পুঁজিবাজারে নিষিদ্ধ হওয়ার পরে বাংলাদেশ সিকিউরিটি অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম ও কমিশনার ড. শেখ শামসুদ্দিনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। তারা দুজনসহ আরও আটজনের বিরুদ্ধে ঢাকার সিএমএম আদালতে গত বৃহস্পতিবার মামলা করেন ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ বিডি লিমিটেডের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ও সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্যাপ্টেন তাসবিরুল আমহেদ চৌধুরী।
অভিযুক্তরা ইউনাইটেড এয়ারে দায়িত্ব পালনকালে বিভিন্ন সময়ে অনিয়ম ও আর্থিক দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন। তারা পরস্পরের যোগসাজশে ২০১০ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বিমান কোম্পানিকে ধ্বংস করতে চেষ্টা করেন। এয়ারওয়েজের আটটি বিমান অরক্ষিত ও স্টোরের কোটি কোটি টাকার মালামাল এবং যন্ত্রাংশ চুরি করেন। আসামিদের অপকর্মের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ মামলায় তুলে ধরেন প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান। মামলার নথি এ প্রতিবেদকের হাতে এসেছে।
মামলায় অভিযুক্ত বাকিরা হলেন ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের সাবেক পরিচালক ও এনআরবি ব্যাংকের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মাহতাবুর রহমান, সাবেক স্বতন্ত্র পরিচালক ও কোম্পানি সেক্রেটারি উইং কমান্ডার (অব.) এটিএম নজরুল ইসলাম, দ্য বাংলাদেশ মনিটরের সম্পাদক কাজী ওয়াহিদুল আলম, সাবেক পরিচালক শাহীনুর আলম, স্বতন্ত্র পরিচালক আফাজ মিয়া, ভারপ্রাপ্ত কোম্পানি সেক্রেটারি আশরাফ মাহমুদ, সিভিল এভিয়েশন অথরিটির প্লাইড সেফটি অ্যান্ড রেগুলেশন পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন এস এম নাজমুল আনাম এবং বিএসইসির ডেপুটি ডিরেক্টর (এলএসডি) শাহরিয়ার পারভেজ।
মামলা দায়ের করতে বিলম্বের কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, ‘সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিরক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিকের ভায়রাভাই সিভিল এভিয়েশন গ্রুপ ক্যাপ্টেন এস এম নাজমুল আনাম। তারিক সিদ্দিকীর হুমকি ও অনুকূল পরিস্থিতি না থাকায় মামলা দায়ের করতে বিলম্ব হয়েছে।’
ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ক্যাপ্টেন তাসবিরুল আমহেদ চৌধুরী বলেন, ‘তারা ক্ষমতার উৎসমুখে বসে ছিল। শেখ হাসিনার আমলে তাদের বিরদ্ধে মামলা করার দুঃসাহস করোরই ছিল না। যাদের বিরুদ্ধে এখন মামলা করেছি তারা প্রত্যেকে ক্ষমতার অপব্যবহার করেছে, যা এই সরকারের কাছে প্রমাণিত।’
মামলায় বলা হয়েছে, ১নং আসামি মোহাম্মদ মাহতাবুর রহমান ২০১০ সাল থেকে ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ কোম্পানিতে পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে বেআইনিভাবে ২০১৪ সালের ২২ সেপ্টেম্বর নিজেকে চেয়ারম্যান ও ১০ শতাংশ বোনাস লভ্যাংশ ঘোষণা করেন। একই সভায় শাহীনুর আলম ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও আফাজ মিয়াকে ইন্ডিপেনডেন্ট ডিরেক্টর করে নতুন পরিষদ গঠন করে কর্মীদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করলে সব ফ্লাইট বন্ধ হলে কোম্পানির সরাসরি প্রায় ১০০ কোটি টাকার ক্ষতি ও সুনাম নষ্ট হয়। দুই দিন বন্ধ থাকার পরে চেয়ারম্যান থেকে দায়িত্ব হস্তান্তর করেন মাহতাবুর রহমান।
অন্যদিকে, আসামি গ্রুপ ক্যাপ্টেন নাজমুল আনাম ছিলেন স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকারের প্রভাবশালী ব্যক্তি মেজর জেনারেল তারিক সিদ্দিকীর আপন ভাইরাভাই। তারা পরস্পর যোগসাজশ করে সিভিল এভিয়েশনের অফিসে বসে ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের নকল প্যাডে লিখিত আকারে সব ফ্লাইট বন্ধের ঘোষণা করেন। যার ফলে কোম্পানিটি স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যায়।
কোম্পানি পরিচালনা পরিষদের সিদ্ধান্ত মোতাবেক স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া ও ইসলামী ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ করা হয়। সেই ঋণ পরিশোধ না করায় ব্যাংক কর্তৃপক্ষ পরিচালনা পরিষদের সব সদস্যের বিরুদ্ধে ২০১৭ সালে অর্থঋণ আইনে মামলা ও সিআর মামলা করেন। মামলা দুটি বর্তমানে বিচারাধীন।
১নং আসামি কোম্পানি পরিচালনা পরিষদে থাকা অবস্থায় ব্যাংক থেকে লোনের জন্য গ্যারান্টি পেপারে স্বাক্ষর করলেও পরে অস্বীকার করে বাদীর নামে উত্তরা পশ্চিম থানায় ২০২৩ সালে মামলা দায়ের করেন। এ ছাড়া একাধিক প্রতারণা ও হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাচারের সঙ্গে জড়িত।
ঋণ পরিশোধ না করায় ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের সব পরিচালক বাংলাদেশ ব্যাংকের বিধি অনুসারে ঋণখেলাপি। তবুও ৪নং আসামি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম নিয়মবহির্ভূতভাবে তাকে আল হারামাইন নামে একটি সিকিউরিটিজ হাউসের অনুমতি দেন এবং অনেক অপকর্মে জড়িত।
আসামি উইং কমান্ডার (অব.) নজরুল ইসলাম ও কাজী ওয়াহিদুল আলম ২০২১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি কমিশনের মাধ্যমে পরিচালনা পরিষদে নিয়োগ পান। তারা প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যানের মালিকানাধীন অফিস কোনো চুক্তি ছাড়া ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের অফিস হিসেবে ব্যবহার করেন। অফিস ভাড়া ও গ্যাস বিলসহ অন্যান্য খরচ বাবদ ২০ লাখ টাকা পরিশোধ করেননি। আশরাফ মাহমুদের কুপরামর্শে তারা জোরপূর্বক অফিস ব্যবহার করেন বলে মামলায় বলা হয়েছে।
একই সঙ্গে তারা এয়ার কোম্পানির মূল্যবান নথিপত্র ও ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের আটটি বিমান ও স্টোরের কোটি কোটি টাকার মালামাল এবং যন্ত্রাংশ চুরি করেন। তারা বিমানের গুরুত্বপূর্ণ মালামাল অরক্ষিত রাখেন।
চুরির কারণে বাদীসহ ১ লাখ ৬০ হাজার শেয়ারহোল্ডার আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হন। আসবাবপত্র ও গাড়ি কোম্পানির প্রয়োজনে ব্যবহার না করে বেশির ভাগ সময় নিজের প্রয়োজনে ব্যবহার করা হয়েছে দাবি করে ২০২২ সালের ১১ আগস্ট বিমানবন্দর থানায় একটি সাধারণ ডায়রি করেন বাদী। অন্যদিকে তিনজন মিলে বাদীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন গণমাধ্যমে মিথ্যা অপপ্রচার এবং এয়ার ধ্বংসের জন্য বাদীকে দায়ী করেন।
এ ছাড়া ২০১৫ থেকে ২০২১ সালের ২৮ মার্চ পর্যন্ত অডিট রিপোর্ট অনুযায়ী সাবেক এমডির বেতন ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক পাওনা মোট ৬ কোটি ৮১ লাখ ৮৩ হাজার ৮৭৭ টাকা। কিন্তু দায়িত্ব পালনের সময় মনগড়া অডিট রিপোর্ট করে বাদীর পাওনা ৫ কোটি ৬৯ লাখ ২৭ হাজার ৫৫৩ টাকা বাদ দিয়ে মাত্র ১ কোটি ১২ লাখ ৫৬ হাজার ৩২৪ টাকা করেন।
বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনে (বিএসইসি) দায়িত্বে থাকাকালে এয়ার পুনরায় উড্ডয়ন করতে সহযোগিতার জন্য আবদেন করেন সাবেক চেয়ারম্যান। বিনিময়ে বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ও সাবেক কমিশনার মিলে কমপক্ষে ১০০ কোটি টাকা চাঁদা দাবি করেন। চাঁদা প্রদান করলে ইউনাইটেড এয়ার চালুর ব্যাপারে আশ্বাস দেন। টাকা দিতে অস্বীকার করলে তারা ক্ষমতার অপব্যবহার করে ক্যাপটেন তাসবিরুল আহমেদকে দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেন, যা আইনবর্হিভূত কর্মকাণ্ড।
এদিকে, বিভিন্ন অপকর্মের দায়ে বিএসইসির তৎকালীন চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামকে পুঁজিবাজারে আজীবন অবাঞ্ছিত (পারসোনা নন গ্রাটা) এবং তৎকালীন কমিশনার ড. শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ ৫ বছরের জন্য পুঁজিবাজারে অবাঞ্ছিত ঘোষিত হয়েছেন। গত বুধবার বিএসইসির কমিশনের ৯৬৫তম সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
আপনার মতামত লিখুন :