মানুষই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি, কারণ তার আছে বিবেক, ন্যায়বোধ ও মানবতা। কিন্তু যখন মানুষই নিজের হাতে গড়ে তোলে এমনসব সামাজিক প্রথা, যা অন্য মানুষের স্বাধীনতা, মর্যাদা ও সুখ কেড়ে নেয়Ñ তখনই মানবতা পরাজিত হয়। আজ আমাদের সমাজ সেই পরাজয়ের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে নানা কুপ্রথা ও অপসংস্কৃতির দাসত্বে। যৌতুক, উচ্চ কাবিন, মৃত্যুর পর চারদিনা, চল্লিশা, অপ্রয়োজনীয় মেজবান, বিয়ের অপচয়- এসব এখন শুধু সমাজের ‘রেওয়াজ’ নয়, অনেক ক্ষেত্রে অপরাধও বটে। সবচেয়ে ভয়ংকর দিক হলোÑ এসব প্রথা কেউ চাপিয়ে দেয়নি; আমরা নিজেরাই এগুলো সৃষ্টি করেছি এবং এখন তার দাসে পরিণত হয়েছি।
যৌতুক: মানবতার সবচেয়ে লজ্জাজনক লেনদেন যৌতুক দেওয়া-নেওয়া। যৌতুক মানে এক কথায় লোভের বৈধীকরণ। এটি কোনো উপহার নয়, বরং মানবতার ঘৃণ্য বাণিজ্য। এক পক্ষের লোভ ও অন্য পক্ষের সামাজিক ভয়ে তৈরি হয় এই অমানবিক চক্র। আজও গ্রাম থেকে শহর-সব জায়গায় দেখা যায়, ছেলের শিক্ষাগত যোগ্যতা বা পেশার ওপর ভিত্তি করে নির্ধারিত হয় ‘রেট’। যেন মানুষ নয়, বাজারের পণ্য! যৌতুকপ্রথা শুধু একটি মেয়ে বা পরিবারকে নয়, গোটা সমাজকে অসুস্থ করে তোলে। কারণ, যে সমাজে বিবাহ একটি অর্থনৈতিক লেনদেন হয়ে যায়, সেখানে ভালোবাসা, সম্মান ও পারস্পরিক শ্রদ্ধা টিকে থাকতে পারে না। অধিকাংশ মানুষ জানে যৌতুক অপরাধ, কিন্তু সামাজিক মর্যাদা বা লোকের কথার ভয়ে কেউ প্রতিবাদ করে না। অথচ পরিবর্তনের শুরু হতে পারে একটিমাত্র ‘না’ থেকে- ‘না, আমি যৌতুক নেব না, দেবও না।’
উচ্চ কাবিন: বিপরীত দিকের একই অমানবিকতা বিয়েতে উচ্চ কাবিন। ইসলাম বিবাহকে সহজ করতে বলেছে। নবী করিম (সা.) বলেছেন- ‘সবচেয়ে বরকতময় বিবাহ সেটা, যা সবচেয়ে সহজ।’ কিন্তু আমাদের সমাজে কাবিন এখন প্রতিযোগিতা- কে কত লাখ টাকার কাবিন লিখাবে! একদিকে যৌতুকের নামে মেয়ের পরিবার নিঃস্ব হচ্ছে, অন্যদিকে কাবিনের নামে ছেলের পরিবার ভীত। দুই প্রথাই একই মূল থেকে জন্ম নেয়Ñ অহংকার ও সামাজিক প্রদর্শন। কাবিনের উদ্দেশ্য ছিল নারীর নিরাপত্তা, কিন্তু আজ তা ব্যবহার হচ্ছে মর্যাদার মাপকাঠি হিসেবে। প্রকৃত মর্যাদা কাগজে লেখা টাকার অঙ্কে নয়, বরং পারস্পরিক দায়িত্ববোধ ও ভালোবাসায়।
