দেশব্যাপী বিএনপির প্রার্থী ঘোষণার পর সিলেটে খুব একটি প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। তবে আস্তে আস্তে মনোনয়নপ্রত্যাশী ও তাদের সমর্থকরা মনোনয়ন রিভিউয়ের দাবি নিয়ে সক্রিয় হয়ে উঠছেন। তারা এই দাবিতে নীরবে কাজ করছেন কোথাও। কোথাও নেমে আসছেন রাজপথে। করছেন সভা-সমাবেশ। দেখাচ্ছেন নিজেদের জনসমর্থন। ঘোষিত প্রার্থী ছাড়াও মনোনয়নপ্রত্যাশীরা অব্যাহত রেখেছেন জনসংযোগ। এ নিয়ে তুমুল আলোচনায় জৈন্তাপুর, কোম্পানীগঞ্জ ও গোয়াইনঘাট উপজেলা নিয়ে গঠিত সীমান্তঘেঁষা আসন সিলেট-৪। আসনটি ভারত-বাংলাদেশের স্থলবন্দর, আমদানি-রপ্তানির গুরুত্বপূর্ণ রুটে অবস্থিত। পর্যটনসমৃদ্ধ এবং বালু ও পাথরমহালের জন্য বিখ্যাত হওয়ায় আসনটি আলোচিত। অনেকের কাছে লোভনীয়ও। এ ছাড়া মাদক, গবাদি পশুসহ সীমান্ত চোরাচালানের বৃহত্তর রুট হওয়ায় এর আলাদা গুরুত্ব রয়েছে বিশেষ মহলে। কওমি মাদ্রাসা অধ্যুষিত ও ২৪ পরগনাশাসিত হলেও সেখানে প্রার্থিতার দৌড়ে সব সময়ই আলেমদের চেয়ে বিএনপি বা আওয়ামী লীগের নেতারা এগিয়ে থাকেন এবং ভোটের মাঠে লাভবান হন। তারাই বরাবর জয়ী হয়ে আসেন। আলেমরা সেখানে পালে হাওয়া পান না।
সিলেটে যে কয়টি আসনে বিএনপির সবচেয়ে বেশি মনোনয়নপ্রত্যাশী, তার মধ্যে শীর্ষে এটি। এখানকার বাসিন্দা নন, এমন একাধিক প্রার্থীও সেখান থেকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার আকাক্সক্ষা প্রকাশ করেন। এ জন্য অবশ্য স্থানীয় কোনো উল্লেখযোগ্য প্রার্থী না থাকার বিষয়টি মুখ্য ভূমিকা পালন করে। এ আসনে আওয়ামী সরকারের পতনের পর প্রথমে প্রার্থিতার আশায় গণসংযোগ শুরু করেছিলেন সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রাক্তন মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। পরবর্তীতে তিনি সেখানে প্রার্থী হবেন না বলে সেই এলাকা বাদ দিয়ে সিলেট-১ এর মনোনয়ন পেতে তদবির শুরু করেন। এ সময় তিনি একটি অনুষ্ঠানে সিলেট-১-এ তাকে মনোনয়ন দিতে দলের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেছিলেন, সিলেট-১ দেন, না হয় সিলেট সিটি করপোরেশনে মেয়র পদে তাকে মনোনয়ন দিতে হবে। তার এমন বক্তব্য ও সিলেট-৪ থেকে ফিরে আসার পর সেই আসনে এসে নাম লেখান তারই বন্ধু ও সাবেক মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক বদরুজ্জামান সেলিম, বিএনপির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক মিফতাহ সিদ্দিকী, সাবেক এমপি দিলদার সেলিমের স্ত্রী অ্যাডভোকেট জেবুন্নাহার সেলিম।
তাদের বাইরে বিএনপি থেকে মনোনয়ন চাইছেন সিলেটের আলোচিত মুখ ও বিএনপির একসময়কার প্রভাবশালী নেতা অ্যাডভোকেট শামসুজ্জামান জামান। আরিফ ছাড়া তারাই সিলেট-৪-এ মনোনয়ন পাওয়ার জন্য ঢাকায় দলের মহাসচিবের সাথে বৈঠক করেন। ওই বৈঠকে সিলেট-১-এ মনোনয়নের জন্য অংশ নেন আরিফুল হক চৌধুরী। সিলেটে ফিরে তিনি হযরত শাহজালাল রহ.-এর মাজার জিয়ারতের মাধ্যমে ঘটা করে দলীয় মনোনয়ন লড়াইয়ে নিজের যুদ্ধের কথা জানান। বিশাল শোভাযাত্রা করেন সিলেট শহরে। তাতে বিপুল উপস্থিতি ও জনসর্থন দেখে মসনদ নড়ে ওঠে খন্দকার মুক্তাদিরের। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়াও জানানো হয় তার বলয় থেকে। এমনকি তিনি নিজেও একটি ভিডিওতে এ নিয়ে মন্তব্য করেন।
