ইসরায়েলি বাহিনীর স্থল অভিযানে গাজায় ৩৫৪২ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। এই অভিযান শুরু হওয়ার পর থেকে নিহতের সংখ্যা, ধ্বংসযজ্ঞ, বাস্তুচ্যুতি এবং বেসামরিক নাগরিকদের ওপর লক্ষ্যবস্তু হামলার ফলে ক্রমেই বেড়েছে। ইসরায়েলের স্থল অভিযান ১১ আগস্ট গাজা সিটিতে শুরু হয়। গত ৩৮ দিনে গড়ে প্রতিদিন প্রায় ৯৩ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। গাজার সরকারি মিডিয়া অফিস জানিয়েছে, এ অভিযান বিশেষভাবে উত্তর ও মধ্য গাজা উপত্যকাকে লক্ষ্যবস্তু করে পরিচালিত হয়েছে, যাতে বাসিন্দাদের জোরপূর্বক স্থানান্তর করা যায় এবং নির্ধারিত ‘নিরাপদ মানবিক এলাকা’তেও হামলা চালানো হয়েছে।
ফিলিস্তিনের গাজায় মানবিক পরিস্থিতি যখন চরম আকার ধারণ করেছে, ঠিক সেই মুহূর্তে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়েছিল। এই প্রস্তাবে গাজায় অবিলম্বে এবং স্থায়ী যুদ্ধবিরতি, হামাসের হাতে থাকা বন্দিদের মুক্তি এবং গাজায় মানবিক সাহায্য প্রবেশের ওপর থেকে সব রকম নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার দাবি জানানো হয়েছিল।
কিন্তু বিশ্বজুড়ে ক্রমবর্ধমান চাপ সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র এই প্রস্তাবে ভেটো দিয়েছে। এর মধ্য দিয়ে গাজায় চলমান সংঘাতের প্রায় দুই বছর সময়কালে এ নিয়ে ষষ্ঠবারের মতো যুক্তরাষ্ট্র ভেটো দিল। এতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সামনে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান আরও একবার স্পষ্ট হয়েছে, যেখানে বিশ্বজুড়ে ইসরায়েলের কর্মকা-ের তীব্র নিন্দা জানানো হলেও যুক্তরাষ্ট্র বরাবরই ইসরায়েলের পাশে দাঁড়িয়েছে। বিবিসি, রয়টার্স ও আলজাজিরার প্রতিবেদন অনুযায়ী, নিরাপত্তা পরিষদের ১৫ সদস্যের মধ্যে ১৪টি দেশই প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয়। শুধু যুক্তরাষ্ট্রের ভেটোর কারণে প্রস্তাবটি বাতিল হয়ে যায়। এই ভেটোর পর যুক্তরাষ্ট্রের উপ-মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক দূত মরগান অরটাগাস বলেন, প্রস্তাবটিতে হামাসের নিন্দা জানানো হয়নি এবং ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকারের স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি, যা হামাসের ‘মিথ্যা বয়ানকে’ বৈধতা দেয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা যুক্তরাষ্ট্রের এই সিদ্ধান্তে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন।
ফিলিস্তিনের জাতিসংঘ দূত রিয়াদ মনসুর এই ভেটোকে ‘গভীরভাবে দুঃখজনক ও বেদনাদায়ক’ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেন, এর ফলে নিরাপত্তা পরিষদ গাজায় ‘চলমান নৃশংসতার মুখে তার সঠিক ভূমিকা পালন করতে ব্যর্থ হলো।’ পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত অসীম আহমেদ এই ভেটোকে ‘এক অন্ধকার মুহূর্ত’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, ‘বিশ্ব তাকিয়ে আছে। শিশুদের কান্না আমাদের হৃদয়কে বিদীর্ণ করা উচিত।’ আলজেরিয়ার রাষ্ট্রদূত আমার বেন্দজামা ফিলিস্তিনি জনগণের কাছে ক্ষমা চান। তিনি বলেন, ‘ফিলিস্তিনি ভাই ও বোনেরা, আমাদের ক্ষমা করুন। আমাদের আন্তরিক প্রচেষ্টা প্রত্যাখ্যানের এই প্রাচীরের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে ভেঙে গেছে।’
জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের অধিবেশনে দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের পক্ষে ভোট দেওয়া থেকে বিরত থেকেছে ২২টি সদস্য দেশ। শুক্রবার সংস্থাটির সদর দপ্তরে এই ভোটাভুটি অনুষ্ঠিত হয়। এই ২২ দেশের মধ্যে ১০টি দেশ প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছে। আর ভোটদান থেকে বিরত থেকেছে ১২টি দেশ। আলজাজিরার খবরে বলা হয়েছে, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ শুক্রবার নিউ ইয়র্ক ঘোষণাপত্রের সমর্থনে একটি প্রস্তাবনা পেশ করেছে।
এর লক্ষ্য ছিল দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানকে নিশ্চিত করে ফিলিস্তিনি ইস্যুর সমাধান করা। নিউ ইয়র্ক ঘোষণাপত্র হলো জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গৃহীত একটি ঐতিহাসিক নথি, যা শরণার্থী ও অভিবাসীদের অধিকার রক্ষা ও তাদের জন্য আন্তর্জাতিক সহযোগিতা জোরদারের উদ্দেশ্যে প্রণীত। নিউ ইয়র্ক ঘোষণাপত্রের পক্ষে ওই প্রস্তাবে ভোট দেওয়া থেকে বিরত থেকেছে ২২টি দেশ। এর মধ্যে ১০টি দেশ সরাসরি প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছে। আর ভোটদান থেকে বিরত থাকে ১২টি দেশ। প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছে যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল, আর্জেন্টিনা, হাঙ্গেরি, প্যারাগুয়ে, নাউরু, মাইক্রোনেশিয়া, পালাউ, গিনি ও টোঙ্গা।
২০২৩ সালের অক্টোবরে ইসরায়েল গাজায় সামরিক অভিযান শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত সেখানে ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় ৬৫ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে বলে গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে। এর মধ্যে ৪৩৫ জন অপুষ্টি এবং অনাহারে মারা গেছেন। এমন সংকটময় পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের ভেটো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে গভীর হতাশার জন্ম দিয়েছে এবং এটি জাতিসংঘের কার্যকারিতা ও নৈতিক অবস্থানের ওপর প্রশ্ন তুলেছে।
ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজায় গত ২৪ ঘণ্টায় ইসরায়েলি হামলায় আরও ৩৩ জন নিহত হয়েছেন। এ নিয়ে ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে গাজায় চলা ইসরায়েলি আগ্রাসনে অন্তত ৬৫ হাজার ১৭৪ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। শুক্রবার (১৯ সেপ্টেম্বর) গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এ তথ্য জানিয়েছে।