ঢাকা রবিবার, ০৩ আগস্ট, ২০২৫

বন্ধ ফ্লাইট এক্সপার্ট বিপুল টাকা হাতিয়ে বিদেশ পালালেন মালিক

শাওন সোলায়মান
প্রকাশিত: আগস্ট ৩, ২০২৫, ০২:৪৩ এএম

হঠাৎ করেই বন্ধ হয়ে গেছে অনলাইন ট্রাভেল এজেন্সি (ওটিএ) ‘ফ্লাইট এক্সপার্ট’। মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়ে বিদেশ পাড়ি জমিয়েছেন ফ্লাইট এক্সপার্টের প্রতিষ্ঠাতা সালমান বিন রশিদ শাহ সায়েম।

এতে প্রতিষ্ঠানটির ঊর্ধ্বতন কয়েকজন কর্মকর্তাও জড়িত। প্রতিষ্ঠানটির অ্যাপ চালু থাকলেও, বন্ধ রয়েছে ওয়েবসাইট। বন্ধ রয়েছে গ্রাহকসেবা কেন্দ্রও। একই সাথে বন্ধ রাজধানীর মতিঝিলে থাকা ফ্লাইট এক্সপার্টের কার্যালয়ও। ধারণা করা হচ্ছে, কানাডায় পাড়ি জমিয়েছেন সালমান বিন রশিদ। এ ছাড়া দুবাইয়ে ব্যবসা ও অফিস রয়েছে সালমানেরÑ এমনটাই জানা গেছে। 

উড়োজাহাজের টিকিট বিক্রির মাধ্যমে বাংলাদেশের বাজারে জনপ্রিয়তা পেয়েছিল ফ্লাইট এক্সপার্ট। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিষ্ঠানগুলোর তুলনায় কমে উড়োজাহাজের টিকিট পাওয়া যেত এই প্ল্যাটফর্মে। একপর্যায়ে উড়োজাহাজের টিকিটের পাশাপাশি ভ্রমণসংক্রান্ত প্রায় সব ধরনের সেবা যেমনÑ হোটেল বুকিং, ট্যুর প্যাকেজ সেবাও নিয়ে আসে ফ্লাইট এক্সপার্ট। ২০২১ সালে প্রতিষ্ঠানটিতে বিতর্কিত ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ইভ্যালির বিনিয়োগের খবরও পাওয়া যায়। 

অনুসন্ধানে জানা যায়, ফ্লাইট এক্সপার্টের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে প্রায় ৩ কোটি টাকা উঠিয়ে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন প্রতিষ্ঠাতা সালমান। সালমানের সাথে প্রতিষ্ঠানটির বিভিন্ন বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্বরত কর্মকর্তারাও রয়েছেন। প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তাদের যোগাযোগে ব্যবহৃত একটি হোয়াটস অ্যাপ গ্রুপের কিছু মেসেজের স্ক্রিনশট এসেছে রূপালী বাংলাদেশের কাছে। সেই গ্রুপে সাঈদ হোসেন এবং সাকিব নামের দুইজন কর্মকর্তাকে ‘বিশ্বাসঘাতক’ উল্লেখ করে বার্তা দেন সালমান। সালমান লেখেন, ‘একটি বিশ্বাসঘাতকতার ঘটনা ঘটেছে, সাঈদ হোসেন এবং সাকিব এর জন্য দায়ী। তারা সব কিছু সাবধানতার সাথে পরিকল্পনা করেছে এবং গত বৃহস্পতিবারের মিটিংয়ে সব দায় আমাকে দেয়। এটা সমন্বিতভাবে করা হয়েছে এবং আমাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া হয়নি’। সালমান আরও লেখেন, ‘আজ (শনিবার) সকালে তারা কমবেশি ৩ কোটি টাকা তুলেছেন এবং নিজেদের কাছেই রেখেছেন। কোম্পানি এখন বন্ধ। অনেক হুমকির মুখে নিরাপত্তার কারণে চলে যাচ্ছি।’ 

এদিকে সালমানের এসব বক্তব্যের প্রতিবাদও করেছেন কেউ কেউ। তারা লিখেছেন, এই ঘটনার সাথে সালমান নিজেও জড়িত। তবে স্কিনশট থেকে তাদের নাম জানা যায়নি। ফ্লাইট এক্সপার্টের ব্যাবসায়িক কার্যক্রম সম্পর্কে তথ্য আছে এমন একটি সূত্র পরিচয় গোপন রাখার শর্তে রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘সালমান আমাকে জানিয়েছে যে, বিভিন্ন করপোরেট ক্লায়েন্টের থেকে ফ্লাইট এক্সপার্টের পাওনা টাকার একটি বড় অংশ সংগ্রহ করেছিল সাঈদ এবং সাকিব। আবার ভেন্ডারদের পেমেন্ট দেওয়ার জন্য কোম্পানির তহবিল থেকেও টাকা তুলেছিল তারা। এগুলো সালমানের কথা। তবে বাজারে ফ্লাইট এক্সপার্টের কোনো সংকট ছিল না। তাদের ব্যবসা ভালোই চলছিল।’ সালমানের সাথে পরিচিত এমন একাধিক ব্যক্তির সাথে কথা বলে জানা যায়, সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে ব্যবসা রয়েছে সালমানের। সেখানে তার অফিসও রয়েছে। এ ছাড়া সালমান কানাডায় পড়াশোনা করেছেন। সালমানের পরিচিতজনদের ধারণা, ফ্লাইট এক্সপার্ট বন্ধ করে কানাডায় পাড়ি জমিয়েছেন তিনি। সালমান ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) ২০২৫-২৭ মেয়াদে পরিচালকও ছিলেন।
এদিকে ফ্লাইট এক্সপার্ট বন্ধ হওয়ায় বিপাকে পড়েছেন বহু সাধারণ গ্রাহক। দুপুরের পর থেকে মতিঝিলে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান কার্যালয়ে গিয়ে ভুক্তভোগী গ্রাহকদের ভিড় দেখা যায়। ফ্লাইটের টিকিট এবং ভ্রমণের ট্যুর প্যাকেজ বুকিং করতে অনেকেই অগ্রিম অর্থ দিয়েছিলেন ফ্লাইট এক্সপার্টকে। সঠিক হিসাব না থাকলেও, এই ইন্ডাস্ট্রি সংশ্লিষ্টদের অনুমান যে, প্রতিষ্ঠানটি ইতিমধ্যে কয়েক শ কোটি টাকা গ্রাহকের কাছ থেকে অগ্রিম হিসেবে গ্রহণ করেছে। অবশ্য সেসব সেবা গ্রাহকরা আর পাবেন বলে মনে হচ্ছে না। মিরাজুল ইসলাম জীবন নামের এক ভুক্তভোগী বলেন, ‘দুই মাস নতুন বিয়ে হয়েছে। হানিমুনে থাইল্যান্ড যাওয়ার জন্য ফ্লাইট এক্সপার্টের মাধ্যমে প্যাকেজ বুক করেছিলাম। আগেভাগে বুক দিয়েছিলাম যেন দাম কম পড়ে। এয়ার টিকিটসহ প্রায় ৬০ হাজার টাকা অ্যাডভান্স করা ছিল। আজ (গতকাল) এই কথা শুনে, এয়ারলাইনসের সাথে যোগাযোগ করলাম। আমার নামে কোনো টিকিট কনফার্ম করা নেই।’ দিনভর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও সাধারণ মানুষজন তাদের ক্ষতির কথা জানাতে থাকেন। জনপ্রিয় উপস্থাপিকা মাহমুদা মাহাও তার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে জানান যে, ফ্লাইট এক্সপার্টের কাছে টাকা পাবেন তিনি। 

প্রতিষ্ঠানটির ফেসবুক পেজে গিয়ে দেখা যায়, চলতি মাসের মাঝামাঝি থেকে ২০২৬ সালের হজ প্যাকেজ বিক্রি করে আসছিল ফ্লাইট এক্সপার্ট। জনপ্রতি ৬ লাখ ৪৫ হাজার টাকা প্যাকেজের মধ্যে ৩০ হাজার টাকা অগ্রিম দিয়ে প্যাকেজ নিশ্চিত করতে হতো প্রতিষ্ঠানটিতে। ধারণা করা হচ্ছে, এই হজ প্যাকেজ থেকেও মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়েছে ফ্লাইট এক্সপার্ট। সাধারণ গ্রাহকদের আকৃষ্ট করতে জুলাইয়ের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে সৌদি পর্যটন সংস্থার সাথে অংশীদারির এক সংবাদ বিজ্ঞাপন আকারেও প্রকাশ করে আসছিল ফ্লাইট এক্সপার্ট। 

এ বিষয়ে সালমানের হোয়াটস অ্যাপ নম্বরে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন কেটে দেন। এরপর যোগাযোগের কারণ উল্লেখ করে মেসেজ দেওয়া হলেও কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।