একসময় ছিলেন গৃহশিক্ষক, সংসার চালাতে হিমশিম খেতেন। অথচ এখন নরসিংদী শহরের প্রাণকেন্দ্র বাসাইলে পাঁচতলা বিলাসবহুল ভবনের মালিক তিনি।
যার বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় ১০ কোটি টাকা। বলছি সাবেক পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নজরুল ইসলাম হীরুর আস্থাভাজন হিসেবে পরিচিত মোবারক হোসেনের কথা। শুধু এ বাড়িই নয়, নামে-বেনামে সম্পদ, দামি গাড়ি আর প্রভাবশালী রাজনৈতিক যোগাযোগের আড়ালে গড়ে তুলেছেন দুর্নীতির এক ভয়াবহ সাম্রাজ্য।
মোবারক হোসেনের উত্থানের পেছনে রয়েছে সাবেক পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী লে. কর্নেল (অব.) মো. নজরুল ইসলাম হীরুর ছত্রছায়া। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই মোবারকের ভাগ্য বদলে যেতে থাকে। সেই সময় থেকে তিনি পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং জেলার বিভিন্ন হাসপাতালের ঠিকাদারি কার্যক্রমে একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তার করেন।
নরসিংদীর পানি উন্নয়ন বোর্ড ও জেলা হাসপাতালসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে মোবারক হোসেনের মালিকানাধীন মেসার্স এম এইচ এন্টারপ্রাইজ (লাইসেন্স নম্বর ৫৭৯) এককভাবে কাজ পেতে থাকে। স্থানীয় ঠিকাদারদের অভিযোগ, মোবারক তার ক্ষমতা ও পেশিশক্তি ব্যবহার করে অন্য কাউকে টেন্ডারেই অংশ নিতে দিতেন না। বিরোধিতাকারীদের ওপর নেমে আসত তার পোষা সন্ত্রাসীদের হুমকি-ধমকি ও হামলার ভয়।
সবচেয়ে ভয়ংকর অভিযোগ মোবারকের বিরুদ্ধে এসেছে আউটসোর্সিং কর্মচারীদের কাছ থেকে। তথ্য অনুসারে, ২০১৯ সাল থেকে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত ২৬ জন কর্মচারী (২২ জন ক্লিনার, ৪ জন দারোয়ান) নরসিংদী জেলা হাসপাতালে কর্মরত ছিলেন। সরকার নির্ধারিত মাসিক বেতন ছিল ১৬ হাজার ১৩০ টাকা, কিন্তু মোবারক হোসেন তাদের দিতেন মাত্র আট হাজার টাকা। ৫৭ মাসে ২৬ জনের কাছ থেকে মোট আত্মসাৎ করেছেন ১ কোটি ২০ লাখ ৪৮ হাজার ৬৬০ টাকা।
নিয়ম অনুযায়ী, কর্মচারীদের বেতন সরাসরি তাদের ব্যক্তিগত ব্যাংক অ্যাকাউন্টে দেওয়ার কথা। কিন্তু মোবারক স্থানীয় প্রভাব খাটিয়ে কর্মচারীদের থেকে স্বাক্ষরিত খালি চেক বই নিয়ে নিজ প্রতিষ্ঠানের নামে বিল করতেন। টাকা জমা হতো তাদের অ্যাকাউন্টে, পরে নিজেই উত্তোলন করে শাপলা চত্বরের অফিসে ডেকে এনে কর্মচারীদের হাতে নগদ টাকা দিতেন।
অভিযোগ রয়েছে, এসব চেক কোনো কর্মচারীর নিজের হাতে লেখা নয়, বরং একচ্ছত্রভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হতো মোবারকের পক্ষ থেকে।
এই প্রতারণা ফাঁস হলে আউটসোর্সিং কর্মচারীরা মানববন্ধন করে প্রতিবাদ জানান। এর জেরে মোবারক হোসেন ৯ জন কর্মচারীকে চাকরি থেকে বাদ দেন, আর বকেয়া ৯ মাসের বেতনও পরিশোধ করেননি। এখন এই কর্মচারীরা পরিবার নিয়ে অনাহারে-অর্ধাহারে মানবেতর জীবন-যাপন করছেন।
এই অভিযোগগুলো নিয়ে মোবারক হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, ঠিকাদারি কাজের মাধ্যমেই তিনি অর্থ উপার্জন করেছেন, অবৈধভাবে কিছু করেননি। এরপর এই প্রতিবেদককে সংবাদ প্রকাশ না করার অনুরোধ করেন। পরবর্তী সময়ে তার এক বন্ধুর মাধ্যমে ম্যানেজ করারও চেষ্টা করেন।
ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন, মোবারক হোসেনের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলো যথাযথ তদন্ত করা হলে ‘থলের বিড়াল বের হয়ে আসবে।’ তাদের দাবি, দুর্নীতির মাধ্যমে জনগণের ঘামঝরা অর্থ আত্মসাৎকারী মোবারক হোসেনের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হোক এবং তার অবৈধ সম্পদের উৎস খতিয়ে দেখা হোক।
তাদের আরও আশঙ্কা, যদি এমন দুর্নীতিবাজরা স্বাস্থ্য খাত ও পানি উন্নয়ন বোর্ডকে জিম্মি করে রাখে, তাহলে ভবিষ্যতে আর কেউ সেবা পাবে না, কেবল দুর্নীতির পাহাড়ই তৈরি হবে।
আপনার মতামত লিখুন :