১৭ বছরের বেশি সময় ধরে ব্যাংক মালিকদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্সের (বিএবি) শীর্ষ পদ দখলে রেখেছিলেন নাসা গ্রুপের কর্ণধার নজরুল ইসলাম মজুমদার। ব্যাংক মালিকদের শীর্ষ পদ দখলে রেখেই বিভিন্ন ব্যাংক থেকে প্রভাব খাটিয়ে বের করে নিয়েছেন হাজার হাজার কোটি টাকা।
এর মধ্যে ইসলামী ব্যাংকের এক শাখা থেকেই ২ হাজার কোটি টাকা তুলে নিয়েছে মজুমদারের নাসা গ্রুপ। ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী এত টাকা তুলে নেওয়ার সুযোগ নেই এক শাখা থেকে।
এ জন্য প্রভাব খাটিয়ে বিশেষ বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে এসব ঋণের প্রায় অর্ধেক। এসব ঋণের বেশির ভাগই দিয়েছেন লোকাল অফিসের তৎকালীন ব্যবস্থাপক ও বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক (চলতি) ওমর ফারুক খান। এই ব্যক্তিকেই ব্যাংকের এমডি হওয়ার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক গত ২৪ জুলাই সাক্ষাৎকারে ডেকেছিলেন। এতে ব্যাংকের হাজারো কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যে তীব্র ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রাপ্ত তথ্য বলছে, নজরুল ইসলাম মজুমদারের নাসা গ্রুপ ইসলামী ব্যাংকের লোকাল অফিস থেকেই ২ হাজার ১০২ কোটি টাকার ঋণ নিয়েছে।
এর মধ্যে ১ হাজার ১০৪ কোটি টাকা নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়মনীতি মেনে। আর বিশেষ বিবেচনায় নিয়েছে আরও ৯৯৮ কোটি টাকা। নাসা অ্যাপারেলস লিমিটেডসহ আরও ১২ প্রতিষ্ঠানকে ইসলামী ব্যাংকের লোকাল অফিস থেকে দেওয়া হয়েছে ১ হাজার ১৪৬ কোটি টাকা। এই ঋণের মধ্যে ৬৬৮ কোটি টাকাই নেওয়া হয়েছে বিশেষ বিবেচনায়। বর্তমানে এসব ঋণের প্রায় শতকোটি টাকা মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে পড়েছে। এসব ঋণের বেশির ভাগই দিয়েছেন লোকাল অফিসের তৎকালীন ব্যবস্থাপক ও বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক (চলতি দায়িত্ব) ওমর ফারুক খান।
জানা গেছে, ইসলামী ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনায় দুদকের করা মামলায় সাবেক এমডি মনিরুল মওলা বর্তমানে কারাগারে। একই মামলার আসামি ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওমর ফারুক খান এমডি (চলতি) পদে দায়িত্ব পালন করছেন। এই ব্যক্তিকেই ব্যাংকের এমডি হওয়ার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক গত বৃহস্পতিবার ২৪ জুলাই সাক্ষাৎকারে ডেকেছিলেন। এতে ব্যাংকের হাজারো কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যে তীব্র ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ২০২৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারির এক সার্কুলারে দেখা গেছে, কোনো ফৌজদারি আদালত কর্তৃক দ-িত নন কিংবা জাল-জালিয়াতি, আর্থিক অপরাধ বা অন্যবিধ অবৈধ কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত নন এমন ব্যক্তিকে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বা প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগ দিতে হবে। কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে অপরাসণ বা দুর্নীতির দায়ে বহিষ্কার হলে তিনি এমডি পদে নিয়োগে যোগ্য হবেন না।
এ ছাড়া এমডির পূর্ববর্তী পদগুলোতে সংশ্লিষ্ট প্রার্থীর অর্পিত কার্য সম্পাদনের প্রমাণ ও সুনাম থাকতে হবে। সে ক্ষেত্রে ওমর ফারুক খান দুদকের একাধিক মামলার আসামি। তার বিরুদ্ধে ঋণ জালিয়াতির অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া তিনি ইসলামী ব্যাংকের দুর্নীতির দায়ে বহিষ্কৃত ব্যক্তি। তাহলে সেই ব্যক্তি কীভাবে ইসলামী ব্যাংকের এমডি হওয়ার যোগ্য প্রশ্ন দেখা দিয়েছে ব্যাংকের কর্মকর্তাদের মধ্যে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ইসলামী ব্যাংকের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওমর ফারুক খানকে এমডি পদে নিয়োগ দেওয়া ঠিক হবে না। কারণ, তিনি বিতর্কিত ব্যক্তি। তার বিরুদ্ধে ঋণ জালিয়াতির অভিযোগের পাশাপাশি দুদকে একাধিক মামলাও রয়েছে। একই মামলায় সাবেক এমডি মনিরুল মওলা কারাগারে রয়েছেন। সেখানে তাকে কীভাবে এমডি পদে বাংলাদেশ ব্যাংক নিয়োগের সুপারিশ করে? একদিকে সুশাসন চাইবে, আরেক দিকে অপরাধী ব্যক্তিকে পদে বসানোর জন্য সুপারিশ করবে, তাহলে তো সুশাসন ফিরে আসবে না।
ইসলামী ব্যাংকের বিভিন্ন পর্যায়ে কথা বলে জানা গেছে, ২০১৭ সালে এস আলম গ্রুপ ইসলামী ব্যাংক দখলে নেওয়ার পরই শুরু হয় নামে-বেনামে টাকা বের করার আয়োজন। এ জন্য আগে যারা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন, তাদের সরিয়ে দেওয়া হয়।
একই সঙ্গে ব্যাংকের মধ্যে নিজস্ব একটি অনুগত বাহিনী গড়ে তোলে এস আলম। প্রধান কার্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ সব বিভাগ এবং ঢাকা ও চট্টগ্রামের বড় শাখায় নিজের অনুগতদের বসানো হয়। পরবর্তী ছয় বছরে দুটি পদোন্নতি নিয়ে অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এএমডি) হন ওমর ফারুক খান। ২০২২ সালে ইসলামী ব্যাংক থেকে দুর্নীতির দায়ে তাকে বহিষ্কার করা হয়। এরপর পুরস্কার হিসেবে নাসা গ্রুপে চাকরি পান ওমর ফারুক। গত বছরের ৫ আগস্টের আগ পর্যন্ত তিনি সেখানেই চাকরি করেছেন। গত বছরের ৫ আগস্ট পট পরিবর্তনের পর আবার ইসলামী ব্যাংকে যোগদান করেন ওমর ফারুক। চাকরিতে যে সিভি দিয়েছেন সেখানেও মিথ্যা তথ্য দিয়েছেন তিনি।
ইসলামী ব্যাংকের নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক কর্মকর্তা বলেন, “ইসলামী একটি ‘আদর্শিক ব্যাংক’। আওয়ামী লাগের আমলে যারা এই ব্যাংকে লুটপাট করেছে। তারাই যদি আবার ব্যাংকের হাল ধরে, তাহলে তো আগের অবস্থায় ফিরে যাবে ব্যাংকটি। বর্তমানে ব্যাংকটির আমানতের পাশাপাশি সুনামও বাড়ছে। এমন অবস্থায় একজন দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তি এমডি হলে ব্যাংকের সুনাম নষ্ট হয়ে যাবে।
এমডি পদে ওমর ফারুককে নিয়োগ প্রসঙ্গে ব্যাংকটির ভেতরে প্রচ- অসন্তোষ বিরাজ করছে, যা বিস্ফোরণে রূপ নিতে পারে।” এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘আমি পুরো বিষয়টি জেনে মন্তব্য করতে পারব। না জেনে কিছু বলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। এ ব্যাপারে অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি চলতি দায়িত্ব) ওমর ফারুক খানের সঙ্গে হোয়াটস্যাপে যোগাযোগ করা হলে কল ধরেননি।’