মেজবান, চারদিনা ও চল্লিশা: চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী মেজবান একসময় ছিল মানবিকতার দৃষ্টান্ত, ধনী-গরিব সবার জন্য উন্মুক্ত ভোজ। কিন্তু আজ তা অনেক ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা ও বিলাসিতার প্রতীক হয়ে গেছে। একদিকে খরচের জৌলুস, অন্যদিকে দরিদ্র প্রতিবেশীর মুখে আহার নেই- এই বৈষম্যই মানবতাকে কলুষিত করছে। একইভাবে, মৃত ব্যক্তির স্মরণে ‘চারদিনা’, ‘চল্লিশা’ ইত্যাদি অনুষ্ঠান ইসলামের অংশ নয়। এগুলো সৃষ্টি হয়েছে সামাজিক চাপে ও প্রথাগত ভয়ে। একজন দরিদ্র পরিবার প্রিয়জন হারানোর শোকে কাতর, তবু তাকে ধার করে খরচ করতে হয় কেবল ‘লোক দেখানোর’ জন্য। এটি নিঃসন্দেহে একধরনের সামাজিক নিপীড়ন ও নীরব অত্যাচারও বটে।
অপচয়ের বিয়ে: এখনকার বিয়েতে আলো, ব্যান্ড-শো, গেট, ভিডিও, ড্রোন-সবই প্রয়োজনের চেয়ে প্রদর্শনের জন্য। যেন খরচই মর্যাদার প্রমাণ। অথচ ইসলামের শিক্ষায় সরল ও সহজ বিয়েতেই বরকত নিহিত। যদি সেই অর্থ সমাজের অনাহারী, এতিম বা প্রতিবেশীর প্রয়োজনে ব্যয় করা যেত, তবে তা হতো মানবতার প্রকৃত উদযাপন। কিন্তু আমরা আনন্দকে প্রতিযোগিতায় পরিণত করেছি, আর প্রতিযোগিতায় জয়ী হতে গিয়ে হারাচ্ছি মনুষ্যত্ব।
কেন টিকে আছে এসব অপসংস্কৃতি: এসব কুপ্রথা টিকে আছে মূলত তিন কারণেÑ অজ্ঞতা: মানুষ ধর্ম ও নৈতিকতার প্রকৃত শিক্ষা থেকে দূরে সরে গেছে। ভয় ও সামাজিক চাপ: লোকে কী বলবে’ মানসিকতা আমাদের সাহস কেড়ে নিয়েছে। দর্শনের অভাব: আমরা সংস্কৃতির গভীরতা না বুঝে কেবল আচার অনুসরণ করি। এই তিন বিষের মিশ্রণেই সমাজে মানবতার মৃত্যু ঘটছে ধীরে ধীরে।
সমাধান: আইন নয়, সচেতন বিবেককে জাগ্রত করতে হবে এসব কুপ্রথা ও কুসংস্কার দূরীকরণে। আইন একা কিছুই করতে পারে না, যদি সমাজের বিবেক জাগ্রত না হয়। পরিবর্তনের সূচনা হতে পারে প্রতিটি পরিবারের ভেতর থেকে। যখন বাবা তার ছেলেকে বলবেন- ‘বিয়ে করবে, কিন্তু যৌতুক নেবে না’, যখন মা তার মেয়েকে বলবেন- ‘বিয়েতে অপচয় নয়, বরকত চাই’। যখন ইমাম, শিক্ষক ও স্থানীয় নেতৃত্ব বলবেন- ‘চারদিনা নয়, দোয়া দরকার’, তখনই সমাজের ভিত থেকে ভাঙবে এই অমানবিক সংস্কৃতি। পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজন কেবল এক মুহূর্তের সাহস, ‘না’ বলার সাহস। আর মনে রাখতে হবেÑ যে সমাজে প্রথা মানবতার ওপরে, সেখানে কোনো সংস্কৃতিই টিকে না। এ ক্ষেত্রে আমাদের নতুন প্রজন্মের সচেতনতাই নির্ভর করে গড়ে তুলবে আগামীর মানবিক সমাজ।
শিব্বির আহমেদ রানা, গণমাধ্যমকর্মী বাঁশখালী, চট্টগ্রাম
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন