যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধিতা। তার মধ্যেই পশ্চিমা দুনিয়ায় ফিলিস্তিনের পালে লেগেছে হাওয়া। ফ্রান্স, কানাডার পর যুক্তরাজ্যও ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। জাতিসংঘের ১৯৩টি সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে ১৫৯টি সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিলেও ফিলিস্তিন এখনো বিশ্ব সংস্থাটির পূর্ণ সদস্য নয়। ২০১২ সাল থেকে পর্যবেক্ষক সদস্যের মর্যাদা নিয়ে আছে দেশটি। আর তার কারণ নিরাপত্তা পরিষদের ভেটো ক্ষমতাধর রাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্রের আপত্তি। ১৯৩৩ সালের মন্টিভিডিও কনভেনশন অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য কয়েকটি মানদ- রয়েছে। একটি রাষ্ট্রের জন্য প্রয়োজন- একটি স্থায়ী জনসংখ্যা; একটি নির্দিষ্ট ভূখ-; একটি কার্যকর সরকার; আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, দূতাবাস, রাষ্ট্রদূত এবং চুক্তিসহ আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক প্রক্রিয়া চালানোর সক্ষমতা। নিরাপত্তা পরিষদে ভেটো ক্ষমতাধর রাশিয়া ও চীন, ইউরোপের এক ডজনেরও বেশি দেশ ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দিয়েছে। বাংলাদেশের পাশাপাশি ভারতও স্বীকৃতি দিয়েছে ফিলিস্তিনকে।
কাগজে-কলমে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র বলে কিছু নেই। তবে রাষ্ট্র হিসেবে বহু দেশ এই ভূখ-কে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দিয়েছে, বিভিন্ন দেশে এই দেশের কূটনৈতিক মিশনও রয়েছে। অলিম্পিকসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণও করে তারা। কিন্তু ইসরায়েলের সাথে ফিলিস্তিনের দীর্ঘ সময়ের বিরোধের কারণে ফিলিস্তিনের কোনো আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সীমানা, রাজধানী বা সেনাবাহিনী নেই। পশ্চিম তীরে ইসরায়েলের সেনাবাহিনীর বহু বছরের দখলদারত্ব চলার পর ১৯৯০-এর দশকে ‘প্যালেস্টিনিয়ান অথরিটি’ বা ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠিত হয়, যাদের ওই ভূখ- ও সেখানে বসবাসরত মানুষের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেই। ইসরায়েলের আগ্রাসনে গাজা এখন যুদ্ধক্ষেত্র। কাজেই এই পরিস্থিতিতে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়া অনেকটাই প্রতীকী। নৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে বিবেচনা করলে এটি বেশ শক্ত পদক্ষেপ, কিন্তু বাস্তবতা হলোÑ এই সিদ্ধান্তে ফিলিস্তিনের পরিস্থিতি খুব একটা পরিবর্তন হবে না।
ফিলিস্তিনিদের কাছে সবচেয়ে জনপ্রিয় সম্ভাব্য নেতা হলেন মারওয়ান বারঘুতি। তিনি ২০০২ সাল থেকে ইসরায়েলি কারাগারে বন্দি রয়েছেন। সাম্প্রতিক এক জনমত জরিপে দেখা গেছে, ৫০% ফিলিস্তিনি বারঘুতিকে তাদের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দেখতে চান। যুক্তরাজ্য, কানাডা এবং অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশগুলো ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ায় বিষয়টি নতুন করে আন্তর্জাতিক মহলে আলোচনায় এসেছে। এর আগে ১৫৯টিরও বেশি দেশ ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিলেও এই তিন দেশের পদক্ষেপকে অনেকেই তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন। তবে এই স্বীকৃতি ফিলিস্তিনের সামনে বেশ কিছু জটিল প্রশ্ন তৈরি করেছে, যার মধ্যে অন্যতম হলোÑ কে হবেন এই সম্ভাব্য রাষ্ট্রের নেতা? ফিলিস্তিনে রয়েছে স্থায়ী জনসংখ্যা। তবে গাজার চলমান যুদ্ধ এই জনসংখ্যাকে বিশাল ঝুঁকির মুখে ফেলেছে। এ ছাড়া, অন্য রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক প্রসঙ্গে ফিলিস্তিনি কূটনীতিক হুসাম জমলতের মতো ব্যক্তিরা বলছেন, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক স্থাপনের সক্ষমতা তাদের আছে। নির্দিষ্ট ভূখ-ই এখন ফিলিস্তিনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
ফিলিস্তিনিদের কাক্সিক্ষত রাষ্ট্র পূর্ব জেরুজালেম, পশ্চিম তীর এবং গাজা উপত্যকা নিয়ে গঠিত হলেও, ১৯৬৭ সালের ছয় দিনের যুদ্ধের পর থেকে ইসরায়েল এই এলাকাগুলো দখল করে রেখেছে। পশ্চিম তীর ও গাজার মধ্যে ভৌগোলিক বিভাজন প্রায় ৭৫ বছর ধরে চলে আসছে এবং পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী ও বসতি স্থাপনকারীদের উপস্থিতির কারণে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ মাত্র ৪০% ভূখ- নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।
গাজার সাম্প্রতিক যুদ্ধে হামাসের ক্ষমতা ব্যাপকভাবে হ্রাস পেলেও, আন্তর্জাতিক মহল এবং আরব দেশগুলো স্পষ্ট করে জানিয়েছে যে, ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের সরকারে হামাসের কোনো ভূমিকা থাকবে না। হামাস নিজেও একটি টেকনোক্র্যাট সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের আগ্রহ প্রকাশ করেছে। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বরাবরই ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের ঘোর বিরোধী। তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন, ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র হলে তা ইসরায়েলের অস্তিত্বের জন্য হুমকি হবে। তিনি ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের গাজার শাসনে ফেরার বিপক্ষেও মত দিয়েছেন। এই পরিস্থিতিতে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়া দেশগুলোর সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলোÑ এই বিরোধিতার মুখেও শান্তি প্রক্রিয়ার অগ্রগতি ধরে রাখা। ফিলিস্তিনিরা এখন শুধু স্বীকৃতির প্রতীকী অর্থের চেয়ে আরও বেশি কিছু চায়। তারা চায় চলমান সংঘাত বন্ধ হোক এবং একটি সত্যিকারের কার্যকরী রাষ্ট্র গঠনের জন্য বাস্তব পদক্ষেপ নেওয়া হোক।
ফিলিস্তিনকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে একযোগে পশ্চিমা শক্তিধর দেশগুলোর স্বীকৃতিকে সাধুবাদ জানিয়েছে সৌদি আরব, কাতারসহ আরব দেশগুলো। রোববার এক প্রতিবেদনে বিষয়টি নিশ্চিত করেছে বার্তাসংস্থা আনাদোলু এজেন্সি। এতে বলা হয়, আরব দেশ এবং সংস্থাগুলো যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া এবং পর্তুগালসহ পশ্চিমা দেশগুলোর এই আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতিকে স্বাগত জানিয়েছে। সৌদি আরব এই পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়ে বলে, পদক্ষেপটি মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি নিশ্চিতে পশ্চিমা দেশগুলোর সমর্থন ও অঙ্গীকারকে তুলে ধরেছে। সেই সাথে, জাতিসংঘের বৈধ প্রস্তাবের ভিত্তিতে দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধানকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য দেশগুলোর প্রতিশ্রুতির প্রতিফলন ঘটেছে।
কুয়েতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে এই স্বীকৃতির প্রশংসা করে জানানো হয়, এটি অঞ্চলটিতে শান্তির সম্ভাবনা বৃদ্ধি এবং দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধানের লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টাকে এগিয়ে নিতে অবদান রাখবে। সেই সাথে এই অঞ্চলের নিরাপত্তা, স্থিতিশীলতা এবং সমৃদ্ধি বজায় রাখার জন্য অন্যান্য দেশকেও একইভাবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়ারও আহ্বান জানানো হয়। ফিলিস্তিনের গাজায় ৪৮ ইসরায়েলি জিম্মির ছবি প্রকাশ করেছে ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠন (হামাস)। সংগঠনটির দাবি, যদি ইসরায়েল গাজায় স্থল অভিযান অব্যাহত রাখে, তাহলে এই জিম্মিরা বিপদের মধ্যে পড়বেন।
এর আগে, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামাসের হামলায় প্রায় ১ হাজার ২০০ জন নিহত হন। ইসরায়েল থেকে জিম্মি করে গাজায় নিয়ে যাওয়া হয় ২৫১ জনকে। ইসরায়েলি বাহিনীর তথ্য মতে, তাঁদের মধ্যে ৪৭ জন এখনো গাজায় রয়েছেন। এর মধ্যে ২৫ জন মারা গেছেন। যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও পর্তুগালের ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতির প্রতিক্রিয়ায় ইসরায়েলের হুঁশিয়ারির জবাবে পাল্টা হুমকি দিল যুক্তরাজ্য। ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইয়েভেট কুপার সতর্ক করে বলেন, পশ্চিম তীরের কোনো ভূমি নতুন করে দখল করলে ইসরায়েলের পরিণতি হবে ভয়াবহ। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দেওয়ার আগে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসিকে এ তথ্য জানিয়েছেন ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইয়েভেট কুপার।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন