ঢাকা সোমবার, ২১ জুলাই, ২০২৫

আধুনিক বিশ্বের প্রথম পানিশূন্য রাজধানী কাবুল!

ভিনদেশ ডেস্ক
প্রকাশিত: জুলাই ২১, ২০২৫, ০৪:০১ এএম

সূর্যোদয়ের সাথে সাথে কাবুলের শুষ্ক পাহাড়ের নিচে আফগানিস্তানের কাবুলের বেশির ভাগ পরিবারের পানির সন্ধান ও তা সংরক্ষণের দৈনন্দিন সংগ্রাম শুরু হয়। কাবুলের এই সংকট বিশ্বের জন্য একটি সতর্কবার্তা হিসেবে দেখা হচ্ছে, যেখানে জলবায়ু পরিবর্তন ও অপরিকল্পিত নগরায়ণ কীভাবে একটি শহরের অস্তিত্বকে হুমকির মুখে ফেলতে পাওে, তার নজির স্থাপন করছে। পানির ট্যাংকারের শব্দ শুনে ৪২ বছর বয়সি রাহিলা তার চার সন্তান নিয়ে রাস্তায় ছুটে যান।

তাদের ভাঙা বালতি ও জেরিক্যানে পানি ভরতে হবে। রাহিলা বলেন, ‘আমাদের কাছে পানীয় জলের কোনো উৎস নেই। পানির সংকট আমাদের দৈনন্দিন জীবনকে ব্যাহত করছে।’ এনজিও মার্সি কর্পসের সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, কাবুল শিগগিরই বিশ্বের প্রথম আধুনিক রাজধানী হতে যাচ্ছে, যেখানে সম্পূর্ণভাবে পানি শুকিয়ে যাবে। এই সংকট অর্থনৈতিক পতন ডেকে আনতে পারে বলে সতর্ক করেছে সংস্থাটি।

জনসংখ্যা বৃদ্ধি, জলবায়ু সংকট ও অত্যধিক পানি উত্তোলনের ফলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর বিপজ্জনকভাবে নিচে নেমে গেছে। শহরের প্রায় অর্ধেক গভীর নলকূপ শুকিয়ে গেছে। মার্সি কর্পসের তথ্য মতে, কাবুল প্রতিবছর প্রাকৃতিকভাবে পুনর্ভরণযোগ্য পরিমাণের চেয়ে ৪৪ মিলিয়ন কিউবিক মিটার বেশি পানি উত্তোলন করছে। রাহিলার পরিবারের মতো অনেকেই প্রতিটি ফোঁটা পানির জন্য অর্থ খরচ করে এবং তা সযতেœ ব্যবহার করে। তিনি বলেন, আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন।

বৃষ্টি বেশি হলে ভালো হয়, কিন্তু যদি পরিস্থিতি খারাপ হয়, তাহলে আমরা কীভাবে বাঁচব জানি না।’ ২৮ বছর বয়সি আহমদ ইয়াসিনের পরিবার তাদেও পেছনের বাগানে ১২০ মিটার গভীর একটি কূপ খনন করেছে। কিন্তু এই পানি পানযোগ্য নয়। ইয়াসিন বলেন, ‘এটা নিরাপদ নয়। আমরা পানি ফুটিয়ে ঠান্ডা করে পান করি। এ ছাড়া কিছু করার নেই।’ কাবুলের ৮০% ভূগর্ভস্থ পানি দূষিত (পিট ল্যাট্রিন ও শিল্পবর্জ্যরে কারণে)। ডায়রিয়া ও বমি শহরের সাধারণ সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

কাবুল শহরে ৫০০-এর বেশি পানীয় পানির ও কোমল পানীয় প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান এবং ৪০০ হেক্টরের বেশি জমিতে সবজি চাষ চলছে, যা বছরে কোটি কোটি লিটার পানি খরচ করে। যদিও জলাধার নির্মাণ, কৃত্রিমভাবে পানির স্তর পূরণ এবং নতুন পাইপলাইন সংযোগের মতো প্রকল্প চালুর আহ্বান জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা, কিন্তু বাস্তবে এই প্রকল্পগুলো থেমে আছে তালেবান সরকারের নিয়ন্ত্রণ ও আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার কারণে। এক সময়ে জার্মান উন্নয়ন ব্যাংক কেএফডাব্লিউ এবং ভারত সরকারের সঙ্গে যৌথভাবে চালু হওয়া শাহতূত বাঁধ প্রকল্পসহ বহু উদ্যোগ বর্তমানে বন্ধ হয়ে আছে।

সরকারি কর্মচারী সৈয়দ হামিদ (৩৬) বলেন, ‘রেস্তোরাঁ বা কূপের পানি দিয়ে দাঁত মাজলেও আমরা প্রায়ই অসুস্থ হয়ে পড়ি।’ পানি বিশেষজ্ঞ নাজিবুল্লাহ সাদিদ বলেন, ‘কাবুলে বৃষ্টি বেশি হচ্ছে, কিন্তু তুষারপাত কমে গেছে। এটি ফ্ল্যাশ ফ্লাড বাড়াচ্ছে এবং ভূগর্ভস্থ পানির রিচার্জ কমিয়ে দিচ্ছে।’ইউনিসেফের পূর্বাভাস অনুযায়ী, বর্তমান প্রবণতা অব্যাহত থাকলে ২০৩০ সালের মধ্যে কাবুলের ভূগর্ভস্থ পানি সম্পূর্ণ শেষ হয়ে যেতে পারে।

৬০ লাখেরও বেশি মানুষের শহর আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুল। দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে এক ভয়াবহ বিপর্যয়ের দিকে। একটি সাম্প্রতিক আন্তর্জাতিক প্রতিবেদনে সতর্ক করে বলা হয়েছে, আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে কাবুল হতে পারে আধুনিক বিশ্বের প্রথম পানিশূন্য নগ রী। এ ছাড়া ৩০ লাখ মানুষের বাস্তুচ্যুতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। খবর আলজাজিরার।

মার্সি কর্পসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত এক দশকে কাবুলের ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ২৫ থেকে ৩০ মিটার পর্যন্ত নেমে গেছে। এর কারণ হিসেবে উঠে এসেছে অতিরিক্ত পানি উত্তোলন, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব এবং প্রশাসনিক ব্যর্থতা। প্রতিবছর প্রাকৃতিকভাবে ভূগর্ভস্থ যে পরিমাণ পানি পুনরায় সঞ্চিত হওয়ার কথা, তার চেয়ে প্রায় ৪৪ মিলিয়ন ঘনমিটার বেশি পানি উত্তোলন করা হচ্ছে কাবুলে। শহরটিতে প্রায় ৫০ শতাংশ বোরওয়ে এখন পুরোপুরি শুকিয়ে গেছে এবং যেসব উৎস এখনো কিছুটা পানি দিচ্ছে, তার ৮০ শতাংশই দূষিতÍমিশে আছে নোংরা পানি, আর্সেনিক ও লবণাক্ততা।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বৃষ্টি কমে গেছে, আগাম তুষার গলা এবং খরা ক্রমাগত তীব্র হচ্ছে। ২০০১ সালে যেখানে শহরের জনসংখ্যা ছিল ১০ লাখের নিচে, বর্তমানে তা ৬০ লাখ ছাড়িয়েছে, যা চাপ বাড়িয়েছে পানির উৎসের ওপর। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই সংকট সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করছে দরিদ্রদের। বিত্তশালী পরিবারগুলো যেখানে গভীর নলকূপ খনন করে পানি তুলতে পারছে, সেখানে দরিদ্ররা প্রতিদিন ছোট ছোট পাত্র হাতে করে শহরজুড়ে পানি খুঁজে বেড়াচ্ছে, এমনকি শিশুরাও।