীতি দমন বিষয়ে সংস্কারের জন্য গঠিত এই কমিশনগুলোর সুপারিশ বিবেচনা ও গ্রহণের লক্ষ্যে জাতীয় ঐকমত্য গঠনে রাজনৈতিক দল ও শক্তিগুলোর সঙ্গে আলোচনার জন্য জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করা হয়।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত এই কমিশন বিশেষজ্ঞ ও রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে বিভিন্ন প্রস্তাব সংগ্রহ করে সনদের খসড়া তৈরি করেছে। কিন্তু যেখানে এসে আলোচনা থেমে গেল, খেয়াল করলে দেখা যায়, সেটি মূলত আস্থার সংকটের জায়গা। বিএনপি ও সমমনা দলগুলো জাতীয় নির্বাচনের দিন একযোগে গণভোট আয়োজনের পক্ষে যুক্তি দিয়েছে। তাদের মতে, নির্বাচনের আগে গণভোট আয়োজন সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল। অপরদিকে জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপি চাইছে নির্বাচনের আগে গণভোট হোক, যাতে এটি নিজস্ব গুরুত্ব পায়। অর্থাৎ উভয় পক্ষই গণতন্ত্রের পক্ষে অবস্থান নিচ্ছে, কিন্তু তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ও সময়চেতনায় পার্থক্য থেকেই যাচ্ছে।
এই মতভেদকে আমরা রাজনৈতিক বাস্তবতার অংশ হিসেবেই দেখতে চাই। তবে যে উদ্যোগটি এত দিনে একটি জাতীয় ঐকমত্যের কাঠামো দাঁড় করাতে পেরেছে, তা যেন এই বিভাজনের কারণে ভেস্তে না যায়। রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত নিজেদের অবস্থান নিয়ে আবারও আলোচনায় বসা এবং একটি গ্রহণযোগ্য সমাধান খুঁজে বের করা। নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না যে আহ্বান জানিয়েছেন, তা মেনে বিএনপি, জামায়াতসহ সংশ্লিষ্ট দলগুলো যেন নিজেদের মধ্যে বসে সমঝোতায় পৌঁছে; এটি অত্যন্ত যৌক্তিক। ঐক্য গঠনের প্রথম শর্তই হলো আলোচনা ও পরস্পরকে বোঝার চেষ্টা।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ জানিয়েছেন, রাজনৈতিক দল ও বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ সমন্বয় করে সরকারের কাছে চূড়ান্ত সুপারিশ পাঠানো হবে। এটি ইতিবাচক খবর। তবে আরও গুরুত্বপূর্ণ হলো, সরকার সেই সুপারিশ কতটা আন্তরিকভাবে বাস্তবায়ন করতে প্রস্তুত। জুলাই সনদ যদি কেবল একটি আনুষ্ঠানিক দলিলে পরিণত হয়, তবে এই প্রক্রিয়ার পুরো অর্জন প্রশ্নবিদ্ধ হবে। কিন্তু যদি এটি বাস্তব সংস্কারের সূচনা করে, এটি হবে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের নতুন অধ্যায়। গণতন্ত্রের মূল শক্তি হলো ঐক্য। রাজনৈতিক মতভেদ থাকা স্বাভাবিক, কিন্তু জাতীয় স্বার্থে সবাইকে একটি বিন্দুতে আসতে হবে। ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাব সেই সম্ভাবনাই উন্মুক্ত করেছে। দায়িত্ব এখন রাজনৈতিক নেতাদের হাতে; তারা এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে আস্থার সেতু গড়তে পারেন কি না, সেটিই দেখার বিষয়।
১৫ অক্টোবরের স্বাক্ষর অনুষ্ঠানকে আমরা শুধু আনুষ্ঠানিকতা হিসেবে না দেখে, নতুন আশা হিসেবে দেখতে চাই। বাংলাদেশের রাজনীতি যদি বিভাজনের বদলে আলোচনার ও সমঝোতার পথে ফিরতে পারে, তবে তা হয়ে উঠবে জাতীয় পুনর্জাগরণের প্রতীক।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন