রবিবার, ১৮ মে, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


মোস্তাফিজুর রহমান সুমন ও মেহেদী হাসান খাজা

প্রকাশিত: মে ১৮, ২০২৫, ০৯:২১ এএম

কিশোর গ্যাংয়ের তাণ্ডব চলছেই

মোস্তাফিজুর রহমান সুমন ও মেহেদী হাসান খাজা

প্রকাশিত: মে ১৮, ২০২৫, ০৯:২১ এএম

কিশোর গ্যাংয়ের তাণ্ডব চলছেই

ছবি: সংগৃহীত

রাজধানীসহ সারা দেশে কিশোর গ্যাংয়ের লাগামহীন অত্যাচারে অতিষ্ঠ দেশের মানুষ। ৫ আগস্টের পর কিশোর গ্যাংয়ের ক্রমবর্ধমান কার্যকলাপ বৃদ্ধি পেলেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের তাণ্ডব রুখতে পারছে না। কিশোর গ্যাং কালচার এখন রাজধানীসহ দেশবাসীর কাছে আতঙ্কের নাম। তাদের লাগামহীন চাঁদাবাজিতে সবচেয়ে বেশি অতিষ্ঠ ব্যবসায়ীরা। বর্তমান প্রেক্ষাপটে কিশোর গ্যাংয়ের অধিকাংশ গ্রুপ রাজনৈতিক শেল্টার পাচ্ছে। 

একাধিক সূত্রমতে, তাদের শেল্টার দিচ্ছে মূলত নতুন ও পুরোনো একাধিক রাজনৈতিক দলের স্থানীয় নেতারা। পাশাপাশি স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী ও ক্ষমতাবান ব্যক্তিরা দখল-চাঁদাবাজি, মহড়া, মাদক ও অস্ত্র ব্যবসা এবং সন্ত্রাসী কার্যকলাপে ব্যবহার করছে। সন্ত্রাসী, মাদক-অস্ত্র ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক ও প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় কিশোর গ্যাংয়ের অপরাধ কর্মকাণ্ড সমাজের জন্য একটি বড় বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা সমাজে স্থিতিশীলতা ও শান্তি নষ্ট করছে। দেশজুড়ে তাদের তাণ্ডব চলছে।

সর্বশেষ গত শুক্রবার রাতে রাজধানীর মোহাম্মদপুর ও হাজারীবাগ এলাকায় পৃথক ঘটনায় কিশোর গ্যাংয়ের হামলায় শিক্ষার্থীসহ দুজন নিহত ও একজন আহত হয়েছেন। গতকাল শনিবার ডিএমপির মিডিয়া ও পাবলিক রিলেশনস বিভাগের ডিসি মুহাম্মদ তালেবুর রহমান এ তথ্য নিশ্চিত করেন। নিহতরা হলেন বরিশালের আগৈলঝরার পূর্ব সুজনকাঠীর আবুল ফকিরের ছেলে নুর ইসলাম (২৬)। পেশায় তিনি আলোকচিত্রি ছিলেন। ধানমন্ডি থানার শংকর বাসস্ট্যান্ডের পেছনে তিনি থাকতেন। আরেকজন ড. মালেকা কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আলভী (২৭)। তার বাবার নাম মশিউর খান পাপ্পু। একই ঘটনায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আশরাফুল ইসলাম (২১) আহত হয়েছেন। তিনি মাথায় আঘাত পেয়েছেন। তার বাবার নাম মোহাম্মদ মাসুদ। নিহত আলভী এবং আহত আশরাফুল ইসলাম উভয়েই বিজিবি ৫নং গেট এলাকার বাসিন্দা। 

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিহত নুর ইসলামের ভাই ওসমান গনি বলেন, গত শুক্রবার রাত ৮টায় মোহাম্মদপুর দূর্গা মন্দির গলি দিয়ে যাওয়ার সময় কয়েকজন গতিরোধ করে সাথে থাকা ক্যামেরা দুর্বৃত্তরা ছিনিয়ে নেয় এবং তাকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে মাথায় এবং দুহাতে গুরুতর আহত করে। ভাই তাকে উদ্ধার করে প্রথমে বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিলে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে রাত পৌনে ১০টায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে আসলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। ঢামেক হাসপাতালের পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ মোহাম্মদ ফারুক জানান, মরদেহটি ময়নাতদন্তের জন্য হাসপাতাল মর্গে রাখা আছে।

সম্প্রতি রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। অল্প বয়সি এসব কিশোররা গ্যাং কালচারে জড়িয়ে পড়লেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের নিয়ন্ত্রণে আনতে ব্যর্থ হচ্ছে। কোনো ঘটনা ঘটলেই কেবল তাদের তোড়জোড় বাড়ে। কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে কারাগার বা কিশোর সংশোধন কেন্দ্রে পাঠিয়ে দেয়। অল্প সময়ের ব্যবধানে জামিনে বেরিয়ে আবারও তারা অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। তাদের কারণে শুধু আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটছে তাই নয়, বরং সাধারণ মানুষের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা এবং আতঙ্ক সৃষ্টি করছে। কিশোর গ্যাংয়ের সাথে জড়িত রয়েছে এলাকার বখাটে যুবক, ছিঁচকে চোর, ছিনতাইকারী ও বিপথগামী স্কুল-কলেজের কিছু শিক্ষার্থী। 

কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা নানামুখী অপরাধে যুক্ত হচ্ছে। নিজেদের হিরোইজম জাহির করতে চাঁদাবাজি, ছিনতাই, মাদক কারবার এমনকি খুনোখুনিতে লিপ্ত হচ্ছে এসব কিশোর-তরুণ।  আওয়ামী লীগের পতন হলেও দল পাল্টে এখনো অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে এসব কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। অতীতের মতো এখনো রাজনৈতিক নেতা কিংবা প্রভাবশালী মহলের ছত্রছায়ায় তারা।

গোয়েন্দা পুলিশ বলছে, কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা সাধারণত ছোটখাটো অপরাধ থেকে শুরু করে বড় ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে। সম্প্রতি মিরপুর, উত্তরা এবং মোহাম্মদপুরের মতো এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা বেশি লক্ষ্য করা গেছে। অপরাধীরা প্রকাশ্যেই সাধারণ মানুষের ওপর হামলা করছে যার কারণে সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করছে। নগরবাসী যেখানে নিরাপদে চলাফেরা করতে চায়, সেখানে অপরাধীরা দিনের পর দিন তাদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। কিশোর গ্যাংয়ের এই ধরনের সহিংস কর্মকাণ্ডের ফলে সমাজের শান্তিপূর্ণ পরিবেশ ক্রমশ বিঘ্নিত হচ্ছে। মুহাম্মদপুর এলাকায়ও কিশোর গ্যাংয়ের অপরাধমূলক কার্যক্রম বৃদ্ধি পেয়েছে। পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, কিশোররা এখানে চুরি, ছিনতাই, মাদক ব্যবসা এবং সহিংসতা চালাচ্ছে। এটি শুধু এলাকার নিরাপত্তা বিঘ্নিত করছে না বরং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপরও প্রশ্ন তুলছে।  সাধারণ মানুষ যখন এসব অপরাধের শিকার হয়, তখন তারা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কার্যকারিতা নিয়ে সন্দিহান হয়ে পড়ে।

সূত্র জানায়, এলাকাভিত্তিক কথিত রাজনৈতিক নেতারা তাদের ব্যবহার করে নিজেরা ফায়দা নিচ্ছে। কথিত নেতাদের শেল্টারে বেপরোয়া এ কিশোর গ্যাংয়ের হাতে নাজেহাল হচ্ছে এলাকার ব্যবসায়ী সমাজ ও সাধারণ জনগণ। উত্তরা, মোহাম্মাদপুর ও মিরপুরে ভায়াবহ রূপ নিয়েছে কিশোর গ্যাং। 

উত্তরার বিভিন্ন সেক্টর ও নতুন ওয়ার্ডের পাড়া মহল্লায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এসব এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাত কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এসব এলাকায় বেড়েছে দখল, চাঁদাবাজি, চুরি, ছিনতাই ও মারামারির মতো জঘন্য ঘটনা। দিনেদুপুরে বাসাবাড়িতে চুরি, ছিনতাই ছাড়াও এ চক্রটি প্রায়ই তুরাগ নয়ানগর, দলিপাড়া, বাউনিয়া, কামারপাড়া, দক্ষিণখান, ট্রান্সমিটার, মোল্লাবাড়ী, হলান, আজমপুর, আশকোনা, কাওলা, খিলক্ষেত নিকুঞ্জ, উত্তরখান মাদার বাড়ি, মাজারপাড়া, বড়বাগ, চাঁনপাড়া, তেরমুখ, উত্তরখান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ পাড়া-মহল্লার বাসাবাড়ি, শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন স্কুল-কলেজের মূল্যবান বৈদ্যুতিক তার রাতের আঁধারে কেটে নিয়ে যায়।

ডিএমপি সূত্র জানায়, ডিএমপির প্রতিটি থানা এলাকায় কিশোর গ্যাং সদস্য রয়েছে। ঢাকায় অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত ৪০ শতাংশই কিশোর। আগের চেয়ে তাদের দলের সদস্য সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ২০ হাজারের বেশি। তাদের হাতে এখন পিস্তলসহ আধুনিক ধারালো অস্ত্রও রয়েছে। 

পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্যমতে, শুধু রাজধানীতেই নয়, দেশের প্রতিটি থানা এলাকায় কিশোর-তরুণ গ্যাংয়ের সদস্য আরও বেড়েছে। কিশোর গ্যাংয়ের অপতৎপরতা গ্রামীণ জনপদেও ছড়িয়ে পড়েছে। মাদক, বাড়তি টাকার লোভ, আইনকে তোয়াক্কা না করে নিজেকে বড় ভাবার প্রবণতা, বেকারত্ব, অভিভাবকদের দায়িত্বহীনতাসহ আরও বেশ কয়েকটি কারণে তারা দিনে দিনে বেপরোয়া হয়ে উঠছে। 

পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) এনামুল হক সাগর বলেছেন, গত ৯ মাসে দেশের যত অপরাধ সংঘটিত হয়েছে তার একটি অংশের সঙ্গে কিশোরগ্যাংয়ের সদস্য জড়িত। প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় উঠতি বয়সি যারা অপরাধে জড়িয়ে যাচ্ছে তাদের আইনের আওতায় আনতে পুলিশ তৎপর রয়েছে।

কিশোর অপরাধ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে কাজ করা একটি বিশেষ গোয়েন্দা বাহিনীর তথ্য মতে, সময় বদলালেও বদলায়নি ক্রমে আতঙ্ক হয়ে ওঠা ‘কিশোর গ্যাং’ সদস্যরা।  ৫ আগস্টের পর কেউ দল বদলেছে, কেউ বদলেছে আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতা। কেউ আবার পুরোনোকে সরিয়ে আবির্ভূত হয়েছে নতুন রূপে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি তথ্য বলছে, সম্প্রতি এই গ্যাংয়ের সদস্য আরও বেড়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর আবারও ঢাকাসহ বিভিন্ন ওয়ার্ড, পাড়া-মহল্লায় কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাত অনেক গুণে বেড়েছে বলে জানা যায়। এতে বেড়েছে দখল, চাঁদাবাজি, চুরি, ছিনতাই ও মারামারির মতো জঘন্য ঘটনা।


 
ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মো. ইবনে মিজান রূপালী বাংলাদেশকে জানান, তেজগাঁও বিভাগে ৬টি থানা এলাকায় বস্তি, ক্যাম্প থাকায় এখানে নিম্নআয়ের মানুষের বসবাস বেশি। ঠিকানা ছাড়া মানুষ অপরাধ করেই দ্রুত স্থান পরিবর্তন করে, যে কারণে তাদের নিয়ন্ত্রণ করা কষ্টসাধ্য। তবুও আমরা ২৪ ঘণ্টা টহল ও মনিটরিং করছি এবং প্রতিদিন কিশোর গ্যাং এবং অন্য অপরাধীদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় নিয়ে আসছি। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ তাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছে। সাধরাণত কিশোর গ্যাং সদস্যদের গ্রেপ্তারের দ্রুত সময়ে জামিন পায়। যে কারণে দ্বিতীয়বার গ্রেপ্তার করা হলে অপরাধীদের বিষয়ে যাতে সহজে জামিন না হয় সেজন্য মামলার তদন্ত কর্মকর্তাদের সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

ডিএমপির হাজারীবাগ থানার ওসি মোহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, গত মাস ধরে হাজারীবাগ থানা এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। শুক্রবার রাতে হত্যাকাণ্ডের ঘটনার সূত্রপাত ধানমন্ডি এলাকায়। শেষ হয় হাজারীবাগের ঝিগাতলায়। এ ঘটনায় মামলা হয়েছে। আমরা তদন্ত করছি, দ্রুত সময়ের অপরাধীদের গ্রেপ্তার করতে পারব। ধানমন্ডি থানার ওসি ক্যশৈনু মারমা রূপালী বাংলাদেশকে জানান, ধানমন্ডি অভিজাত এলাকা হওয়ায় ভাসমান মানুষের আনাগোনা কম। তবে এখানকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কম বয়সিরা গ্রুপভিত্তিক আড্ডা দিয়ে থাকে। সেখান থেকেই মূলত নানা ঝামেলার সূত্রপাত। হাজারীবাগের হত্যাকাণ্ডের আগের ধানমন্ডি লেকে দুই গ্রুপের মধ্যে হাতাহাতির ঘটনা ঘটে বলে আমরা জানতে পারি। কিশোর গ্যাং সদস্যদের নিয়ন্ত্রণে আমরা সচেষ্ট রয়েছি।

Link copied!