জানানো হয়, সিলেট-১ থেকে বিএনপির প্রার্থী একজনই। আর তিনি খন্দকার আব্দুল মুক্তাদির চৌধুরী। অবশেষে তা-ই হয়। দলীয় মহাসচিব সিলেট-১-এ তার নাম ঘোষণা করার পর চুপসে যান আরিফুল হক চৌধুরী। পরবর্তীতে আরিফ বলয় থেকে দাবি করা হয়, বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া তাকে ডেকে নিয়ে সিলেট-৪-এ প্রার্থী হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। এ জন্য তিনি সিলেট-৪-এ বিএনপির প্রার্থী হওয়ার সম্মতি দিয়েছেন। সিলেটে ফিরে নেমে পড়েন সিলেট-৪ আসনে নির্বাচনি জনসংযোগে। তার এমন ঘোষণায় অনেকে সন্দেহ প্রকাশ করেন। দলের পক্ষ থেকে এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু না জানানোয় আসলেই আরিফ সিলেট-৪-এ মনোনয়ন পাচ্ছেন কি না এ নিয়ে সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে। অনেক প্রার্থী প্রকাশ্যে এ নিয়ে কথাও বলছেন। কয়েক দিন তারা নীরব থাকলেও আবারও তারা তাদের সমর্থক নিয়ে মাঠে নেমে পড়েছেন। নিজেদের পক্ষে জনসমর্থন বাড়াতে এবং মনোনয়ন নিশ্চিত করতে চেষ্টা করছেন।
মাঠে আছেন আরিফুল হক চৌধুরীও। নিয়মিত গণসংযোগ করছেন মিফতাহ সিদ্দিকী, অ্যাডভোকেট শামসুজ্জামান জামান। রোববারও কোম্পানীগঞ্জ থানাবাজারে লিফলেট বিতরণ ও গণসংযোগ করেন বিএনপির নির্বাহী কমিটির সহসাংগঠনিক সম্পাদক ও সিলেট-৪ আসনের ধানের শীষের পদপ্রার্থী মিফতাহ সিদ্দিকী। গতকাল সোমবার গণসংযোগ করেছেন অ্যাডভোকেট শামসুজ্জামান জামান। তারা এ আসনে বিএনপি কোনো প্রার্থী এখনো ঘোষণা না করে উন্মুক্ত রেখেছে দাবি করে মাঠ না ছেড়ে নিজের পক্ষে জনমত তৈরির চেষ্টা করছেন। তবে মাঠ ছেড়ে দিয়েছেন সাবেক মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক বদরুজ্জামান সেলিম।
এদিকে সিলেট-৩ (দক্ষিণ সুরমা ও ফেঞ্চুগঞ্জ)-এও প্রার্থী মনোনয়ন রিভিউয়ের দাবি জানিয়েছেন বিএনপির নেতাকর্মীরা। যদিও এখানকার কোনো প্রার্থী সভা-সমাবেশ না করে কেন্দ্রে লবিং করছেন। বিএনপির একাধিক সূত্র থেকে বলা হচ্ছে, এ আসনে প্রার্থী রিভিউয়ের বিষয়টি বেশ জোর পেয়েছে। সেই তালিকায় আছে গোলাপগঞ্জ ও বিয়ানীবাজার উপজেলা নিয়ে গঠিত সিলেট-৬ সংসদীয় আসনও।
তবে সবচেয়ে বিক্ষোভমুখর আসন সুনামগঞ্জ-৫। এটি ছাতক ও দোয়ারাবাজার উপজেলা নিয়ে গঠিত। বিএনপি এখানে তাদের প্রার্থী হিসেবে নাম ঘোষণা করে সাবেক এমপি কলিম উদ্দিন মিলনের। তবে স্থানীয়দের একটি বড় অংশ সেটি মেনে নিতে পারছেন না। বিশেষ করে ছাতকের বিএনপির একটি অংশ চাইছে এ আসনে প্রার্থী হোন মিজানুর রহমান চৌধুরী। যিনি ছাতক উপজেলা পরিষদের প্রাক্তন চেয়ারম্যান। তারা রিভিউ চাচ্ছেন জোরেশোরে। সুনামগঞ্জ-৫ আসনে প্রার্থী রিভিউয়ের দাবিতে গত রোববার রাস্তায় নেমে আসেন তারা। স্থানীয় গোবিন্দগঞ্জে বিশাল মিছিল ও সমাবেশ করেন তার পক্ষের নেতাকর্মীরা। সেখানে অংশ নেন বিএনপি, যুবদল ও ছাত্রদলের বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী।
অবশ্য দলের একটি সূত্র জানিয়েছে, ঘোষিত প্রার্থীরা চূড়ান্ত নন। সারা দেশের মতো সিলেটের একাধিক আসনেও রিভিউ হবে। প্রার্থী পরিবর্তনও হতে পারে। এমনকি সিলেট-৪ আসন সমঝোতার জন্য ছেড়েও দেওয়া হতে পারে। ইতিমধ্যে সিলেট-৫ আসন ছেড়ে দেওয়ার আলোচনা চলছে। এ জন্য সেটিতে বিএনপি কোনো প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেনি।

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন