গাজায় চলমান আগ্রাসন ও মানবিক বিপর্যয়ের কারণে বিশ্বমঞ্চে ক্রমেই একঘরে হয়ে পড়ছে ইসরায়েল। এর প্রভাব শুধু কূটনৈতিক ক্ষেত্রে নয়, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, বিনোদন ও খেলাধুলার অঙ্গনেও ছড়িয়ে পড়েছে। বিশেষ করে গাজা সিটিতে ইসরায়েলের সামরিক আগ্রাসন এবং কাতারের মাটিতে হামাস নেতাদের ওপর হামলার ঘটনায় আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া তীব্র হয়ে উঠেছে। রবিবার যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যম সিএনএনের এক প্রতিবেদনে ইসরায়েলের একঘরে হয়ে পড়ার বিভিন্ন প্রেক্ষাপট তুলে ধরা হয়। এদিকে ফিলিস্তিনের গাজায় হাসপাতালে ইসরায়েলি বাহিনীর বোমা হামলায় এক দিনে অন্তত ৭৯ জন প্রাণ হারিয়েছেন। সোমবার ভোরের পর থেকে গাজায় মৃতের সংখ্যা ২৯ জনে পৌঁছেছে। গত ২৪ ঘণ্টায় গাজায় ইসরায়েলের ৫০ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। গাজা সিটিতে অবস্থিত হাসপাতাল ও আবাসিক ভবনে ব্যাপক হামলা চালানো হয়েছে। সোমবার (২৯ সেপ্টেম্বর) আলজাজিরা ও রয়টার্সের প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য জানা গেছে। রবিবার আল-শিফা হাসপাতালের পরিচালক হাসান আল-শায়ির ‘ভয়ংকর দৃশ্য’ বর্ণনা করেন। তিনি জানান, হাসপাতালটিতে অন্তত ১০০ জন্য রোগী ছিল। তাদের জরুরি চিকিৎসা দেওয়ার প্রয়োজন ছিল। তারা ভয়ে চিকিৎসা বাদ দিয়ে পালাতে বাধ্য হন। ফিলিস্তিনি মানবাধিকার কেন্দ্রের গবেষকরা নিশ্চিত করেছেন যে, ইসরায়েল ফায়ার বেল্ট ব্যবহার করেছে যা থেকে ব্যাপক অগ্নি সংযোগ হয়। ইসরাইলের সামরিক বাহিনী হাসপাতালের উত্তর ও পূর্ব দিক থেকে সামরিক ইউনিটগুলি অগ্রসর হওয়ার সঙ্গে হাসপাতালের চারপাশে বিস্ফোরক বোঝাই যানবাহনও মোতায়েন করেছিল।
ফিলিস্তিনি ওয়াফা সংবাদ সংস্থা জানিয়েছে, ইসরায়েলি সেনাবাহিনী গাজা শহরের আল হেলু হাসপাতাল নামে আরেকটি চিকিৎসাকেন্দ্রে গোলাবর্ষণ করেছে, যেখানে একটি ক্যান্সার ওয়ার্ড এবং একটি নবজাতক ইউনিট রয়েছে। সেখানে ১২ জন নবজাতক শিশুর চিকিৎসা করা হচ্ছে। চিকিৎসাকর্মীরা ওয়াফাকে জানিয়েছেন যে, ইসরায়েলি ট্যাংকগুলো হাসপাতালের চারপাশে আটকা পড়ে আছে। যার ফলে হাসপাতালে প্রবেশ এবং প্রস্থান উভয়ই বন্ধ হয়ে গেছে। চিকিৎসক, নার্স এবং রোগীসহ ৯০ জনেরও বেশি মানুষ হাসপাতালে আটকা পড়েছে। সম্প্রতি জাতিসংঘের এক স্বাধীন তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গাজায় ইসরায়েল যে আগ্রাসন চালিয়েছে, তা গণহত্যার পর্যায়ে পড়ে। এই অবস্থায় ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইসরায়েলের সঙ্গে বিদ্যমান মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির আংশিক স্থগিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ইতোমধ্যে যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, ইতালি, স্পেন, নেদারল্যান্ডসসহ একাধিক পশ্চিমা দেশ ইসরায়েলের নির্দিষ্ট কিছু ব্যক্তি, বসতি স্থাপনকারী ও সহিংস কর্মকা-ের সমর্থনকারী সংগঠনের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।
গাজায় চলমান মানবিক বিপর্যয়ের কারণে বিশ্বের সবচেয়ে বড় রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ তহবিল হিসেবে খ্যাত নরওয়ের সার্বভৌম তহবিল গত আগস্টে ইসরায়েলি কোম্পানিতে বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে নেয়। এ ছাড়া ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, স্পেন এবং অন্যান্য দেশ ইসরায়েলের ওপর আংশিক বা পূর্ণ অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে।
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সাম্প্রতিক অধিবেশনে ইসরায়েলের প্রতি সমর্থন হ্রাস পেয়েছে। কানাডা, ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিয়েছে। ইসরায়েলের ঘনিষ্ঠ মিত্র দেশগুলোও এখন ভোটদানে বিরত থাকছে বা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ভোট দিচ্ছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র এখনো দৃঢ়ভাবে ইসরায়েলের পাশে রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও বলেন, ‘আমরা ইসরায়েলের কিছু কার্যক্রমে অখুশি হলেও, সম্পর্ক অটুট থাকবে।’ এদিকে, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) গ্রেপ্তারি পরোয়ানার কারণে নেতানিয়াহুর চলাচলেও বাধা সৃষ্টি হচ্ছে। জাতিসংঘ অধিবেশনে যোগ দিতে তিনি ফ্রান্স ও স্পেনের আকাশসীমা এড়িয়ে নিউইয়র্ক যান, যাতে গ্রেপ্তার হওয়ার ঝুঁকি না থাকে। ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় যুদ্ধবিরতি চুক্তি হওয়ার সম্ভাবনা জোরালো হয়েছে। গতকাল সোমবার (২৯ সেপ্টেম্বর) যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বৈঠকে বসেন। তাদের এ বৈঠকের পর সংবাদ সম্মেলন হবে।
সংবাদমাধ্যম টাইমস অব ইসরায়েল জানিয়েছে, এই সংবাদ সম্মেলন আয়োজনের বিষয়টি ইঙ্গিত দিচ্ছে ট্রাম্প প্রশাসন ঘোষণা দিতে পারে, গাজায় যুদ্ধ বন্ধের চুক্তিতে সবাই সম্মত হয়েছে। চুক্তিটি হলে গাজাভিত্তিক সশস্ত্রগোষ্ঠী হামাস জিম্মিদের মুক্তি দেবে। গাজায় যুদ্ধ-পরবর্তী সরকার কেমন হবে, কীভাবে গাজা চলবে সে ব্যাপারে নিজের পরিকল্পনা তুলে ধরেছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। নিজের এ পরিকল্পনায় আরব ও মুসলিম নেতাদের সমর্থন পেয়েছেন তিনি। অবশ্য গত রোববার ইসরায়েল জানায়, গাজার যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব নিয়ে তারা এখনো ভাবছে। অপরদিকে হামাস জানায়, আনুষ্ঠানিকভাবে তারা চুক্তির কোনো কাগজপত্র পায়নি। তা সত্ত্বেও গাজার যুদ্ধবিরতির সম্ভাবনা জোরালো হয়েছে। কারণ ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ নেতানিয়াহুর সঙ্গে প্রায় দুই ঘণ্টাব্যাপী আলোচনা করেন।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন