দেশে ৫০ হাজার মেগাওয়াটের বেশি সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে। এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর কথা দীর্ঘদিন যাবত বলে আসছেন ব্যবসায়ীরা। কিন্তু কাজের কাজ তেমন আগায়নি। বরং আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিশেষ আইনের সুবিধা দিয়ে পছন্দমতো কোম্পানির উচ্চমূল্যের দরপত্র অনুমোদন করে। যা বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে এসে অর্ধেকের কম দামে পেতে যাচ্ছে কোম্পানিগুলো। জামালপুরসহ প্রায় দেশের বিভিন্ন স্থানে শতাধিক সৌরবিদ্যুৎ নির্মাণে ইতোমধ্যে দরপত্র হয়ে গেছে। যার মূল্যায়ন চলছে এখন।
বিশ্লেষণে দেখা গেছে, সৌরবিদ্যুৎ খাতকে ব্যবহার করে আওয়ামী লীগ সরকার দুর্নীতির চরম পর্যায়ে পৌঁছানোর লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছিল। রাজনৈতিক বিবেচনায় বিশেষ আইনে দলীয় লোকদের সৌর প্রকল্পের কাজ দেওয়া হয়। নিজেদের মতো করে দাম নির্ধারণ করা হয়।
অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পরপরই বিদ্যুতের বিশেষ আইন বাতিল করে প্রতিয়োগিতামূলক দরপত্রের মাধ্যমে প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়। ফলে এই খাতের সব কাজই খোলা দরপত্রের মাধ্যমে হচ্ছে। বিদ্যুৎ বিভাগের পাওয়া তথ্যমতে, দেশের বিভিন্ন স্থানে সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে ৪টি লটে প্রায় ৪০টি কোম্পানি আবেদন করেছে। যেখানে কিলোওয়াটপ্রতি উৎপাদন খরচ কমে এসেছে অর্ধেকেরও কম। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের বিশেষ আইনের অধীনে এলওআই (লেটার অব ইনটেন্ট) ইস্যু করা ৩১টি সৌর বিদ্যুৎ প্রকল্পের চাইতে উৎপাদন খরচ গড়ে ২১ শতাংশ কম। কিলোওয়াটপ্রতি গড় ব্যয় ১০ দশমিক ৪৭ সেন্ট (মার্কিন ডলার) থেকে কমে আট দশমিক ২৭ সেন্ট হয়েছে। সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে মোট বিদ্যুতের ২০ শতাংশ নবায়নযোগ্য খাত থেকে উৎপাদনের লক্ষ্য বাস্তবায়নে অন্তর্বর্তী সরকার নতুন করে মোট পাঁচ হাজার ২৩৮ মেগাওয়াট ক্ষমতার একাধিক কেন্দ্রের জন্য দরপত্র আহ্বান করে। দরপত্রে অংশ নেওয়া বিভিন্ন কোম্পানির প্রস্তাবনা বিশ্লেষণ করে এই তথ্য জানা গেছে।
এদিকে খাতসংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিগত সরকারের আমলে দুর্নীতির কারণে সৌর বিদ্যুতের ব্যয় বেড়ে যায়। রাজনৈতিক বিবেচনায় বিশেষ আইনে দলীয় লোকদের সৌর প্রকল্পের কাজ দেওয়া হয়। নিজেদের মতো করে দাম নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র আহ্বান করায় এই ব্যয় হ্রাস পাচ্ছে। ফলে জনগণ কম দামের সৌর বিদ্যুৎ পাবে। সরকারের ভর্তুকি কমবে। ফলে বর্তমান সরকারের উচিত হবে তাদের মেয়াদেই আহ্বান করা দরপত্রের বিপরীতে কম দরদাতা কোম্পানিগুলোকে কাজ দিয়ে দেওয়া। নইলে রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় এলে এই ব্যয় বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) সূত্রে জানা গেছে, ৫ হাজার ২৩৮ মেগাওয়াটের ৫৫টি সৌর বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য ২০২৪ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২৫ সালের মার্চের মধ্যে চারটি টেন্ডার প্যাকেজ আহ্বান করা হয়। এর মধ্যে ঢাকা ও খুলনার জন্য আহ্বান করা দরপত্র এখনো খোলা হয়নি। এ ছাড়া উত্তরবঙ্গ, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহের জন্য আহ্বান করা দরপত্র খোলা হয়েছে। উন্মুক্ত করা দরপত্রে একাধিক প্রতিযোগিতামূলক প্রস্তাব জমা পড়েছে।
রূপালী বাংলাদেশের হাতে আসা দরপ্রস্তাবগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, উত্তরবঙ্গে সৌর বিদ্যুতের জন্য কিলোওয়াটপ্রতি দর প্রস্তাব করা হয়েছে ৭ দশমিক ৮৯ সেন্ট, চট্টগ্রামের জন্য ৭ দশমিক ৯৫ সেন্ট, ময়মনসিংহের জন্য ৮ দশমিক ৮৮ সেন্ট এবং সিলেটের জন্য ৯ দশমিক ০৬ সেন্ট। যেখানে বিগত সরকারের আমলে বিশেষ আইনে উত্তরবঙ্গের জন্য দর প্রস্তাব করা হয়েছিল ১০ দশমিক ৪২ সেন্ট, চট্টগ্রামের জন্য ১২ দশমিক ১০ সেন্ট, ময়মনসিংহের জন্য ৯ দশমিক ৯৩ সেন্ট এবং সিলেটের জন্য ৯ দশমিক ৮৮ সেন্ট।
কেন্দ্র অনুযায়ী দরপ্রস্তাব বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, নোয়াখালীর সুধারামে ১০ মেগাওয়াট ক্ষমতার সৌর বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য কিলোওয়াটপ্রতি দর প্রস্তাব করা হয়েছে ৭ দশমিক ৪৯ সেন্ট, মৌলভীবাজারের ২৫ মেগাওয়াট ক্ষমতার কেন্দ্রের জন্য ৭ দশমিক ৬৭ সেন্ট, চট্টগ্রামের ফটিকছড়িতে দুইশ মেগাওয়াট ক্ষমতার কেন্দ্রের জন্য ৭ দশমিক ৭৫ সেন্ট, একই জায়গায় ৪৫ মেগাওয়াট কেন্দ্রের জন্য ৭ দশমিক ৭৭ সেন্ট, দেড়শ মেগাওয়াট ক্ষমতার পাবনা কেন্দ্রের জন্য ৭ দশমিক ৮৯ সেন্ট, চট্টগ্রামের হাটহাজারী ১৮ মেগাওয়াট ক্ষমতার কেন্দ্রের জন্য ৭ দশমিক ৯৭ সেন্ট, ৩০ মেগাওয়াট ক্ষমতার লোহাগাড়া কেন্দ্রের জন্য ৮ দশমিক ৮৭ সেন্ট, ২৫ মেগাওয়াটি ক্ষমতার কাপ্তাই কেন্দ্রের জন্য ৮ দশমিক ৮৮ সেন্ট, ময়মনসিংহের ভালুকাতে ৪৫ মেগাওয়াট ক্ষমতার কেন্দ্রের জন্য ৮ দশমিক ৮৮ সেন্ট এবং মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে ১৫০ মেগাওয়াট কেন্দ্রের জন্য ৯ দশমিক ২৯ সেন্ট প্রস্তাব করা হয়েছে।
এমনকি বর্তমানে বিভিন্ন জ্বালানি ব্যবহার করে যে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়, এর মধ্যে কয়লা ছাড়া অন্যান্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচের চাইতে কম ব্যয়ের প্রস্তাব করা হয়েছে সৌর বিদ্যুৎ প্রকল্পগুলোতে। বর্তমানে কয়লাভিত্তিক কেন্দ্রগুলো থেকে কিলোওয়াট প্রতি গড় ব্যয় ৫ দশমিক ৪৭ সেন্ট। বিগত সরকারের আমলে নেওয়া সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর কিলোওয়াটপ্রতি গড় ব্যয় ১৩ দশমিক ২৯ সেন্ট, এলএনজিতে কিলোওয়াট প্রতি গড় ব্যয় ৮ দশমিক ৪৩ থেকে ৯ দশমিক ৩৬ সেন্ট এবং ডিজেলে কিলোওয়াটপ্রতি ব্যয় ১৪ থেকে ১৫ দশমিক ০৩ সেন্ট। এর বিপরীতে দরপত্রে আহ্বান করা সৌর বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর কিলোওয়াটপ্রতি গড় ব্যয় ৮ দশমিক ২৭ সেন্ট প্রস্তাব করা হয়েছিল।
বর্তমান সরকার এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে এসে খোলা দরপত্র আহ্বান করায় দাম অনেক কমে এসেছে উল্লেখ করে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, এই খাতে বিগত ১৫ বছরে যে লুটপাট হয়েছে তা আর কোনো সরকারের আমলে হয়নি। বিশেষ আইন বাতিলের কারণে সব দরপত্র খোলা থাকায় যে কেউ অংশ নিতে পারছে। তাই সর্বনিম্ন দরদাতা পাওয়া যাচ্ছে। এখন দরপত্রের বিশ্লেষণ চলছে। এরপরই বলা যাবে আওয়ামী লীগ সরকার শুধু বিদ্যুৎ খাত থেকে জনগণকে কী পরিমাণ শোষণ করেছে।
বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের সৌরশক্তির তুলনামূলক বিশ্লেষণ থেকে দেখা যায়, জার্মানির যেকোনো জায়গায় সূর্য থেকে আসা সর্বোচ্চ সৌরশক্তিও বাংলাদেশের চেয়ে কম বা অর্ধেক। জার্মানি কয়লা ও পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো পর্যায়ক্রমে বন্ধ করে দিয়ে প্রতিদিন ২৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সৌরশক্তিসহ অন্যান্য নবায়নযোগ্য উৎস থেকে উৎপাদন করছে। বাংলাদেশ তার চেয়ে অনেক সুবিধাজনক অবস্থানে থেকেও কেন প্রয়োজনীয় ১০ থেকে ১১ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সৌরশক্তিসহ অন্যান্য নবায়নযোগ্য উৎস থেকে উৎপাদন করতে পারবে না? দেশে বাতাস থেকে ১ হাজার এবং বর্জ্য থেকে ৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে। এদিকে মনোযোগ বাড়ালে বিদ্যুৎ উৎপাদনে আমাদের পরনির্ভরশীলতা দূর হয়ে যাবে।
এ প্রসঙ্গে বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্র মালিক সমিতি বাংলাদেশ ইন্ডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিপ্পা) সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট গোলাম রাব্বানী রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, দাম কমে আসার কারণ হচ্ছে, এখন আমরা দেশীয় কোম্পানির সক্ষমতা বেড়েছে। পাশাপাশি এখন ইপিসি দেশীয় কোম্পানিগুলোই করে থাকে। আন্তর্জাতিক বাজারে সোলার প্রডাক্টের দাম কমেছে। ব্যাটারির দাম কমেছে। এ ছাড়া প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র হওয়ার কারণে দামে একটা প্রভাব পড়েছে। তিনি আরও বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত হবে এসব কেন্দ্রের অ্যাওয়ার্ড দিয়ে দেওয়া। কারণ নতুন সরকার এসে রেগুলার হতে হতে এক বছর সময় লেগে যাবে। তখন এসব প্রকল্প পিছিয়ে যেতে পারে।
আওয়ামী লীগ সরকারের তুলনায় ঠিক কত শতাংশ দাম কমেছে বর্তমানে প্রস্তাবিত দরপত্রগুলোতে এমন প্রশ্নের উত্তরে পিডিবির চেয়ারম্যান রেজাউল করিম রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ৪টি লটে প্রায় ৪০টি দরপত্র জমা পড়েছে। প্রত্যেকটি বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। এখনই যদি আমরা দাম প্রকাশ করে ফেলি তাহলে কোম্পানিগুলোর প্রতি অন্যায় হবে। তবে এটা ঠিক সবনিম্ন দরদাতাই কাজ পাবে।
জানা যায়, দেশে বছরে গড়ে ২,২০০-৩,০০০ ঘণ্টা সূর্যালোক পাওয়া যায়। দৈনিক গড়ে ৪৬.৫ কিলোওয়াট-ঘণ্টা সৌর বিকিরণ বিদ্যমান। দেশের প্রায় সব অঞ্চলেই সমানভাবে সূর্যালোক পাওয়া যায়, বিশেষত উত্তরাঞ্চল ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সম্ভাবনা বেশি। গ্রামীণ অঞ্চলে প্রায় ৬ মিলিয়নের বেশি পরিবার সৌর হোম সিস্টেম ব্যবহার করছে, যা বিশ্বে অন্যতম বৃহৎ প্রোগ্রাম। সরকার ইতিমধ্যে কয়েকশ মেগাওয়াট সৌর বিদ্যুৎ গ্রিডে যুক্ত করেছে। ঘরোয়া, বাণিজ্যিক ও শিল্প কারখানায় সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদন করে গ্রিডে যোগ করার সুযোগ দিচ্ছে। ২০৩০ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য জ্বালানির মাধ্যমে ৪০ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে। বর্তমানে প্রায় ১,২০০ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ চলছে।
তবে এসব ক্ষেত্রে কিছু প্রতিবন্ধকতা রয়েছে উল্লেখ করে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ম তামিম রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের সময় সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো নির্মাণে যে দরপ্রস্তাব ছিল এখন আমরা জানতে পেরেছি তার থেকে বেশ কমে বিভিন্ন কোম্পানি দরপত্র জমা দিয়েছে। এটি সম্ভব হয়েছে উন্মুক্ত দরপত্র পদ্ধতি বাস্তবায়নের কারণে। এটি অবশ্যই দেশের জন্য ভালো। তবে সৌর বিদ্যুৎ নির্মাণে আমাদের বেশকিছু প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। বিশেষ করে বৃহৎ সৌর প্ল্যান্ট বসানোর জন্য পর্যাপ্ত জমি পাওয়া কঠিন। উচ্চ প্রাথমিক খরচ এখনো প্রতিবন্ধক। দক্ষ জনশক্তি ও প্রযুক্তি সরবরাহও সীমিত। বৃহৎ পরিমাণ সৌরবিদ্যুৎ যুক্ত করলে বিদ্যুৎ ব্যবস্থাপনায় ভারসাম্য রাখতে বাড়তি প্রযুক্তি প্রয়োজন।
দেশের অফ-গ্রিড এলাকায় (চর, হাওর, পার্বত্য অঞ্চল) সৌরবিদ্যুৎই সবচেয়ে কার্যকর সমাধান উল্লেখ করে তিনি বলেন, শিল্প কারখানায় রুফটপ সোলার (ছাদে সৌরপ্যানেল) ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা গেলে বিদ্যুৎ উৎপাদনে বড় অবদান রাখতে পারে। এক্ষেত্রে কৃষি খাতেও সৌরচালিত সেচপাম্প ব্যবহারে ডিজেলের ওপর নির্ভরতা কমবে। ফ্লোটিং সোলার প্রজেক্ট (পানি ও জলাধারে সৌরপ্যানেল বসানো) নতুন সুযোগ তৈরি করতে পারে।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন