ডেঙ্গু একটি বিশ্বব্যাপী মশাবাহিত রোগ, যা মূলত গ্রীষ্মম-লীয় এবং উপ-গ্রীষ্মম-লীয় অঞ্চলে প্রচলিত। চলতি বছর বিশ্বে গত বছরের এ সময়ের চেয়ে ডেঙ্গুতে সংক্রমণ ও মৃত্যু দুই-ই কমেছে। কিন্তু বাংলাদেশে এর উলটো চিত্র। বাংলাদেশে এর সংক্রমণ গত বছরের চেয়ে এখন পর্যন্ত প্রায় তিন গুণ বেশি; মৃত্যুর সংখ্যাও বেশি। সংক্রমণের তুলনায় মৃত্যুহার গত বছরের চেয়ে কম হলেও তা এখন বিশ্বে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। আর দক্ষিণ এশিয়ায় এখনো ডেঙ্গুতে সর্বোচ্চ মৃত্যুহার বাংলাদেশে। বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উপাত্ত বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে ডেঙ্গুর সংক্রমণ ও মৃত্যুর উচ্চহার এ রোগ নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতাকেই তুলে ধরে। নিয়ন্ত্রণের কাজে নতুনত্ব কিছু নেই।
আবার সমস্যা সমাধানে কার্যকর তৎপরতাও নেই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, গত বছরের ৩১ জুলাই পর্যন্ত বিশ্বে ডেঙ্গুতে সংক্রমণের সংখ্যা ছিল ১ কোটি ২২ লাখ। এবার এখন পর্যন্ত সংক্রমণ ৩৯ লাখ। গত বছর এ সময় পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যা ৯ হাজার ১০৩। এ বছর মারা গেছে ২ হাজার ৬৯০ জন। কয়েক বছর ধরেই ডেঙ্গু সংক্রমণের দিক থেকে বিশ্বে সর্বোচ্চ অবস্থানে ছিল দক্ষিণ আমেরিকার দেশ ব্রাজিল।
গত বছর শুধু ব্রাজিলেই আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ১ কোটি ২০ লাখ। আর চলতি বছর তা ৩০ লাখে পৌঁছেছে। ব্রাজিলে ডেঙ্গু সংক্রমণ কমে যাওয়ার সঙ্গে বৈশ্বিকভাবে ডেঙ্গু কমার সরাসরি সম্পর্ক আছে বলে মনে করেন যুক্তরাজ্যের কেইল ইউনিভার্সিটির মশাবাহিত রোগের গবেষক ও বাংলাদেশি বিজ্ঞানী নাজমুল হায়দার। প্রতিবছর বিশ্বজুড়ে লাখ লাখ মানুষ এতে আক্রান্ত হয় এবং উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ মারা যায়, বিশেষত এশিয়া, আফ্রিকা এবং ল্যাটিন আমেরিকার মতো অঞ্চলগুলোয় এর প্রকোপ বেশি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ডেঙ্গুকে একটি মারাত্মক জনস্বাস্থ্য ঝুঁকি হিসেবে চিহ্নিত করেছে। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আশার আলো দেখাচ্ছে ব্রাজিলের একটি বায়ো কোম্পানি।
প্রজনন ঘটানো হচ্ছে ওলবাকিয়া ব্যাকটেরিয়াবাহী বিশেষ ধরনের মশার, যা ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার মতো রোগ ঠেকিয়ে দিতে সক্ষম বলে দাবি করা হচ্ছে। ২০২৪ সাল থেকে চালু হওয়া কোম্পানির কার্যক্রমে প্রাণ বেঁচেছে ব্রাজিলের অন্তত পাঁচ লাখ মানুষের। সামনের দিনগুলোয় বিশাল জনগোষ্ঠীর এ দেশটির মানুষের জীবন বাঁচাতে কাজের পরিধি বাড়াতে চায় প্রতিষ্ঠানটি। চিকিৎসা বিজ্ঞানের বহুল প্রচলিত একটি উক্তি হলো - প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ উত্তম। আর এটিই করে দেখাচ্ছে লাতিন আমেরিকার দেশ ব্রাজিলের ‘ওলবিটো ডো প্ল্যান্ট’ নামে একটি বায়ো কোম্পানি। বিশ্বব্যাপী আতঙ্ক ছড়ানো এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে ২০১৪ সাল থেকে কাজ করছে প্রতিষ্ঠানটি। প্রজনন ঘটানো হচ্ছে ব্যাকটেরিয়াবাহী বিশেষ এক ধরনের মশার, যা ডেঙ্গু প্রতিরোধে সক্ষম।প্লান্ট থেকে ডিম্বাণু সংগ্রহের পর বিজ্ঞানীরা এটিকে ধাপে ধাপে বড় করে তোলেন । লাভা ও কিউবা পর্যায় থেকে পরিণত হতে পাঁচ থেকে ছয় দিন লাগে মশাগুলোর। আর এই পুরো প্রক্রিয়াটি পরিকল্পনা মাফিক সম্পাদন করে বিজ্ঞানীরা।
ওলবিটো ডো ব্রাজিল প্ল্যান্টের উৎপাদন সমন্বয় বিভাগের মারলিন সালাজার বলেন, ‘মশাগুলো যখন লার্ভা অবস্থায় থাকে, তখন সেগুলোকে খাবার দেই। এরপর এগুলো যখন পিউপা ধাপে পৌঁছায় তখন লিঙ্গভেদে আমরা নারী ও পুরুষ মশাগুলোকে আলাদা করি। এরপর এগুলোকে খাঁচায় রাখি এবং খাবার দিতে থাকি। একপর্যায়ে এগুলো পরিণত পর্যায়ে পৌঁছালে রাস্তায় ছেড়ে দেই।’ ব্রাজিলের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, কীটতত্ত্ববিদ ও রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের সঙ্গে যৌথ তত্ত্বাবধানে কাজ করে কোম্পানিটি।
ব্রাজিলের যেসকল এলাকা ডেঙ্গুর হটস্পট সাধারণত সেসব এলাকায় পাঠানো হয় ওলবাকিয়া ব্যাকটেরিয়াবাহী মশাগুলো। এরপর সাধারণ মশাগুলোর সঙ্গে প্রজননের মাধ্যমে ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়ার মতো ভাইরাসবাহী রোগ প্রতিরোধ করে এটি। ডেঙ্গুজ্বরের কবল থেকে ব্রাজিলবাসীকে বাঁচাতে সামনের দিনগুলোতে উৎপাদন বাড়াতে চায় কোম্পানিটির সিইও।ওলবিটো ডো ব্রাজিল প্ল্যান্টের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা লুসিয়ানো মোরেরা বলেন, ‘আমরা সপ্তাহে ১০০ মিলিয়ন ওলবাকিয়া মশার ডিম্বাণু উৎপাদন করতে চাই। যাতে প্রতি ছয় মাসে দেশের অন্তত ৭০ লাখ মানুষকে আমরা ডেঙ্গু থেকে বাঁচাতে পারি।’বিশেষ এ মশার প্রজনন প্রক্রিয়া নিয়ে সমালোচনা থাকলেও, এটি মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর নয় বলে দাবি করেছেন ওলবিটো ডো ব্রাজিল প্ল্যান্টের উৎপাদন বিভাগের এক কর্মকর্তা।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন