নদী, নৌকা আর নাবিকের গল্পে বাঁধা ভোলার জীবন। চারদিক জলেঘেরা এই দ্বীপজেলায় নৌকা যেন শুধু যাতায়াতের বাহন নয়, এটি জীবনধারার অংশ, জীবিকার অন্যতম প্রধান অবলম্বন। আর এই জীবন ও জীবিকার গল্প প্রতিদিন লেখা হয় লালমোহনের গজারিয়া কাঠপট্টিতে। করাতের শব্দ, কাঠের ঘ্রাণ আর মিস্ত্রিদের ঘাম-ঝরা শ্রমে এখানে তৈরি হয় ডিঙি, জয়া নৌকা ও মাছ ধরার বড় বড় ট্রলার।
ভোলার লালমোহন উপজেলার পশ্চিম চরউমেদ ইউনিয়নের গজারিয়া কাঠপট্টিতে দীর্ঘ অর্ধশতাধিক বছর ধরে চলে আসছে নৌকা নির্মাণের ঐতিহ্য। প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাঠ, হাতুড়ি, করাত আর পেরেকের শব্দে মুখর থাকে পুরো এলাকা। এ যেন কাঠের বৈঠা বেয়ে এগিয়ে চলা শত শত জীবনের কষ্টের সুর।
এখানে প্রায় ১০টি টিম্বার দোকানে তৈরি হচ্ছে ডিঙি নৌকা, জয়া নৌকা এবং বড় ফিশিং বোট। আকার ও গুণগত মান অনুসারে এসব নৌকার দাম পড়ে ৫০ হাজার থেকে ৬-৭ লাখ টাকা পর্যন্ত। এই কাঠপট্টির তৈরি নৌকা শুধু ভোলায় নয়, পটুয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী, এমনকি কক্সবাজার পর্যন্ত সরবরাহ হয়।
শুধু নৌকা নয়, এখানে গড়ে উঠেছে মানুষের জীবিকার একটি বড় অবলম্বন। প্রায় ২০০ শ্রমিক এই শিল্পে সরাসরি যুক্ত। বছরের চার মাস- বৈশাখ থেকে শ্রাবণ, এই সময়টায় থাকে ব্যস্ততা তুঙ্গে। প্রতিদিন তৈরি হয় একাধিক নৌকা, চলে লেনদেনের জমজমাট হাট।
কারিগর মনির উদ্দিন বলেন, ‘অনেক বছর ধরে এই কাজ করছি। আগেও মজুরি কম ছিল, এখন দিনে ৯০০ টাকা পাই। কিন্তু কাজ থাকে কেবল মৌসুমে, বাকি সময় বসে থাকতে হয়।’
নৌকা তৈরিতে সময় লাগে এক থেকে তিন সপ্তাহ পর্যন্ত, নির্ভর করে নৌকার আকার ও কাঠামোর ওপর। কাঠ, পেরেক, রঙ, গুডনাইল, সব মিলিয়ে একেকটি নৌকায় লাখ টাকার উপকরণ লাগে। তবু লাভের অংশ খুব বেশি নয়। ১ লাখ টাকায় বিক্রি হওয়া নৌকায় প্রায় ২০ হাজার টাকা এবং ৫-৬ লাখ টাকার নৌকায় সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা লাভ মেলে।
নৌকার পাইকার নুরু ব্যাপারী জানান, ‘এই শিল্পে প্রতিদিন কয়েক লাখ টাকার নৌকা বিক্রি হয়। কিন্তু শ্রমিকদের উন্নয়নে বা পুঁজি বাড়াতে কোনো সরকারি সহায়তা নেই। এনজিও ঋণেই চলছে কাজ।’
উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা আলী আহমদ আকন্দ বলেন, ‘এই সম্ভাবনাময় শিল্পকে আরও এগিয়ে নিতে আমরা কাজ করছি। যা করণীয় তা অবশ্যই করব।’
তবে মিস্ত্রিরা বলছেন, শুধু আশ্বাসে কাজ হবে না, চাই সুস্পষ্ট পদক্ষেপ। নৌকা নির্মাণ শিল্পে জড়িত এসব মানুষের দাবি, সরকার যদি সহজ শর্তে ঋণ, প্রশিক্ষণ এবং উপকরণ কেনায় ভর্তুকি দেয়, তাহলে শুধু ভোলার নয়, উপকূলের পুরো অর্থনীতিতে এই শিল্প বড় অবদান রাখতে পারবে।
এখনো যখন কেউ গজারিয়া কাঠপট্টিতে পা রাখে, তখন চোখে পড়ে কাঠের ওপর মাথা নিচু করে ব্যস্ত শ্রমিক, করাতের তীক্ষè শব্দ আর নতুন নৌকার গায়ে তোলা রঙের ঘ্রাণ। এসবই জানান দেয়, নদীর দেশ ভোলায় জীবন এখনো চলে কাঠের বৈঠা বেয়ে।
যেখানে নদীই পথ, সেখানে নৌকা শুধু বাহন নয়, সে এক জীবনের প্রতিচ্ছবি। ভোলার এই ঐতিহ্যবাহী নৌকাশিল্পের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হলে এখনই প্রয়োজন সরকারি দৃষ্টি ও সহযোগিতা। কারণ নৌকার হাল ধরে বেঁচে থাকা এই মানুষেরাই টিকিয়ে রেখেছে দেশের উপকূলীয় সংস্কৃতি ও অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তিকে।