পল্লিকবি জসিমউদ্দীনের গান বা চলচ্চিত্রে দেখা বেদেদের নৌকায় ভেসে বেড়ানো ও সাপ খেলা দেখিয়ে জীবিকা নির্বাহ করার চিরায়ত চিত্র এখন অতীত। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সম্প্রদায়টি এখন নদী ছেড়ে জমিনে উঠেছে। তারই এক উদাহরণ হলো ফরিদপুরের মুন্সিবাজার এলাকা, যেখানে বর্তমানে প্রায় ৫৫টি ঝুপড়িতে ৮০টি বেদে পরিবার বসবাস করছে। বেদে পল্লিটি একটি শিল্প গ্রুপের বড় প্লটের জমিতে গড়ে উঠেছে।
স্থায়ী বসতি স্থাপন করলেও নিজস্ব জমি না থাকায় এবং চিরায়ত পেশা না চলায় বেদে পুরুষ সদস্যরা প্রায়শই বেকার থাকছেন। নারীরা শিশুদের নিয়ে শহরের পথে পথে এক ভিন্ন ধরনের ভিক্ষাবৃত্তির আশ্রয় নিয়েছেন। তারা সরাসরি হাত না পেতে পথচারীদের হয়রানি করে টাকা আদায় করেন, যা সাধারণ মানুষের জন্য বিব্রতকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে। এই হয়রানিমূলক ভিক্ষাবৃত্তিতে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন পথচারী ও স্থানীয়রা।
শহরের বায়তুল আমানের বাসিন্দা শামীম রানা বলেন, জনতা ব্যাংকের মোড়ে বেদে নারী ও শিশুদের সব সময় দেখা যায়। রিকশা থেকে নামলেই সবাইকে তারা ঘিরে ধরে টাকা চায়। পরিস্থিতি এমন হয় যে, টাকাটা কেড়ে নিতে চায়। এমন অবস্থায় বাধ্য হয়েই তাদের টাকা দিতে হয়। আসলে এটা পথচারীদের জন্য হয়রানি।
সরকারি রাজেন্দ্র কলেজের অনার্স তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আজুজুল বারি বলেন, বিকেলের দিকে ওদের কলেজে দেখা যায়। এরা আসলে সবাইকেই বিরক্ত করে। মায়া হয় ওদের জন্য, শিশুরা দেখতে খুব অসুস্থ। পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায়ের জন্য আমাদের সবার কিছু করা দরকার, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া এটা সম্ভব না।
মুন্সিবাজারে বসবাসকারী বেদেপল্লির প্রায় ৩০০ মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করছে। তবে মৌলিক নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হওয়ায় অনেকে আবার অপরাধেও জড়াচ্ছে।
এদিকে তাদের এই অবস্থার পেছনে শিক্ষার অভাবকেই প্রধান কারণ হিসেবে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা। এমন পরিস্থিতিতে বেদে শিশুদের জন্য স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘মানুষ মানুষের জন্য’। অন্যদিকে, সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জন্ম নিবন্ধন ও নাগরিকত্ব পেতে তাদের সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন।
বেদে কিশোর সজীব জানায়, সে পোলিও টিকা পায়নি এবং তার জন্মনিবন্ধনও নেই। টিকা না পাওয়ার লক্ষণও তার শরীরে বিদ্যমানÑ গলা উঁচু হয়ে গেছে এবং পা নিচের দিকে চিকন হয়ে গেছে।
পল্লির সর্দারের বউ লাভলী আক্ষেপ করে বলেন, ‘মানুষ যদি দুএকদিন এসে সাহায্য করে তাতে লাভ কী? আমাদের তো দেখার কেউ নাই। আমরা এভাবে কেন থাকব? অনেকে ঘর পাইছে, আমাদেরও তো ঘরবাড়ি দেওয়া দরকার সরকারের। তাহলে ছেলে-মেয়েদের পড়ালেখা করাইতে পারতাম। ভিক্ষা করতে তো ভালা না, কিন্তু পেটের দায়ে করি; অভাবে স্বভাব নষ্ট।’
এমন করুণ পরিস্থিতিতে ‘মানুষ মানুষের জন্য’ নামক একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে এবং ‘প্রজন্মের আলো’ নামে একটি স্কুল স্থাপন করেছে, যেখানে সপ্তাহে তিনদিন বেদে শিশুদের শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে।
সংগঠনটির সভাপতি জাহিদ ইসলাম বলেন, বেদে শিশুরা শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। আমরা ‘প্রজন্মের আলো’ স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছি যাতে তারা শিক্ষার মাধ্যমে একটি সুন্দর জীবনের স্বপ্ন দেখতে পারে। আশা করি, সরকারসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তাদের পাশে দাঁড়াবে, যাতে এই শিশুরা আর কখনো ভিক্ষাবৃত্তি করতে বাধ্য না হয়।
ইউএনও ইসরাত জাহান জানান, যাযাবর বেদে সম্প্রদায় জন্মনিবন্ধন না থাকায় সরকারি সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বর্তমানে শিক্ষা ও মেডিকেল ক্যাম্পের মতো সুনির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা না থাকলেও বেদে সম্প্রদায়ের কল্যাণে তাদের পাশে থাকব। যদি বেদে সম্প্রদায়ের সদস্যরা জন্মনিবন্ধন ও নাগরিকত্ব পেতে আগ্রহী হন, তবে প্রশাসন তাদের সব ধরনের সহযোগিতা করবে।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন