দক্ষিণ চট্টগ্রামে মাদকবিরোধী অভিযানের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারাই এখন মাদক সিন্ডিকেটের অংশ, এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য উন্মোচিত হয়েছে সম্প্রতি। র্যাব-৭-এর হাতে প্রায় দুই কোটি টাকার ইয়াবাসহ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) এক সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) আটক হওয়ার পর নতুন করে আলোচনায় এসেছে পটিয়া ও আশপাশের এলাকায় সরকারি দায়িত্বে থাকা কিছু কর্মকর্তার ভূমিকা।
ইয়াবাসহ আটক ডিএনসি কর্মকর্তা: গত শনিবার সকালে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের ভাইয়ার দিঘি এলাকায় র্যাব-৭-এর একটি বিশেষ অভিযানে আটক হন ডিএনসি কর্মকর্তা মো. আবদুল্লাহ আল মামুন (৪১)। তিনি পটিয়ার মোজাফফরাবাদে ‘চট্টগ্রাম খ সার্কেল’-এর অধীনে সহকারী উপপরিদর্শক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
অভিযানে উদ্ধার হয় ৬০ হাজার ইয়াবা ট্যাবলেট, যার বাজারমূল্য প্রায় ১ কোটি ৮০ লাখ টাকা এবং নগদ ২ লাখ ৪৩ হাজার টাকা। এ সময় আরও চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
র্যাব জানায়, কক্সবাজার থেকে মাদক পরিবহনের সময় মামুন ডিএনসির অফিসিয়াল জ্যাকেট, ক্যাপ ও ওয়াকিটকি ব্যবহার করতেন, যাতে কেউ সন্দেহ না করে। দীর্ঘদিন ধরে তিনি স্থানীয় মাদক কারবারিদের সঙ্গে ‘রক্ষাকারী’ সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন।
গোপন তথ্যের ভিত্তিতে র্যাব-৭ ভাইয়ার দিঘিতে দুটি মাইক্রোবাসে অভিযান চালিয়ে ইয়াবাগুলো উদ্ধার করে।
এই প্রতিবেদকের অনুসন্ধানে সরেজমিনে পটিয়ার মোজাফফরাবাদে অবস্থিত মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ‘খ সার্কেল’ অফিসে গিয়ে জানা যায়, পুরো দক্ষিণ চট্টগ্রামের এই সার্কেলের কার্যক্রম পরিচালিত হতো মাত্র সাতজন কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়ে। এর মধ্যে একজন এসআই, দুইজন এএসআই এবং চারজন কনস্টেবল।
গ্রেপ্তার হওয়া এএসআই আবদুল্লাহ আল মামুন প্রায় পাঁচ-ছয় বছর ধরেই একই অফিসে কর্মরত ছিলেন। অফিসের অভ্যন্তরীণ সূত্রে জানা গেছে, তিনি প্রায়ই অসুস্থতার অজুহাতে মাসের পর মাস অনুপস্থিত থাকতেন, অথচ সেই সময়েই মাদক পরিবহনের কাজে জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ।
অফিসের ইনচার্জ একে আজাদ বিষয়টি জানলেও তা গোপন রাখতেন এবং কোনো প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেননি।
তদন্তে জানা যায়, যেদিন র্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হন আবদুল্লাহ, সেদিনই অফিস ইনচার্জ একে আজাদের সঙ্গে তার ফোনে কথোপকথন হয়।
সূত্র জানায়, আজাদ বিষয়টি আগেই জানতেন, কিন্তু তিনি নিজের অবস্থান রক্ষায় নীরব ভূমিকা নেন। এ কে এম আজাদ উদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘আবদুল্লাহ অসুস্থতার কথা বলে অনেক দিন অফিসে আসতেন না। মাঝে মাঝে আসতেন, কিন্তু নিজের মতো অভিযান পরিচালনা করতেন। আমাকে বিস্তারিত কিছু জানাতেন না।’
এদিকে এই ঘটনার পর গত সোমবার মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর থেকে আবদুল্লাহ আল মামুনকে তাৎক্ষণিকভাবে ক্লোজ করা হয় এবং একটি তদন্ত টিম গঠন করা হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে সংস্থার এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা।
দক্ষিণ চট্টগ্রামের ‘মাদক হটস্পট’ ও সরকারি যোগসাজশ: পটিয়া, আনোয়ারা, বাঁশখালী, লোহাগাড়া ও সাতকানিয়াÑ এই পাঁচ উপজেলা কক্সবাজার সীমান্তবর্তী হওয়ায় দীর্ঘদিন ধরেই মাদক প্রবাহের প্রধান রুট হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, ‘বড় খেলোয়াড়দের’ আড়াল করে ক্ষুদ্র কারবারিদের ধরা হয়, ফলে মাদকচক্রের মূল নেটওয়ার্ক অক্ষত থাকে।
একাধিক সূত্র জানায়, কিছু অসাধু সরকারি কর্মকর্তা স্থানীয় মাদক সিন্ডিকেটের কাছ থেকে নিয়মিত সুবিধা নিয়ে রুট ও চালান নিরাপদ রাখতেন। আব্দুল্লাহ আল মামুনের ঘটনা সেই অভিযোগেরই প্রমাণ বহন করছে।
পটিয়া উপজেলার সাধারণ মানুষের মধ্যে এ ঘটনায় তীব্র ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দা সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘যারা মাদক দমন করবে, তারাই যদি চালান পাহারা দেয়, তাহলে দেশের ভবিষ্যৎ কোথায়?’
স্থানীয় সচেতন নাগরিকদের ভাষ্য মতে, এটি শুধু একজন কর্মকর্তার দুর্নীতি নয়, বরং দক্ষিণ চট্টগ্রামের মাদকবিরোধী প্রশাসনের ভেতরের অভ্যন্তরীণ গলদ ও যোগসাজশের এক ভয়াবহ উদাহরণ। তদন্তে যদি সরকারি কর্মকর্তাদের নেটওয়ার্ক উন্মোচিত হয়, তবে আইনশৃঙ্খলা ও মাদক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থা ফেরাতে বড় পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন