ঢাকা রবিবার, ২৪ আগস্ট, ২০২৫

টেকসই উন্নয়ন তালিকায় যুক্ত হলো ১১ বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান

রূপালী প্রতিবেদক
প্রকাশিত: আগস্ট ২৪, ২০২৫, ০৮:১৮ এএম

দেশের বেশকিছু কোম্পানি কয়েক বছর ধরে করপোরেট খাতে টেকসই উন্নয়নের ক্ষেত্রে শক্ত অবস্থান ধরে রেখেছে। পরিবেশগত, সামাজিক ও সুশাসন (ইএসজি) মানদ- অনুসরণের ভিত্তিতে এ বিষয়ে সম্প্রতি একটি তালিকা প্রকাশ করেছে মার্কিন সংবাদ সংস্থা ব্লুমবার্গ। এতে স্থান পেয়েছে বাংলাদেশের করপোরেট খাতের ১১টি প্রতিষ্ঠান; যেখানে তিন ক্যাটাগরিতে শীর্ষে উঠে এসেছে ব্র্যাক ব্যাংক, আইডিএলসি ফাইন্যান্স ও সিটি ব্যাংক। তবে সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে শীর্ষ তিন অবস্থানে রয়েছে শেয়ারবাজারের তালিকাভুক্ত লাফার্জহোলসিম বাংলাদেশ, এমজেএল বাংলাদেশ ও ব্র্যাক ব্যাংক। 

ব্লুমবার্গের ইএসজি রেটিং মূলত একটি বিশ্লেষণাত্মক টুল, যা বিনিয়োগকারী, বিশ্লেষক ও নিয়ন্ত্রকদের জন্য তৈরি করা হয়েছে। এর মাধ্যমে কোনো প্রতিষ্ঠানের টেকসই উন্নয়ন ও দায়িত্বশীলতার মানসম্মত এবং তুলনাযোগ্য ধারণা পাওয়া যায়। সর্বশেষ তালিকায় দেখা যায়, বাংলাদেশের ১১টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে লাফার্জহোলসিম বাংলাদেশ সামগ্রিকভাবে চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে। তবে সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটির অবস্থান শীর্ষে। সুশাসন ক্যাটাগরিতে প্রতিষ্ঠানটি পেয়েছে ৩ দশমিক ২১ স্কোর। এ ছাড়া পরিবেশ ক্যাটাগরিতে শূন্য দশমিক ৭২ ও সামাজিক ক্যাটাগরিতে ৩ দশমিক ৭২ স্কোর নিয়ে মোট ইএসজি রেটিং গড়ে ১ দশমিক ৯১।

ইএসজি রেটিংয়ে সুশাসন ক্যাটাগরিতে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে শেয়ারবাজারের তালিকাভুক্ত আরেক কোম্পানি এমজেএল বাংলাদেশ পিএলসি। এ ক্যাটাগরিতে প্রতিষ্ঠানটির মোট স্কোর ৩ দশমিক শূন্য ৫। যদিও ইএসজি রেটিংয়ে এমজেএল বাংলাদেশের অবস্থান আট নম্বর। 

ব্লুমবার্গ একটি বিশ্ববিখ্যাত মার্কিন প্রতিষ্ঠান, যা মূলত আর্থিক তথ্য, সংবাদ ও বিশ্লেষণ সরবরাহ করে। ১৯৮১ সালে প্রতিষ্ঠিত এ প্রতিষ্ঠান ব্লুমবার্গ টার্মিনাল, টেলিভিশন, রেডিও ও ডিজিটাল প্লাটফর্মের মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে বিনিয়োগকারী, নীতিনির্ধারক ও গবেষকদের কাছে নির্ভরযোগ্য অর্থনৈতিক এবং বাজারভিত্তিক তথ্য পৌঁছে দেওয়ার কাজ করছে। প্রতিষ্ঠানটি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়ে ইএসজি রেটিং প্রকাশ করে আসছে ২০২০ সাল থেকে। আর বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়ে প্রথম ইএসজি রেটিং প্রকাশ করা হয় ২০২৩ সালে। ওই রেটিংয়ে দেশের সাতটি প্রতিষ্ঠান স্থান পায়।

ইএসজি রেটিং মূলত একটি স্কোর বা মূল্যায়ন ব্যবস্থা, যেখানে কোনো কোম্পানি বা সংস্থার পরিবেশগত, সামাজিক ও করপোরেট সুশাসনসংক্রান্ত কার্যক্রম পর্যালোচনা করা হয়। পাশাপাশি ওই কোম্পানিটির ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা কতটা দায়িত্বশীল ও টেকসই সেটিও পরিমাপ করা হয়। এ পরিমাপের ক্ষেত্রে ব্লুমবার্গ তাদের ডেটা প্লাটফর্মের মাধ্যমে বিভিন্ন উৎস থেকে তথ্য সংগ্রহ করে। আর এগুলো নেওয়া হয় সংশ্লিষ্ট কোম্পানির বার্ষিক প্রতিবেদন, টেকসই উন্নয়ন রিপোর্ট, নিয়ন্ত্রক সংস্থার প্রকাশিত তথ্য, সংবাদ ও তৃতীয় পক্ষের ডেটা থেকে। এসব তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠানটির কার্বন নিঃসরণ, সম্পদ ব্যবহার, কর্মপরিবেশ, বৈচিত্র্য, মানবাধিকার, দুর্নীতি প্রতিরোধ ব্যবস্থা, শেয়ারহোল্ডার অধিকার ইত্যাদি সূচক বিবেচনা করে একটি স্কোর নির্ধারণ করা হয়।

সারা বিশ্বের বিনিয়োগকারীরাই টেকসই ও দায়িত্বশীল কোম্পানিতে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী থাকেন। ইএসজি রেটিং মূলত আগ্রহী বিনিয়োগকারীদের বুঝতে সাহায্য করে কোন কোম্পানি পরিবেশ ও সমাজের জন্য ঝুঁকি কম তৈরি করছে এবং তার পরিচালন ব্যবস্থা স্বচ্ছ। সুশাসন প্রতিষ্ঠাসহ ইএসজির সব ক্যাটাগরিতে এবার শীর্ষ অবস্থান ধরে রেখেছে বেসরকারি ব্র্যাক ব্যাংক। দেশীয় প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ তালিকায় মোট পয়েন্ট ৩ দশমিক ৮০। তবে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় ব্র্যাক ব্যাংকের অবস্থান তৃতীয়। ব্যাংকটি এ ক্যাটাগরিতে মোট স্কোর পেয়েছে ৩ দশমিক শূন্য ৭।

ব্লুমবার্গের টেকসই তালিকায় বাংলাদেশের শীর্ষ প্রতিষ্ঠান হতে পারাটি গৌরবের বলে মনে করেন ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) তারেক রেফাত উল্লাহ খান। তিনি বলেন, ‘একটি করপোরেট প্রতিষ্ঠানের পরিবেশ রক্ষায় ভূমিকা, সামাজিক দায়বদ্ধতা ও সুশাসন পরিপালনের দিক পর্যালোচনা করে ব্লুমবার্গ এ তালিকা তৈরি করে। এর আগে তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে থাকলেও এবার ব্র্যাক ব্যাংক শীর্ষস্থানে উঠে এসেছে। ব্র্যাক ব্যাংক পরিবারের সদস্য হিসেবে এটি আমার জন্য গৌরবের।’ তারেক রেফাত উল্লাহ খান বলেন, ‘ব্র্যাক ব্যাংকের ঋণ পোর্টফোলিওর প্রায় অর্ধেক এসএমই খাতের। এটি সামাজিক দায়বদ্ধতা পরিপালনের বড় একটি সূচক। এ খাতে ঋণ দেওয়ার মাধ্যমে আমরা গ্রামীণ ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলতে সহযোগিতা করতে পারছি। আবার ঋণ দেওয়াসহ ব্যাংকের সব কাজে করপোরেট সুশাসন বজায় থাকায় আমরা ভালো মুনাফাও পাচ্ছি। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত একটি কোম্পানিকে কেবল সামাজিক দায়দায়িত্ব ও সুশাসন পরিপালনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকলেই হয় না, বরং দিন শেষে শেয়ারহোল্ডারদের ভালো মুনাফাও দিতে হয়। ব্র্যাক ব্যাংক এসব দায়িত্বই যথাযথভাবে পালন করছে।’

কয়েক বছর ধরে আর্থিক প্রতিটি সূচকে ধারাবাহিক উন্নতি করছে বেসরকারি খাতের সিটি ব্যাংক। এ উন্নতির স্বীকৃতিও এসেছে ব্লুমবার্গের ইএসজি রেটিংয়ে। অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক প্রকাশ করা ‘সাসটেইনেবিলিটি রেটিংয়ে’ টানা পাঁচবার স্থান পেয়েছে ব্যাংকটি। সর্বশেষ ২০২৪ সালের রেটিংয়ে শীর্ষ স্কোর পেয়েছে সিটি ব্যাংক। ব্লুমবার্গের ইএসজি রেটিংয়ের সুশাসন সূচকে ব্যাংকটি ২ দশমিক ৩৩ স্কোর পেয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসরুর আরেফিন বলেন, ‘প্রথমবারের মতো ব্লুমবার্গের ইএসজি রেটিংয়ে অন্তর্ভুক্ত হতে পারাটি আমার জন্য আনন্দের। অভিষেকেই তৃতীয় স্থান অর্জন করতে পারাটি বাড়তি পাওয়া। ব্র্যাক ব্যাংক ও আইডিএলসি তিন-চার বছর ধরে এ তালিকায় রয়েছে, যেখানে ব্লুমবার্গের প্রক্রিয়াকে বাংলাদেশে সহযোগিতা করছে ব্র্যাক ইপিএল। এ বিষয়টি জানার পর আমরা একাধিক বৈঠকের মাধ্যমে ব্র্যাক ইপিএলের সঙ্গে কাজ শুরু করি, যাতে সিটি ব্যাংকের অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করা যায়। একই সঙ্গে আমরা আমাদের বার্ষিক প্রতিবেদনে ব্লুমবার্গের ইএসজি চেকলিস্ট অন্তর্ভুক্ত করেছি এবং মানদ- পূরণের জন্য টেকসই অর্থায়নে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। ধারাবাহিক এ প্রচেষ্টার ফলস্বরূপ সিটি ব্যাংক গর্বের সঙ্গে ব্লুমবার্গ ইএসজি রেটিং তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে এবং প্রথম বছরেই তৃতীয় স্থান অর্জন করতে পেরেছে।’

সুশাসন প্রতিষ্ঠায় লাফার্জহোলসিম, এমজেএল বাংলাদেশ ও ব্র্যাক ব্যাংকের পরে আরও আটটি প্রতিষ্ঠানে সুশাসন ক্যাটাগরিতে স্কোর যথাক্রমে আইডিএলসি ফাইন্যান্সের ২ দশমিক ৯১, সিটি ব্যাংকের ২ দশমিক ৩৩, গ্রামীণফোনের ২ দশমিক ৮৮, ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশের ২ দশমিক ৯৩, বিএসআরএম স্টিলসের ২ দশমিক ৫৫, স্কয়ার ফার্মার ২ দশমিক শূন্য ৯, ওয়ালটনের ২ দশমিক ৫৭ এবং মার্কেন্টাইল ব্যাংকের ২ দশমিক ৪০।