কর্মময় জীবনের ব্যস্ততার ভিড়ে নিজেকে এবং পরিবারকে আলাদাভাবে সময় দিতে হলে ভ্রমণের কোনো বিকল্প নেই। এর জন্য প্রয়োজন সঠিক সময় ও সঠিক সিদ্ধান্ত। এই ভ্রমণ হতে পারে দেশে কিংবা দেশের বাইরে। আর এই ভ্রমণের জন্য সামর্থ্য অনুযায়ী কাছাকাছি কোনো জায়গা বেছে নিতে পারেন। এতে সময় ও টাকা দুটোই বেঁচে যাবে। ঘুরে বেড়ানোর জন্য আমাদের দেশে অনেক দর্শনীয় স্থান রয়েছে। এর মধ্যে চাঁদপুর জেলা ভ্রমণের জন্য অনেক জনপ্রিয় গন্তব্য। এই জেলায় রয়েছে ইতিহাস ও ঐতিহ্যে ঘেরা অসংখ্য দর্শনীয় স্থান। এ ছাড়া এখানে দেখা যায় পদ্মা-মেঘনার একমাত্র মিলনস্থলের অপরূপ সৌন্দর্য। এক দিনেই ঘুরে ফেরার জন্য নির্ভরযোগ্য চাঁদপুর সম্পর্কে জানাচ্ছেন মো. মাসুদ হোসেন।
জমিদারবাড়ি
চাঁদপুর জেলা শহর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে ফরিদগঞ্জ উপজেলা শহর। সেখান থেকে প্রায় ৫ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে যাওয়া যায় রূপসা জমিদার বাড়িতে। চাঁদপুরের মানুষ কিংবা বাইরের মানুষ চাঁদপুরের জমিদারবাড়ি বলতে শুধু এই রূপসা জমিদার বাড়িটাকেই চেনে। এটা সবচেয়ে বেশি আইকনিক। আর এটাই চাঁদপুরের একমাত্র জমিদারবাড়ি, যার অবস্থান জনবহুল জায়গায়, একদম রূপসা বাজারের পাশে। ১৮ শতকের মাঝামাঝি সময়ে নির্মাণ করা হয় এই জমিদারবাড়িটি। এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন আহম্মদ রাজা চৌধুরী। দেশের বেশিরভাগ জমিদার বাড়ির যখন ভগ্নদশা, তখন চাঁদপুরের এই জমিদারবাড়িটি সংস্কার করে এখনো প্রায় আগের মতোই সুন্দর করে রাখা হয়েছে। প্রায় ২৫০ বছর আগে বংশাল গ্রামের, বর্তমান খাজুরিয়া গ্রামের হিন্দু জমিদারদের জমিদারির পতন হলে ব্রিটিশদের কাছ থেকে এই জমিদারি কিনে নেন আহম্মদ রাজা চৌধুরী এবং তিনি রূপসা জমিদারবাড়ি প্রতিষ্ঠা করেন; যদিও এই জমিদার বাড়ির মূল প্রতিষ্ঠাতা কে তা নিয়ে ভিন্নমত রয়েছে।
এ ছাড়াও এ উপজেলায় আরও রয়েছে কড়ৈতলী জমিদারবাড়ি, শোল্লা জমিদারবাড়ি ও লোহাগড় জমিদারবাড়ি। এমনকি পুরো চাঁদপুর জেলায় রয়েছে ইতিহাস ঘেরা এরকম আরও ৬টি জমিদারবাড়ি।
ঐতিহাসিক বড় মসজিদ
এটি চাঁদপুর জেলা শহর থেকে ২৩ কিলোমিটার পূর্বে চাঁদপুর-কুমিল্লা আঞ্চলিক মহাসড়কের পাশে হাজীগঞ্জ বাজারে অবস্থিত। এই মসজিদটি চাঁদপুর জেলার একটি প্রাচীন মসজিদ। কেবল প্রাচীনের দিক থেকে নয়, আয়তনের দিক দিয়ে এই মসজিদটি উপমহাদেশের অন্যতম মসজিদ। এ ছাড়া জুমাতুল বিদার বৃহত্তম জামাতও এই মসজিদে প্রতি বছর অনুষ্ঠিত হয়। এসব কারণে মসজিদটির ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। বর্তমানে ২৮ হাজার ৪০৫ বর্গফুট ভূমির ওপরে সগৌরবে দাঁড়িয়ে থাকা মসজিদটি দেখতে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে অসংখ্য পর্যটক ভিড় জমান। ১৮৮ ফুট উচ্চতার মিনার বেষ্টিত মসজিদটি আহমাদ আলী পাটোয়ারী ওয়াকফ এস্টেটের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে।
