দেশজুড়ে যে সবুজ বিপ্লব ছড়িয়ে দিয়েছিলেন জিয়াউর রহমান, সেই পথে হাঁটতে গিয়ে প্রতিপক্ষের রোশানলের শিকার হয়েছেন তারেক রহমান। আজকের অবস্থানে আসতে তাকে শুধু কাঠখড় নয়, নিজেকেও পোড়াতে হয়েছে। তার কমান্ডিং ভয়েস পিতা জিয়াউর রহমানের কথা মনে করিয়ে দেয়। মানুষের ভাগ্য আর রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তনই তারেক রহমানের লক্ষ্য বলে মনে করেন দলটির নেতারা।
এক ট্র্যাজিক হিরো হিসেবে সাধারণ মানুষের মুখে আজও উচ্চারিত হয় শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের নাম। তার বড় ছেলে তারেক রহমান এখন তারই গড়া দল বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। পিতা-পুত্রের মধ্যে রয়েছে অদ্ভুত এক মিল, নির্বাসিত জীবনে প্রতিকূলতার সঙ্গে বছরের পর বছর যুদ্ধ করছেন তারেক রহমান।
বাবা রাষ্ট্রপতি এবং মা প্রধানমন্ত্রী। পৃথিবীতে বিরল সৌভাগ্যের প্রতীক হলেও ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ এক জীবন তার। নির্বাসিত জীবনেও দেশ, জনগণ ও দলের নেতাকর্মীদের ঘিরেই তার ব্যক্তিগত জীবন। ১৯৬৫ সালের ২০ নভেম্বরে জন্ম নেওয়া তারেক রহমানের রাজনীতিতে পথচলা শুরু ১৯৮৮ সালে বগুড়ার গাবতলী থানা বিএনপির সদস্যপদ গ্রহণের মধ্য দিয়ে। ২০০২ সালে দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব আর ২০০৯ সালে দলের পঞ্চম কাউন্সিলে সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন তিনি।
বাংলাদেশের প্রতিটি জাতীয় নির্বাচনের আগে যেভাবে বিভিন্ন ইস্যুতে রাজনীতির মাঠ গরম হতে দেখা যায়, ২০০১-এর নির্বাচনের আগে আন্দোলন করার জন্য বিএনপির সামনে তেমন কোনো বড় রাজনৈতিক ইস্যু ছিল না। ঠিক তখনই তরুণ নেতৃত্ব ও দলের কর্মকা-ে গতি আনার নামে ৩৪ বছর বয়সি তারেক রহমান রাজনীতির ময়দানে ঢোকেন। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করে দলকে যে গতি দিতে চেয়েছিলেন; তখনই প্রতিপক্ষের বাঁকা চোখে পড়েন তিনি। পিতার দেখানো পথে হাঁটতে চেয়েছেন তারেক রহমান।
ক্ষমতা ছাড়ার পর ২০০৭ সালে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় এলে দুর্নীতির অভিযোগে তারেক রহমানকে আটক করা হয়। দুর্নীতি, অবৈধভাবে বিদেশে অর্থ পাচার ও চাঁদাবাজির অভিযোগে তার বিরুদ্ধে ১৫টি মামলাও দায়ের হয়। সে সময় তাকে নির্যাতন করে মেরুদ-ের হাড় ভেঙে দেওয়া হয়েছে বলে বিএনপি অভিযোগ করে আসছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় সব মামলায় জামিন নিয়ে তিনি ‘চিকিৎসার জন্য’ লন্ডনে যান। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর একাধিক মামলায় তার জামিন বাতিল করে পলাতক দেখিয়ে বিচারকাজ শুরু করে। তবে বহুল আলোচিত অর্থ পাচার মামলায় নি¤œ আদালতে তারেক বেকসুর খালাস পান।
শাহীন স্কুল অ্যান্ড কলেজে পড়াশোনায় হাতেখড়ি তারেক রহমানের। ঢাকা রেসিডেনসিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসি এবং আদমজী ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। নির্বাসিত জীবনে আইন নিয়ে উচ্চতর ডিগ্রি গ্রহণ করেন তারেক রহমান।
তারেক রহমান যখন রাজনীতে পা রাখেন, তখন থেকেই দেশের তরুণেরা তার প্রতি আকৃষ্ট হতে থাকেন। তারেক রহমান নিজেই তার গাড়ি চালাতেন আর তার চারপাশে সমর্থকদের ঘিরে থাকার দৃশ্য খুবই সাধারণ হয়ে ওঠে। বাবার মতোই গাড়ি থেকে বাইরের লোকজনের উদ্দেশে হাত নাড়তে দেখা যেত তাকে। তার সমর্থকেরা তাকে ঘিরে স্লোগান দিতেনÑ ‘তারেক তুমি এগিয়ে চলো, আমরা আছি তোমার সাথে’, ‘মোদের নেতা তারেক জিয়া’। এই স্লোগানের মাধ্যমেই তারেক রহমানের নামের শেষে ‘রহমান’ বদলে দিয়ে ‘জিয়া’ ব্যবহার করতে শুরু করেন মানুষ। তারেক রহমান নিজের পরিচয়ে বড় হতে চেয়েছিলেন। ফলে তারেক রহমান হিসেবেই নিজের পরিচয় দিতে থাকেন।
একদিন হঠাৎ করেই গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় গিয়ে বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে শ্রদ্ধা জানিয়ে আসেন তারেক রহমান। একে বাংলাদেশের রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তনের ইঙ্গিত হিসেবে ধরে নিয়ে সে সময় ভূয়সী প্রশংসাও কুড়িয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার ১/১১ সরকারের ধারাবাহিকতা বজায় রেখে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে মামলার জাল বিছিয়ে দেয়। একের পর এক সাজা দিয়ে তার নির্বাসিত জীবন দীর্ঘস্থায়ী করে বলেই মনে করেন বিএনপি নেতারা।
২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি ষড়যন্ত্রমূলক রায়ে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কারাদ- হওয়ার পর কার্যত দলের শীর্ষ নেতৃত্বে আসীন হন তারেক রহমান। বরাবরই রাজনীতিতে তারেক রহমান ভিন্ন আলোয় উজ্জ্বল। বিশেষ করে পিতা মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সমরসৈনিক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের স্বপ্নচারী রাষ্ট্রকল্পনা এবং মা সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ‘আপসহীন রাজনীতির’ যৌথ সমন্বয়ের নবতর সংযোজন এনেছেন তিনি। এই বিন্যাস ধীরে ধীরে আরও শক্তিমান হয়ে উঠছে বিগত বছরগুলোয়।
সবশেষ ২০২৩ সালের জুলাইয়ে তিনি অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা ও দীর্ঘ মতবিনিময়ের পর রাখলেন আলোচিত ৩১ দফা; বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে বিনির্মাণের নতুন এক ইশতেহার ৩১ দফা, যা ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রনায়ক তারেক রহমানের পক্ষ থেকে ঘোষণা করেছিলেন মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, সঙ্গে ছিলেন স্থায়ী কমিটির সংগ্রামী কয়েকজন সদস্যও।
২০২২ সালে যখন যুগপৎ আন্দোলনের মাঠ তৈরিতে ব্যস্ত বিএনপির সিনিয়র নেতারা, তখনই দলের শীর্ষ নেতা তারেক রহমানের অঙ্গীকার ছিল, ভবিষ্যতে তিনি জাতীয় সরকার গঠনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে পরিচালিত করার স্বপ্ন দেখেন। সাক্ষাৎকারে তিনি যুগপৎ সঙ্গীদেরও তুলে ধরলেন এই ভাষায়, ‘প্রায় ৬৪টি রাজনৈতিক দল বিগত স্বৈরাচারের সময় যার যার অবস্থান থেকে রাজপথে আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করেছে। আমরা চেষ্টা করেছিলাম কমবেশি একসঙ্গে কাজ করার জন্য।’
উপমহাদেশের ইতিহাসে এত বেশি দিন নির্বাসিত জীবনযাপন করে একটি জনপ্রিয়তম দলকে নেতৃত্ব দেওয়ার যে ঐতিহাসিক চরিত্র, তারেক রহমান তাদের মধ্যে একজন। নেলসন ম্যান্ডেলা ২৭ বছর নির্বাসিত ছিলেন; গ্রিসের সাবেক প্রধানমন্ত্রী জর্জ পাপান্দ্রেউ নির্বাসিত ছিলেন কয়েক বছর; আমাদের প্রতিবেশী ভারতের রাহুল গান্ধী ছিলেন কিছু সময় নির্বাসনে; পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টো, সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানও নির্বাসনে ছিলেন। অতি সম্প্রতি সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফও ছিলেন লন্ডনে নির্বাসিত। নির্বাসনে ছিলেন ইরানের জাতীয় নেতা প্রয়াত খোমেনিও।
বিএনপির এই শীর্ষ নেতা ১৭ বছর ধরে নির্বাসনে। কিন্তু তার পুরো সময় অতিবাহিত হচ্ছে বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে, রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ নির্মাণের কার্যক্রমে। সম্প্রতি ব্রিটিশ একটি গণমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি নিজেই উল্লেখ করেন, ‘শারীরিকভাবে হয়তো ব্রিটেনে আছি, কিন্তু মন-মানসিকতা সবকিছু মিলিয়ে আমি ১৭ বছর ধরে বাংলাদেশেই রয়েছি।’ তারেক রহমান দলের ভেতরে দুর্নীতি ও অনৈতিকতার বিরুদ্ধে কঠোর নির্দেশনা দিয়েছেন। তিনি শিগগিরই দেশে ফিরে আসবেন এবং দলের সংস্কার করবেন।
তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠ সহচর ও তার উপদেষ্টা ড. মাহদী আমিন রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘নির্বাসিত জীবনে তার মধ্যে ছিল না উচ্চাভিলাষ। দেশের মাটি ও মানুষের কল্যাণেই কাজ করতে চান তিনি। নতুন প্রজন্মের নতুন ভাবনায় দেশের সামাজিক-অর্থনৈতিক কাঠামো বদলের মাধ্যমেই করতে চান দেশের মানুষের ভাগ্যবদল। বিদেশে থাকলেও ঘুম ছাড়া বাকি সময় দেশের মানুষকে নিয়েই ভাবেন তিনি। দলের নেতাকর্মীরাই তার ঘর-সংসার। নির্বাসিত জীবনে তার পুরোটা সময় কেটেছে দেশ ও দেশের মানুষের কথা চিন্তা করে, ভবিষ্যতের ভাবনা-পরিকল্পনা সাজিয়। দেশের মাটি ও মানুষের কল্যাণে বিএনপির বিপুল সাংগঠনিক শক্তিকে কাজে লাগাতে চান তিনি। জনগণের ভোটে ক্ষমতায় গেলে প্রধানমন্ত্রী হবেন তারেক রহমান।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. মোশাররফ হোসেন রূপালী বাংলাদেশকে জানান, জন্মদিনে চাকচিক্য নয়, মানুষের পাশে থাকতে চান তারেক রহমান। জিয়াউর রহমানের পথ অনুসরণ করে দেশের মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে কাজ করতে চান।’
বিএনপির এই ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দেশে ফেরা এখন সময়ের অপেক্ষামাত্র। তার দেশে ফেরার অপেক্ষায় এখন উন্মুখ হয়ে আছে দলের লাখো নেতা-কর্মী এবং সাধারণ জনগণ।

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন