সোমবার, ২৪ নভেম্বর, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


সালমান ফরিদ ও আব্দুল আহাদ, সিলেট

প্রকাশিত: নভেম্বর ২৪, ২০২৫, ১২:৪৭ এএম

সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়

নারী শিক্ষককে চাকরিচ্যুত করতে মরিয়া প্রশাসন

সালমান ফরিদ ও আব্দুল আহাদ, সিলেট

প্রকাশিত: নভেম্বর ২৪, ২০২৫, ১২:৪৭ এএম

নারী শিক্ষককে চাকরিচ্যুত  করতে মরিয়া প্রশাসন

ড. নাসরিন সুলতানা লাকী। সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা আন্দোলনে যে কয়টি মুখ সক্রিয় ছিল, তিনি তাদের একজন। জাতীয়তাবাদী চেতনার শিক্ষক হিসেবে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমানকে ‘সিলেট সরকারি ভেটেরিনারি কলেজকে’ বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপ দেওয়ার বিষয়ে প্রভাবিত করতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। সেই নাসরিন সুলতানা লাকীকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সরিয়ে দিতে; চাকরিচ্যুত করতে মরিয়া সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (সিকৃবি) বর্তমান প্রশাসন। বায়বীয় অভিযোগ, মিথ্যা ডকুমেন্টস, ভুয়া প্রমাণ তৈরি করে তাকে দাঁড় করানো হচ্ছে কাঠগড়ায়।

চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের পর নতুন প্রশাসন যখন বিএনপিপন্থি শিক্ষকদের নানাভাবে বঞ্চিত করার পুরোনো রীতি অনুসরণ করছিল, তখন যারা এসবের বিরুদ্ধে কথা বলেন, ড. লাকি তাদের একজন। তিনি শিক্ষার্থীবন্ধব হওয়ায় ক্লাস, প্রশাসনসহ নানা পর্যায়ে তাদের স্বার্থ ক্ষুণœ হওয়া এবং তাদের সঙ্গে রাজনৈতিক বিবেচনায় সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিরোধিতা করেন তিনি। এ ছাড়া নতুন প্রশাসনের সময় গণমাধ্যমে একাধিক সংবাদ প্রকাশের পর এর দায়ভার চাপিয়ে দেওয়া হয় তার কাঁধে। এসব অভিযোগ এনেই নানান ছুঁতায় তার বিরুদ্ধে এবার অ্যাকশনে যাচ্ছে ‘কর্তৃত্ববাদী’ প্রশাসন। যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন ভিসি প্রফেসর ড. আলিমূল ইসলাম। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে তাকে যাতে শাস্তি দিয়ে চাকরিচ্যুত করা যায়, সেই ক্ষেত্র তৈরি করতে এই পথে এগোচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়। বিভিন্ন অজুহাতে তাকে বিব্রত ও একাধিকবার হেনস্তা করে কর্তৃপক্ষ। ‘কর্মক্ষেত্রে নারী শিক্ষিকাকে হেনস্তা’ করার অভিযোগ এনে ইতিমধ্যে সরকারের কয়েকটি বিভাগকে লিখিতভাবে জানিয়েছেন তিনি। এ কারণেও কর্তৃপক্ষ তার ওপর বেজায় নাখোশ হয়ে ওঠে।

প্রফেসর ড. নাসরিন সুলতানা লাকী সিকৃবির সার্জারি ও থেরিওজেনোলজি বিভাগের সিনিয়র শিক্ষক। এর আগে তিনি এই বিভাগের বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্বও পালন করেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার আগে ‘সিলেট সরকারি ভেটেরিনারি কলেজ’ থেকে এখানে কর্মরত। কিন্তু তার ওপর ভিসি আলিমুল অসন্তুষ্ট হন, যখন তিনি জুলাইযোদ্ধা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী বাফিল আহমদ অরিত্রের ছাত্রত্ব কেড়ে নিতে প্রশাসনের উদ্যোগের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। এতে বেশ ক্ষুব্ধ হন ভিসি স্বয়ং। এ নিয়ে নানা সময় তাকে হেনস্তাও করা হয়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ভেটেরিনারি, এনিম্যাল ও বায়োকেমিক্যাল সায়েন্সেস অনুষদের একাধিক শিক্ষক দৈনিক রূপালী বাংলাদেশকে জানান, ড. লাকী অন্যায়ের সঙ্গে আপস করেননি। অবৈধভাবে তার বিভাগে শিক্ষার্থীদের যে ডিগ্রি দেওয়া হচ্ছে, সেটি মানছেন না। প্রতিবাদ করছেন লিখিতভাবে।

সূত্র জানায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জারি ও থেরিওজেনোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান ড. অনিমেষ চন্দ্র, প্রফেসর আতিকুজ্জামান এবং ভেটেরিনারি, এনিম্যাল ও বায়োকেমিক্যাল সায়েন্সেস অনুষদের শিক্ষক ড. রফিকুল ইসলাম ভিসির খুব কাছের ও আস্থাভাজন। ড. অনিমেষের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল গত ফ্যাসিস্ট সরকারের সময়ই। এ নিয়ে তখন গণমাধ্যমেও খবর প্রকাশিত হয়। শিক্ষা ছুটির কারণে সার্জারি বিষয়ের কোনো শিক্ষকই যখন ছিলেন না ওই বিভাগে, তখনই তার ডিগ্রি নেওয়া। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার নীতি অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট বিষয়ের বিশেষজ্ঞ শিক্ষক ছাড়া শ্রেণিশিক্ষক হতে পারেন না। সূত্র জানায়, তার শ্রেণি শিক্ষক ছিলেন ডা. মো. রফিকুল ইসলাম। যিনি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহের মেডিসিন বিভাগ থেকে মেডিসিন বিষয়ে এমএস ডিগ্রিধারী। তিনি কোনোভাবেই সার্জারির শ্রেণিশিক্ষক হতে পারেন না। এসব নানা বিষয় নিয়ে একাডেমিকভাবে আপত্তি জানান ড. নাসরিন লাকী। এ কারণে ভিসি সিন্ডিকেটের রোষানলের শিকারে পরিণত হয়েছেন তিনি।

অপর একটি সূত্র জানায়, সিলেটের বিভিন্ন স্থানে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছে নানান নামে প্রাণিসম্পদ চিকিৎসার ক্লিনিক। এটি ব্যবসায় পরিণত করেছেন ড. অনিমেষসহ আরও কয়েকজন। অনিমেষের নিজের ক্লিনিক ‘প্যানাসিয়া ডেট এন্ড পেট কেয়ার’ নগরীর মিরাবাজারে। শহরের লাকড়িপাড়ায় ভেট কেয়ার নামে ক্লিনিক গড়ে তুলেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন শিক্ষক ড. মাহবুব ই ইলাহী ও ড. সুলতান আহমেদ। সার্জারি বিভাগের আরও একজন শিক্ষক ড. মাহফুজুল হক ‘পেট ও ভেট কেয়ার’ নামে নগরীর টিলাগড়ে গড়ে তুলেছেন আরেকটি ক্লিনিক। সার্জারি বিভাগের শিক্ষার্থী ডা. মো. সাফায়ার নগরীর শিবগঞ্জে ‘পালস পেট এন্ড ভেট কেয়ার’ নামক ক্লিনিক। অবৈধ ডিগ্রিধারী ও নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষক, অবৈধ এসব ক্লিনিক আর অনৈতিক কর্মকা-ের ঘোর বিরোধী ড. নাসরিন সুলতানা লাকী। তারাই পথের কাঁটা সরাতে একজোট হয়ে ভিসির কান ভারী করে তাকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাড়িয়ে দিতে উঠেপড়ে লেগেছেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের বিগত ৪৮তম একাডেমিক কাউন্সিলের মিটিংয়ে এই বিভাগের একাডেমিক কাউন্সিল মেম্বার, বিএনপিপন্থি শিক্ষক ড. নাসরিন ২টি এজেন্ডা নিয়ে কথা বলার অনুমতি চান কাউন্সিলের সভাপতি ভিসি আলিমুলের কাছে। কিন্তু তিনি অনুমতি দেননি। এ নিয়ে পরে তিনি উচ্চবাচ্য করেন। একজন বহিঃসদস্যও এ নিয়ে কথা বলেন। পরে ভিসি নানান অভিযোগ এনে তার বিরুদ্ধে একাধিক তদন্ত কমিটি করেন।

বায়বীয় অভিযোগ এবং নিজের বিরুদ্ধে সুগভীর ষড়যন্ত্রের আভাস পেয়ে প্রফেসর ড. নাসরিন সুলতানা লাকী গত ৯ সেপ্টেম্বর সুবিচার চেয়ে রেজিস্ট্রার বরাবর আবেদন করেন। যাতে তিনি মব সৃষ্টির অভিযোগ আনেন। অভিযুক্ত অপরাধী শিক্ষার্থীদের বাঁচানোর জন্য মিথ্যা তথ্য দিয়ে উল্টো বিতর্কিত সদস্যদের দিয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করেন।

এ অবস্থায় পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৮তম একাডেমিক কাউন্সিলের বৈঠকের দুটি এজেন্ডা নিয়ে গত ২২ সেপ্টেম্বর একাডেমিক কাউন্সিলের বৈঠকে কথা বলার অনুমতি চান ড. নাসরিন সুলতানা লাকী। কিন্তু তাকে অনুমতি না দিয়ে ভিসি আলিমুল ইসলাম প্রকাশ্যে চেঁচিয়ে ড. নাসরিন লাকীকে উদ্দেশ করে বিভিন্ন মন্তব্য করেন। ড. লাকী এ তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করেন। এমনকি একাধিক শিক্ষকও ঘটনার সত্যতা শিকার করেন। এটিকে ড. লাকীসহ সিনিয়র শিক্ষকরা হুমকি হিসেবে দেখছেন।

এদিনের ঘটনার রেশ ধরে ২৪ সেপ্টেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি কাউন্সিলের সাধারণ সদস্য ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর প্রফেসর ড. জসিম উদ্দিন আহমদকে দিয়ে আইন ও নিয়মবহির্ভূত একটি পত্র ইস্যু করেন ড. নাসরিন সুলতানা লাকী বরাবরে। যাতে এজেন্ডাবহির্ভূত কথা বলার অভিযোগ আনা হয়।

এদিকে গত ১৭ নভেম্বর সোমবার ডিন অফিসে সকল অনুষদের চেয়ারম্যান, ডিন এবং সিনিয়র প্রফেসর ড. আবু হেনা মোস্তফা কামাল,  ড. এম রাশেদ হাসনাতসহ জরুরি একটি বৈঠক করেন ভিসি। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনজন শিক্ষকের নামে অভিযোগ উত্থাপন করে চাকরিচ্যুতির বিষয়ে আলোচনা হয়। বৈঠকে অংশ নেওয়া এক শিক্ষক এ প্রতিবেদককে জানান, ১৪টি বিভাগের ১৩ জন বিভাগীয় প্রধান বৈঠকের এজেন্ডা সম্পর্কে অবগত ছিলেন না। ভিসি সে সময় দুজন সিন্ডেকট মেম্বারের নামে অভিযোগ উত্থাপন করেন যে, তারা গত সিন্ডিকেট মিটিংয়ে ভিসির বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। বৈঠকে তিনি বলেন, ড. মেহেতাজুল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে ড. নাসরিন লাকীর বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিথি ভবনে সিন্ডিকেটের বহিঃসদস্যদের সাথে দেখা করে ভিসির নামে অভিযোগ দিয়েছেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের নারীদের সুরক্ষা দেওয়ার জন্য গঠিত কমিটিÑ যৌন হয়রানি,  নিপীড়ন ও নির্যাতন প্রতিরোধকল্পে গঠিত অভিযোগ কমিটির সভাপতি ছিলেন প্রফেসর ড. নাসরিন সুলতানা লাকী। বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটের নির্দেশনায় কোনোভাবেই নাসরিনকে ২ বছরের আগে পদ পরিবর্তন করতে পারবেন না কর্তৃপক্ষ। কিন্তু ড. লাকীকে সরিয়ে সেই পদে সময়ের আগে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে ড. মোহন মিয়াকে। এটিও আইনবহির্ভূতভাবে হয়েছে, দাবি করেন ড. লাকী।

দৈনিক রূপালী বাংলাদেশের সঙ্গে আলাপকালে চাকরি হারানোর শঙ্কায় থাকা প্রফেসর ড. নাসরিন সুলতানা লাকী বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে জাতীয়তাবাদী চেতনার শিক্ষকদের বিরুদ্ধে সুগভীর ষড়যন্ত্র চলছে। আমাদের সবার অভিভাবক হওয়ার কথা থাকলেও বিস্ময়করভাবে সেই কাজটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন ভিসি নিজে। তারই অংশ হিসেবে আমার বিরুদ্ধে নানা রকম বায়বীয় অভিযোগ উত্থাপন করিয়ে ঘায়েলের চেষ্টা চলছে। গত ফ্যাসিস্ট সরকারের সময় অন্যায়ভাবে আমার বেতন বন্ধ করে রেখেছিল। এই কাজ নেতৃত্ব দিয়েছিল প্রফেসর ড. মোহাম্মদ আতিকুজ্জামানসহ বেশ কিছু স্বৈরশাসকের দোসরখ্যাত শিক্ষক। এরা প্রত্যেকেই বহাল তবিয়তে আছেন। আমার অপরাধ, আমি ভিসি ক্যান্ডিডেট ছিলাম। জুলাইযোদ্ধা হিসেবে আমি মন্ত্রণালয়ের কাছে সম্মানিত। এটি ভিসির আশপাশের কারো পছন্দ নয়। তাই জোরপূর্বক নেগেটিভ কিছু আমার ব্যক্তিগত ফাইলে যোগ করার ষড়যন্ত্র চলছে।

তিনি আরও বলেন, বিএনপিপন্থি শিক্ষকÑ এই পরিচয় আমার জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছ। আমি এগুলো বিভিন্ন সময় সংশ্লিষ্টদের লিখিতভাবে জানিয়েছি। একটি পত্রও ঊর্ধ্বগামী করা হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ে বিচার পাইনি আমি। বিচার চাওয়া এখন আমার অপরাধ। আমার বিরুদ্ধে সম্মিলিত যে ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে, আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ ছাড়া আমার আর কোনো উপায় তারা রাখছেন না।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সাদা দলের নেতা, সাবেক রেজিস্ট্রার এবং জেনেটিকস ও এনিম্যাল ব্রিডিং বিভাগের প্রফেসর ড. আতাউর রহমান অভিযোগের সত্যতা স্বীকার করে বলেন, ভিসি তার মতো করে বিশ্ববিদ্যালয় চালাতে চাচ্ছেন। সামান্য ছুঁতোয় তিনি প্রায়ই চাকরি খাওয়ার হুমকি দেন। ভিসি সব জায়গায় বঞ্চিত করছেন জাতীয়তাবাদী চেতনার শিক্ষকদের। প্রফেসর ড. নাসরিন সুলতানা লাকীর সঙ্গেও অন্যায় হচ্ছে।

এদিকে ড. নাসরিন সুলতানা লাকীর এমন সব অভিযোগের বিষয়ে সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর ড. আলিমূল ইসলাম কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। এ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার প্রফেসর ড. আসাদুদৌলার সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। তবে তিনিও ড. নাসরিন লাকীর প্রসঙ্গ শুনে বলেন, এ প্রসঙ্গে কোনো কথা বলব না।

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!