বিভিন্ন সূত্র অনুযায়ী, বাংলা একাদশ শতকের গোড়ার দিকে মকিম উদ্দিন রে.) আরব দেশে থেকে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশে হাজীগঞ্জ আসেন। তার নামানুসারেই পরবর্তীতে এই স্থানের নাম হয় মকিমাবাদ। সেই সময়ে মসজিদটি খড়ের নির্মিত একচালা ছিল। ১৩৩৭ বঙ্গাব্দের ১৭ আশ্বিন মাওলানা আবুল ফারাহ জৈনপুরী (র.) পাঁকা মসজিদটির ভিত্তিপ্রস্থর স্থাপন করেন। নির্মাণকাজ শেষ হলে ১৩৪৪ বঙ্গাব্দের ১০ অগ্রহায়ণ এই মসজিদে প্রথম জুমার নামাজ পড়ানো হয়। সেই নামাজে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীসহ দেশবরণ্যে ব্যক্তিবর্গ অংশগ্রহণ করেন।
মিনি কক্সবাজার
পদ্মা, মেঘনা ও ডাকাতিয়া নদীর মিলনস্থলে অবস্থিত মিনি কক্সবাজার পর্যটনকেন্দ্রটি। এটি নদীকেন্দ্রিক বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পর্যটনকেন্দ্র। এর চারদিকে নদী হওয়ায় কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের মতো দেখায়। তাই পর্যটকরা এই নাম দিয়েছেন। স্থানীয়ভাবে বালুচর, পদ্মার চর ও মেঘনার চর নামেও এর পরিচিতি রয়েছে। ডিসেম্বর থেকে চলমান এই সময়ে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে দর্শনার্থীরা এই স্থানে ঘুরতে আসেন। এমনকি পরিবার-পরিজন নিয়ে কক্সবাজারের আমেজ পেতে চাঁদপুরের মানুষের একমাত্র জায়গা এটি। অবকাঠামোগত কোনো উন্নয়ন না থাকলেও স্বল্প খরচ আর কম সময়ের মধ্যে ঘুরে দেখা যায় স্থানটি। চাঁদপুর বড় স্টেশন থেকে জনপ্রতি ১০০ টাকার মধ্যে ট্রলার নিয়ে ঘুরে আসা যায় মিনি কক্সবাজারখ্যাত পদ্মার বালুচর থেকে। এখানে রয়েছে আরও একটি সৌন্দর্য। স্থানীয় কৃষকরা এই চরে সরিষার চাষ করেন। হলুদের সমারোহে সরিষা ফুলে মন জুড়িয়ে যায় যেকোনো পর্যটকের। দল বেঁধে কিংবা পিকনিক স্পটের জন্য খোলামেলা এ স্থানটি হতে পারে বিনোদন স্পট।
ত্রি নদীর মোহনা
দেশের পদ্মা ও মেঘনা নদীর একমাত্র মিলনস্থল এই চাঁদপুর। সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ডাকাতিয়া নদীও। এই তিন নদীকে ঘিরে স্থানীয়রা নাম দিয়েছেন ত্রি নদীর মোহনা। মূলত এটি চাঁদপুর বড় স্টেশন কিংবা মোল হেড নামেও বেশ পরিচিত। শহরের কাছেই নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে পরিবার-পরিজন নিয়ে সময় কাটানোর সুন্দর একটি স্থান। এটি শুধু একটি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কেন্দ্র নেয়, বরং রহস্যময় কাহিনি ও বিপদের স্মৃতিবিজড়িত স্থান হিসেবেও পরিচিত। এখানে নদীর বিশাল স্রোত আর ভয়ংকর ঘূর্ণিপাক দেখার জন্য প্রতিবছর অসংখ্য পর্যটক ভিড় জমায়। মোলহেড থেকে সূর্যাস্ত দেখার অভিজ্ঞতা অপূর্ব। নদীর তীর থেকে পশ্চিম দিকে বিস্তৃত দিগন্তজোড়া সূর্যের মেলান্দাজ এ স্থানের প্রধান আকর্ষণ। তিনটি নদীর জলধারা একত্রে মিশে যে দৃশ্যপট সৃষ্টি করে তা প্রকৃতিপ্রেমীদের জন্য অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর। পদ্মা, মেঘনা এবং ডাকাতিয়ার তীব্র স্রোত মোলহেড এলাকায় বিশাল ঘূর্ণিপাক সৃষ্টি করে।
যেভাবে যাবেন
দেশের যেকোনো স্থান থেকে সড়ক, রেল ও নৌপথে খুব সহজেই যাওয়া যায় চাঁদপুরে। সড়কপথে যেতে হলে কুমিল্লা হয়ে চাঁদপুর জেলা শহরে আসা যায়। এ ক্ষেত্রে রাজধানী ঢাকা থেকে বিআরটিসি ও পদ্মা বাস পাওয়া যায়। ভাড়া পড়বে জনপ্রতি ৩০০-৩৫০ টাকা।
এ ছাড়া স্বল্প সময়ে আসতে চাইলে ঢাকা থেকে গৌরীপুর বা শ্রী রায়েরচর থেকে মতলব হয়ে বাবুরহাট দিয়েও চাঁদপুর জেলা শহরে আসা যায়। নৌপথে আসতে চাইলে ঢাকা সদরঘাট থেকে সকাল ৬টা থেকে রাত সাড়ে ১২টা পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে চাঁদপুরের উদ্দেশে বিভিন্ন লঞ্চ ছেড়ে যায়। জনপ্রতি ২৫০ টাকা থেকে শুরু করে আসনভেদে বিভিন্ন ভাড়ায় চাঁদপুর লঞ্চঘাটে পৌঁছানোর পর সেখান থেকে অটোরিকশায় ১০ টাকায় শহরের কালিবাড়ি বা কোর্ট স্টেশনে আসতে পারবেন। তা ছাড়া ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের লাকসাম রেলওয়ে জংশন থেকেও বেলা ১১টায় সাগরিকা এবং রাত ৮টায় আন্তঃনগর মেঘনা এক্সপ্রেস ট্রেনে করে জনপ্রতি ৫০ টাকা ভাড়ায় চাঁদপুর কোর্ট স্টেশন বা বড় স্টেশনে এসে নামা যায়।
যেখানে থাকবেন
চাঁদপুর শহরে থাকার জন্যে মোটামুটি ভালো হোটেলের মধ্যে সদর হসপিটালের সামনে হোটেল গ্র্যান্ড হিলশা উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া চাঁদপুর কোর্ট স্টেশনের কাছে মোটামুটি মানের কিছু আবাসিক হোটেল পাবেন। আর চৌধুরী ঘাট বা নতুন ব্রিজের কাছে নদীর পাড়ে আরও কিছু মধ্যম মানের হোটেল রয়েছে।
যেখানে খাবেন
খিদে মেটানোর জন্য চাঁদপুরে বিভিন্ন মানের বেশকিছু খাবার হোটেল রয়েছে। আপনার পছন্দমতো যেকোনো হোটেলে খাবার খেয়ে নিতে পারবেন। বড় স্টেশনের হিলশা কিচেন কিংবা কালিবাড়ি কয়েকটি বাংলা ও চাইনিজ হোটেল ও রেস্টুরেন্ট রয়েছে। এ ছাড়াও হাজীগঞ্জ শহরে বেশ কয়েকটি উন্নতমানের হোটেল রয়েছে।
অবশ্যই ফরিদগঞ্জের আউয়াল ভাইয়ের মিষ্টি এবং ওয়ান মিনিট আইসক্রিম এর স্বাদ নিতে পারেন।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন