জনশ্রুতি মতে, পরিবেশদূষণে অন্যতম দায়ী খাত হচ্ছে অট্টালিকা বা বহুতল ভবন নির্মাণ। বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে বিপুল অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে সর্বত্রই ফ্ল্যাট বিক্রি অবারিত। নগর-শহর ও গ্রামীণ জনপদের এই ব্যবসা রমরমা অবস্থানে পৌঁছেছে। বিভিন্ন খ্যাতিশীর্ষ এলাকায় এত উচ্চ দামের ফ্ল্যাট কারা কিনছে? এর কোনো পরিসংখ্যান কী সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে আছে? বিশাল ব্যয়ের বিনিময়ে এই অনুৎপাদনশীল খাত কাদের উপকারে আসছে তা কিন্তু বোধগম্য নয়। এই আবাসন শিল্প নগরের সাবলীল জীবন প্রবাহকে পাথরে ঢেকে দিচ্ছে। সবুজ প্রকৃতির বিপরীতে ইট-পাথরের গাঁথুনি যারপরনাই নগরজীবনকে করছে অভিশপ্ত। ক্ষুদ্রায়তনের বাংলাদেশে ভবিষ্যতে নীল আকাশ দেখা কষ্টকর হয়ে যাবে। বৃক্ষনিধন-জলাশয় ভরাট করে এসব নির্মাণ কাজে ভূমি ব্যবহৃত হচ্ছে। অপরিকল্পিত নগরায়ণের প্রভাবে দিন দিন অট্টালিকা নির্মাণ বৃদ্ধির বিপরীতে কমে আসছে সবুজ এলাকা ও উন্মুক্ত স্থান। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্লানার্সের (বিআইপি) ২০১৯ সালের গবেষণায় বলা হয়, ঢাকার মোট আয়তনের ৮১ দশমকি ৮২ শতাংশই কংক্রিট আচ্ছাদিত। বাকি এলাকায় ৯ দশমিক ২ শতাংশ সবুজ আচ্ছাদিত, ৪ দশমিক ৬১ শতাংশ উন্মুক্ত স্থান এবং ৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ জলাভূমি। গাছপালা থাকা এলাকার হিসাবে এর পরিমাণ হবে আরও কম।
অপর এক গবেষণায় দেখা যায়, ঢাকায় ১৯৯৯ সালে সবুজ আচ্ছাদন ছিল ৮ দশমিক ৯৭ বর্গকিলোমিটার। ওই বছর রাজধানীর ৬ দশমিক ৬৯ শতাংশ এলাকা ছিল বৃক্ষ আচ্ছাদিত। পরের এক দশকে পরিস্থিতির উন্নতি হয়ে ২০০৯ সালে সবুজ আচ্ছাদন পাওয়া যায় ১২ দশমিক ৪৫ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে। বছরটিতে রাজধানীর আয়তনের ৯ দশমিক ২৯ শতাংশ জায়গায় গাছের উপস্থিতি নজরে আসে। কিন্তু পরের এক দশকে পরিস্থিতির অবনতি হতে থাকে। গবেষণা অনুযায়ী, যেকোনো শহর এলাকায় কংক্রিটের শতকরা হারের পরিমাণ হওয়া উচিত ৪০ শতাংশ, যা সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে। এছাড়া ২৫ শতাংশ সবুজ, ১৫ শতাংশ জলজ ও ১০ শতাংশ খোলা জায়গা থাকা একান্ত বাঞ্ছনীয়। প্রাসঙ্গিকতায় বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্লানার্সের (বিআইপি) সভাপতি ও নগর পরিকল্পনাবিদ গণমাধ্যমে বলেন, ‘রাজধানী ঢাকার বেশ কয়েকটি এলাকায় প্রয়োজনের তুলনায় জলজ ভূমি ও সবুজ এলাকার পরিমাণ শূন্যের কোঠায় নেমে আসার পাশাপাশি বেড়েছে কংক্রিটের আচ্ছাদন। যা ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বর্তমানে এমন অবস্থা হয়েছে, এতে আর একটি ইটের ভার বহনেরও ক্ষমতা নেই ঢাকার।’ এমন পরিস্থিতি দেশের প্রায় সকল নগর-শহরেই বিরাজমান।
ইট-কংক্রিটের অবকাঠামো বৃদ্ধি, গাছপালা ও জলাধার কমে যাওয়ায় সবুজের সমারোহ বিলীন হয়ে ক্রমেই ধূসর হচ্ছে শহরগুলো। কংক্রিটের শহরগুলোতে বাড়ছে তাপমাত্রা। সাম্প্রতিক সময়ে তাপমাত্রা বৃদ্ধিজনিত কারণে নাগরিক জীবন ওষ্ঠাগত। ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানের ২০১৭ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বায়ুম-লীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) জরিপ পরিচালনা করে। তাদের এপ্রিলের কয়েক দিনের তাপমাত্রা পার্থক্য মূল্যায়ন গবেষণা অনুসারে গত পাঁচ বছরের তুলনায় এ বছর ৪ ডিগ্রি পর্যন্ত তাপমাত্রা বেড়েছে। ঢাকা শহরের যেসব এলকায় সবুজের উপস্থিতি রয়েছে সেখানে তাপমাত্রা তুলনামূলক কম। আবহাওয়াবিদ ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের মতে, ‘ঢাকা একটি জনবহুল শহর। এখানে বিপুল মানুষের জায়গা ও কর্মসংস্থান করতে গিয়ে প্রচুর অবকাঠামো গড়ে তোলা হয়েছে। গাছপালা কমেছে। গরম থেকে বাঁচতে মানুষ এসি ব্যবহার করছে। এই শহরে তাপমাত্রা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে অন্যতম দায়ী গায়ে গায়ে লেগে থাকা ভবন-অবকাঠামো। খোলা জায়গা নেই বললেই চলে। ভবনগুলো এত কাছাকাছি নির্মিত যাতে বায়ু চলাচল করতে পারে না।’
উন্মুক্ত পরিবেশে অট্টালিকার নির্মাণসামগ্রী রেখে পরিবেশদূষণের মাত্রাকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। মাসের পর মাস ধরে নির্মাণকাজ চলাকালে সিমেন্ট-বালি-ভাঙা ইটের গুঁড়ো-মাটির অংশবিশেষ বাতাসে মিশে দূষণ ছড়াচ্ছে। ত্রিপল-পলিথিন দিয়ে নির্মাণ সামগ্রী ঢেকে রেখে, ইট ও পাথরে পানি ছিটিয়ে, সিমেন্ট ব্যবহারের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করে নির্মাণ কাজ করার বিধান থাকলেও অনেকের বিরুদ্ধে তা না মানার অভিযোগ রয়েছে। ভূ-গর্ভস্থ পানি সঞ্চয়ে বৃষ্টি প্রধান নিয়ামক হিসেবে বিবেচ্য। অনাবৃষ্টির এই কঠিন সময়ে ভবন নির্মাণে মাত্রাতিরিক্ত পানির উত্তোলন সমস্যাটিকে আরও কঠিনতর করে তুলছে। পূর্বে পানির স্তর অনেক নিচে নেমে গেলেও ব্যবসায়ী মনোবৃত্তির কোথাও কমতি নেই। বিশাল আকারে ভবনের ভিত্তির কারণে পৃষ্টের পানিও নিচে নামতে অপারগ। ভূপৃষ্টের পানি জমে জলাবদ্ধতা-বন্যা সৃষ্টি হলেও ভূগর্ভে তা পৌঁছুতে অক্ষম। তাছাড়া বেশকিছু শহরে সমুদ্রের লোনা পানি ব্যবহারে নগরবাসী অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে। পর্যুদস্ত হয়ে পড়ছে রোগে-শোকে সামাজিক জীবনপ্রবাহ। পরিবেশ দূষণ-বিদ্যুৎ সংকট-শব্দ দূষণে নাকাল অবস্থায় নিপতিত এলাকায় বসবাসরত নাগরিকবৃন্দ। কোথাও কোনো প্রতিবাদে এসব মুনাফালোভী ব্যক্তিদের ন্যূনতম কর্ণপাত নেই। জনগণের সকল সোচ্চার উচ্চারণকে চরম অবহেলা ও অবজ্ঞার চোখে দেখা হচ্ছে।
দেশব্যাপী গড়ে ওঠা এসব বহুতল ভবন নির্মাণে নির্মাণ শ্রমিকদের দুর্ঘটনা এড়াতে যথাযথ ব্যবস্থার ঘাটতি অতিশয় দৃশ্যমান। ফলে প্রতিনিয়ত আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে নির্মাণ শ্রমিকের মৃত্যুর সংখ্যা। গণমাধ্যমে প্রায় প্রতিদিনই নির্মাণাধীন ভবন থেকে পড়ে শ্রমিকের মৃত্যুর সংবাদ প্রকাশ পাচ্ছে। এমনকি ওই সব দুর্ঘটনা থেকে রেহাই পাচ্ছে না পথচারীরাও। আবার অনেকেই মারাত্মকভাবে আহত হয়ে পঙ্গুত্ববরণ করে বেঁচে আছে। দায়িত্বপ্রাপ্ত বিভিন্ন সংস্থাগুলো দেখেও না দেখার ভান করছে। উল্লেখ্য, সংকট উত্তরণে তারা মোটেও আমলে নিচ্ছে না। রাজউক-সিডিএসহ বিভিন্ন সংস্থা থেকে এসব বহুতল ভবন নির্মাণের উপযোগিতা যাচাই-বাছাই প্রায় অকার্যকর। পাশাপাশি দেশব্যাপী কোনো রকমের জায়গা ছাড় না দিয়ে ভবন নির্মাণে ভয়ংকর পরিস্থিতি তৈরি করছে। অগ্নিসংযোগ-বিদ্যুৎ বিভ্রাট-গ্যাস লিকেজসহ নানামুখী দুর্ঘটনা অহরহ ঘটছে। ফায়ার ব্রিগেডের গাড়ি বা ফায়ার ফাইটারদের কার্যক্রম পরিচালনা দুরূহ হয়ে পড়েছে। এতে সম্পদ ও প্রাণহানির বিরামহীন দৃশ্যে পুরো দেশ কাঁতরাচ্ছে। নির্মাতাদের আকাশচুম্বী অর্থ ও পেশিশক্তির দৌরাত্ম্যে সবাই নিশ্চুপ। এ ধরনের যথেচ্ছাচার গণরোষকে অধিক মাত্রায় জোরালো করছে।
এটি সর্বজনবিদিত যে, কোনো জাতীয় অর্থনীতিতে শিল্প এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দ্রুত টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং সার্বিক আর্থ-সামাজিক অগ্রগতিতে শিল্পায়নের অপরিহার্যতা একটি নির্ভরশীল মাপকাঠি হিসেবে চিহ্নিত। শিল্পের প্রতুলতা এবং উন্নয়ন যেকোনো দেশে শুধু যে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে তা নয়; মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন, জনসংখ্যার হ্রাস-বৃদ্ধিসহ প্রত্যেক ক্ষেত্রে এর সুদূর প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। বিশে^র অর্থনৈতিক মানদ-ে শিল্পোন্নত দেশ এবং উন্নয়নশীল দেশসমূহের মাথাপিছু জাতীয় আয়ের অনুপাত কমবেশি ৫ ঃ ১। এ ছাড়া মানব উন্নয়ন সূচক তথা প্রত্যাশিত আয়ু, শিশু মৃত্যুহার, মাতৃ মৃত্যুর সংখ্যা, শিক্ষার হার, জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যবহার, দরিদ্রতা, লিঙ্গ বৈষম্য, মানবাধিকার, পরিবেশ, সামাজিক অধস্তনতা ইত্যাদি সব কিছুই এই শিল্পায়নের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত। উন্নত বিশ্বের উন্নয়নের ধারাবাহিক ইতিহাস পর্যালোচনায় পরিকল্পিত শিল্পায়ন-নগরায়ণের অবদান সুস্পষ্ট। পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং প্রয়োজনীয় পণ্য উৎপাদনে শিল্প প্রতিষ্ঠার কোনো বিকল্প নেই। শিল্পের সমাহারকে ঘিরে নগর-সভ্যতা বিস্তৃতির ধারণা অতি সুপরিচিত। অপরিকল্পিত শিল্পায়ন-নগরায়ণ অনগ্রসর সমাজকে অধিকতর পর্যুদস্ত করে। পর্যাপ্ত সুযোগ না থাকা সত্ত্বেও গ্রাম থেকে শহরমুখী মানুষের ঢল শহর-নগরকে বস্তিতে রূপান্তর করে। মূলত শিল্পে বিনিয়োগ শুধু রাজস্ব আয় বা কর্মসংস্থানকে সমৃদ্ধ করে না। আমদানি-রপ্তানি খাত থেকে শুরু করে দেশজ কাঁচামাল ব্যবহার-ব্যাংক-বিমা-পরিবহনসহ প্রত্যেক খাতের উন্নয়নে সহায়ক। উপার্জনক্ষম শ্রমিক-কর্মচারী-কর্মকর্তা নিয়োগের মাধ্যমে মানবসম্পদ উন্নয়নেও শিল্পায়নের গুরুত্ব অপরিসীম।
তাছাড়া বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ হওয়ার সুবাদে কৃষি এবং কৃষকরাই এদেশের অর্থনীতির মূল চলিকাশক্তি হিসেবে প্রতিভাত। দেশের মোট জনসংখ্যার ৮০ ভাগ এবং মোট শ্রমশক্তির ৬০ ভাগ কৃষিতে নিয়োজিত। উৎপাদনশীলতা ও আয় বৃদ্ধি এবং গ্রামীণ এলাকায় কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে বিশাল জনগোষ্ঠীর সমৃদ্ধির জন্য কৃষির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। কৃষি সামজিক কর্মকা-ের এক বিশেষ ক্ষেত্র যা জনগণের খাদ্য ও পুষ্টির নিশ্চয়তা, আয়ের সুযোগ সৃষ্টি এবং দারিদ্র্য হ্রাসকরণের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর সঙ্গে ওৎপ্রোতভাবে জড়িত। দেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার সঙ্গে তাল মিলিয়ে কৃষি খাতের সার্বিক উন্নয়নের জন্য সুষ্ঠু পরিকল্পনা একান্ত অপরিহার্য। বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তে প্রতিফলিত হয়েছে যে শিল্পায়ন, নগরায়ণ, নদীভাঙন, বসতি স্থাপন, রাস্তা-অবকাঠামো-ইটের ভাটা নির্মাণসহ নানা কারণে প্রতি বছর ৮০ হাজার হেক্টর আবাদি জমি অকৃষিতে রূপান্তরিত হচ্ছে এবং প্রতিদিন হারিয়ে যাচ্ছে প্রায় ২১৯ হেক্টর আবাদি জমি। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের প্রতিটি অঞ্চলে আবাদি জমিতে চলছে অট্টালিকা নির্মাণের মহোৎসব। প্রবাসী আয়ের সিংহভাগ অর্থই ব্যয় হচ্ছে অট্টালিকা বা ফ্ল্যাট ক্রয়ে। ব্যাংক এবং ব্যাংক বহির্ভূত নানা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো অনুৎপাদনশীল এই কর্মযজ্ঞে বিনিয়োগ করছে হাজার হাজার কোটি টাকা। এভাবে চলতে থাকলে দেশের প্রধান উৎপাদনশীল খাত নাজুক হয়ে প্রচ- হুমকিতে পড়বে জননিরাপত্তা। মোদ্দাকথা কথিত আবাসন শিল্পে বিশাল মাপের বিনিয়োগ কাম্য নয়। উক্ত অর্থ দিয়ে শিল্প নির্মাণে উদ্যোক্তরা এগিয়ে এলে দেশ এবং দেশবাসী অনেক বেশি উপকৃত হবে। দেশবাসীর ঐক্যবদ্ধতায় অনুৎপাদিত খাত নয়; উৎপাদনশীল খাতেই সব উদ্যোগ প্রত্যাশিত।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও প্রাবন্ধিক

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন