গাজা উপত্যকার আবির ও ফাদি সোভ দম্পতি। এক তাঁবুতে প্রতিদিন ঘুম ভাঙে তাদের। ঘুম ভাঙার সঙ্গে সঙ্গেই তারা ভাবেনÑ আজ কীভাবে খাবার জোগাড় করবেন নিজেদের ও ছোট ছয় সন্তানের জন্য? তাদের হাতে মাত্র তিনটি উপায়: হয়তো কোনো দাতব্য রান্নাঘর খোলা থাকবে; হয়তো ভিড় ঠেলে সাহায্যের ট্রাক থেকে কিছু আটা পাওয়া যাবে; না হলে শেষ ভরসাÑ ভিক্ষা। তিনটিতেই ব্যর্থ হলে, সেদিন আর কিছু খাওয়া হয় না। এখন এমনটাই হচ্ছে প্রায় প্রতিদিন। গাজা শহরের পাশের একটি শরণার্থী ক্যাম্পে বাস করে সোভ পরিবার, যারা বহুবার স্থানচ্যুত হয়েছে। তাদের মতো হাজারো পরিবার আজ ক্ষুধা, গরম আর অনিশ্চয়তার সঙ্গে লড়ছে। ২২ মাস ধরে চলা যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে মানবিক সহায়তায় বিধি-নিষেধ, অবরোধ এবং নিরাপত্তাহীনতার কারণে গাজায় ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ তৈরি হয়েছে। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর মতে, বর্তমানে ‘সবচেয়ে খারাপ দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতি’ সেখানে বাস্তবে ঘটছে। ইসরায়েল মার্চে প্রায় আড়াই মাস খাদ্য ও সাহায্য বন্ধ রেখেছিল, হামাসের কাছে জিম্মিদের মুক্তির দাবিতে। মে মাসে সহায়তা কিছুটা চালু হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় খুব কম। মিষ্টি পানির অভাবে আবির প্রতিদিন সাগর থেকে পানি আনেন। তাতে সন্তানদের গোসল করান ধাতব বেসিনে দাঁড় করিয়ে। লবণজলে ৯ মাস বয়সী হালার চোখ জ্বলে, কাঁদেÑ বাকিরা মুখ বুজে সহ্য করে। আগের দিনের কিছু না থাকলে আবির বের হন ভিক্ষা করতে। কখনো কেউ এক বাটি পাতলা ডাল দেন, কখনো কিছুই মেলে না। ভাগ্য ভালো হলে ডাল গুঁড়া করে পানিতে মিশিয়ে ছোট সন্তানদের খাওয়ান। ফাদি সকাল থেকে অপেক্ষা করেন কাছের রান্নাঘরে, কিন্তু বেশির ভাগ সময় খালি হাতে ফিরতে হয়। একসময় তিনি ট্রাক থেকে খাবার সংগ্রহে যেতেন, কিন্তু সম্প্রতি সেখানে গুলি লেগে তার পায়ে ক্ষত হয়। এখন আর যেতে পারেন না। বড় তিন সন্তানÑ ইউসুফ, মোহাম্মদ ও মালাকÍজেরিকেন নিয়ে বের হয় মিষ্টি পানি আনতে। ভারে কাঁধে, পিঠে বা মাটিতে টেনে আনে তারা সেই বোঝা। আবির বা তার ছেলে ইউসুফ সাহায্যের ট্রাকের আশায় যান জিকিম এলাকায়। ভিড়ে পিছিয়ে পড়েন, তবে কেউ কেউ দয়া করে কিছু আটা দিয়ে দেন। এইভাবে অল্প যা মেলে, তা দিয়েই দিন চলে। দুপুরে গরমে শিশুদের ঘুম পাড়িয়ে রাখতে চান তারাÑ তাতে কম শক্তি ক্ষয় হয়, কম খিদে পায়। বিকেলে ছেলে-মেয়েরা ঘুরে বেড়ায় ধ্বংসস্তূপ আর আবর্জনায়Ñ খুঁজে ফেরে কাঠ, কাগজ বা যেকোনো কিছু, যা দিয়ে আগুন জ্বালানো যায়। পুরোনো একটি পাত্র খুঁজে পেয়েছিল একদিনÑ এটাই এখন তাদের রান্নার হাঁড়ি। সব মিলিয়ে, যদি খাবার, পানি ও জ্বালানি তিনটিই মেলে, তবে পাতলা ডালের ঝোল রান্না হয়। না হলে না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে সবাই। ‘আমি খুবই ক্লান্ত। আর পারছি না। যদি যুদ্ধ এভাবে চলতেই থাকে, নিজেকে শেষ করে দেওয়ার কথাও ভাবছি’Ñ বলেন আবির। এই পরিবারের জীবন যেন গোটা গাজার প্রতিচ্ছবি। যেখানে প্রতিটি দিন শুরু হয় একটাই প্রশ্ন দিয়েÑ আজ কি খাবার জুটবে? ফিলিস্তিনের গাজায় তীব্র হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েল। শনিবার (২ আগস্ট) দুপুর নাগাদ গাজাজুড়ে ইসরায়েলি হামলায় ১৩ জন ত্রাণপ্রার্থীসহ কমপক্ষে ২৪ জন নিহত হয়েছেন। খবর আলজাজিরার। তবে এ প্রাথমিক সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। কারণ, অনেককে হাসপাতালে আনা সম্ভব হয়নি। অনেকে আহতাবস্থায় ধ্বংসস্তূপে আটকে আছেন। ইসরায়েলি বাহিনীর অব্যাহত হামলার মুখে উদ্ধারকারীরা ঘটনাস্থলে পৌঁছতে পারছেন না। এদিকে গাজায় চলমান যুদ্ধের কারণে ইসরায়েলের সঙ্গে সব ধরনের অস্ত্রবাণিজ্যে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে স্লোভেনিয়া। ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সদস্য দেশগুলোর মধ্যে এটি প্রথম পদক্ষেপ। বৃহস্পতিবার (৩১ জুলাই) এক সরকারি বৈঠকের পর দেশটির প্রধানমন্ত্রী রবার্ট গোলোব এ সিদ্ধান্তের ঘোষণা দেন। সরকার এক বিবৃতিতে জানায়, ইসরায়েল থেকে এবং ইসরায়েলের উদ্দেশে যে কোনো ধরনের অস্ত্র আমদানি, রপ্তানি ও পরিবহনে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় বিমান থেকে ত্রাণসামগ্রী ফেলা শুরু করবে ইতালি। হামাস যদি যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে রাজি না হয়, তাহলে গাজায় তার দেশের সেনাবাহিনী কী পদক্ষেপ নেবে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত স্থগিত করেছেন প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। শুক্রবার (১ আগস্ট) সিএনএনকে বিষয়টি সম্পর্কে অবগত একটি সূত্র এই তথ্য জানিয়েছে। এদিকে, কাতারের দোহায় অনুষ্ঠিত গাজা যুদ্ধবিরতি আলোচনা থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসর য়েল তাদের প্রতিনিধিদলকে প্রত্যাহার করে নিয়েছে। ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজায় খাদ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে দুদিনে ১০০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরও অনেকে। শুক্রবার (১ আগস্ট) জাতিসংঘের এক কর্মকর্তা এ তথ্য জানান। খবর বার্তা সংস্থা আনাদোলুর। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জাতিসংঘের একজন কর্মকর্তা গাজা উপত্যকায় বেসামরিক নাগরিকদের ক্রমবর্ধমান প্রাণহানি এবং আহত হওয়ার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, বিশেষ করে যারা মৌলিক খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করতে গিয়ে নিহত হচ্ছেন।
আপনার মতামত লিখুন :