আগামী ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, সামাজিক বিভাজন এবং গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে এই নির্বাচন শুধু রাজনৈতিক দলগুলোর নয়, রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রতিটি অংশের জন্যই একটি বড় পরীক্ষা। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব বহন করছে পুলিশ বাহিনী। কারণ, ভোটের দিনে নাগরিকের নিরাপত্তা, ভোটকেন্দ্রের শৃঙ্খলা ও নির্বাচনের সার্বিক গ্রহণযোগ্যতা অনেকাংশে নির্ভর করবে পুলিশের ভূমিকার ওপর।
গত এক যুগে দেশের নির্বাচনি ইতিহাসে পুলিশের ভূমিকাকে ঘিরে বহু প্রশ্ন উঠেছে। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলোয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একটি অংশকে দলীয় প্রভাবিত হিসেবে দেখা গেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। সেই অভিজ্ঞতা থেকে জনগণের মধ্যে পুলিশের প্রতি আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে, যা ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের সময় আরও প্রকট হয়। এই প্রেক্ষাপটে বলা যায়, আসন্ন নির্বাচনে পুলিশ বাহিনীর সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে নিজের হারানো বিশ্বাস ও নিরপেক্ষতার ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার করা।
অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে এবার যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে তা সময়োপযোগী। এরমধ্যে দেড় লাখ পুলিশ সদস্যকে নির্বাচনি দায়িত্ব পালনের প্রশিক্ষণ প্রদান, এটি নিঃসন্দেহে ইতিবাচক পদক্ষেপ। নির্বাচনের আচরণবিধি, ভোটারের অধিকার, গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ, ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তা, এসব বিষয়ে পুলিশ সদস্যদের প্রশিক্ষণ একটি পেশাদার ও শৃঙ্খল বাহিনী গড়ে তুলতে সহায়ক হবে। তবে প্রশিক্ষণই যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন সদিচ্ছা, নীতিনিষ্ঠ নেতৃত্ব এবং বাস্তবক্ষেত্রে নিরপেক্ষ আচরণের নিশ্চয়তা।
পুলিশের নিরপেক্ষতা কেবল একটি সংস্থার বিষয় নয়, এটি গোটা রাষ্ট্রব্যবস্থার নৈতিকতার প্রতিফলন। সরকারের সদিচ্ছা না থাকলে কোনো বাহিনীই পেশাদারিত্ব ধরে রাখতে পারে না। তাই অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আমাদের প্রত্যাশা, পুলিশ যেন কোনো চাপে না পড়ে, কারো নির্দেশে না চলে। কারণ, একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন মানে কেবল ভোটের আয়োজন নয়, এর মানে হচ্ছে নাগরিকের আস্থা পুনরুদ্ধার, গণতন্ত্রের প্রতি বিশ্বাস ফিরিয়ে আনা।
এক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আরেকটি বড় দায়িত্ব হলো নির্বাচনের সময় ও আগে সম্ভাব্য সহিংসতা প্রতিরোধ করা। লুণ্ঠিত ও অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে পুলিশের গাফিলতি মারাত্মক পরিণতি ডেকে আনতে পারে। এই অস্ত্র যদি রাজনৈতিক সহিংসতায় ব্যবহার হয়, তবে তা শুধু নির্বাচন নয়, রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতার জন্যও হুমকি। তাই এখনই প্রয়োজন কঠোর অভিযানে নেমে এসব অস্ত্র উদ্ধার করা এবং সহিংসতার উৎসগুলো শনাক্ত করা।
পুলিশ বাহিনীকে মনে রাখতে হবে, তাদের প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব হলো জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, কোনো রাজনৈতিক দলের সেবায় নয়। নির্বাচন কমিশনের অধীনে থেকে আইন ও বিধি অনুযায়ী দায়িত্ব পালন করাই তাদের কর্তব্য। মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদেরও নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করতে হবে। কারণ তাদের আচরণেই ভোটারদের আস্থা গড়ে ওঠে বা ভেঙে পড়ে।
আসন্ন নির্বাচনে জনগণ এমন একটি পরিবেশ দেখতে চায়, যেখানে ভোটাররা নিরাপদে কেন্দ্রে যেতে পারেন, প্রার্থীরা সমান সুযোগ পান এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রকৃত অর্থে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করে। পুলিশ যদি সৎ, পেশাদার ও ন্যায্য আচরণ করে তবে শুধু নির্বাচন নয়, গণতন্ত্রও হবে আরও শক্তিশালী।
আমরা মনে করি, বিগত সরকারের আমলে পুলিশের যে ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হয়েছে তা পুনর্গঠনের সুবর্ণ সুযোগ এই নির্বাচন। বাহিনীর প্রত্যেক সদস্যকে বুঝতে হবে, তাদের পেশাগত দায়িত্ব কোনো দলের নয়, রাষ্ট্রের প্রতি। এই রাষ্ট্রই তাদের বেতন দেয়, এই জনগণই তাদের ওপর আস্থা রাখে। তাই তাদের প্রথম দায়িত্ব জনগণের নিরাপত্তা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা।
বাংলাদেশের ইতিহাসে বহু নির্বাচন গেছে, বহু সরকার এসেছে-গেছে। কিন্তু জনগণের স্মৃতিতে থেকে যায় কেবল সেই প্রতিষ্ঠানগুলো, যারা সংকটের সময় নৈতিক দৃঢ়তা দেখাতে পেরেছে। পুলিশ যদি এ নির্বাচনে নিরপেক্ষ, ন্যায়পরায়ণ ও পেশাদার আচরণ প্রদর্শন করতে পারে, তবে তারা কেবল একটি নির্বাচনের নয়, পুরো জাতির আস্থা পুনরুদ্ধার করবে।
আমরা আশা করব, আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পুলিশ থাকবে তার দায়িত্বের উচ্চতম জায়গায়, অরাজনৈতিক, পেশাদার ও জনগণনির্ভর। নির্বাচন হোক শান্তিপূর্ণ, অবাধ ও সুষ্ঠু এবং তার প্রথম শর্ত হোক নিরপেক্ষ পুলিশের ভূমিকা।

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন