ঢাকার রাজপথে আন্দোলন হয়ে উঠেছে নিত্যদিনের চিত্র। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে কথায় কথায় চলছে বিক্ষোভ, সড়ক অবরোধ। ফলে দাবি আদায়ের শহরে পরিণত হয়েছে ঢাকা। সড়ক বন্ধ করে অবস্থান ও অবরোধে সীমাহীন দুর্ভোগে পড়ছেন নগরবাসী।
অ্যাম্বুলেন্সসহ জরুরি প্রয়োজনে বের হওয়া পরিবহন, কর্মস্থলে যাওয়ার তাড়া, কিংবা স্কুল-কলেজগামী শিক্ষার্থীদের ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে। আন্দোলন, বৃষ্টি, যানজট ও জলজটে রাস্তায় বাস, প্রাইভেট কার, রিকশা আর মোটরসাইকেলের দীর্ঘ সারি এক স্থবির শহরের চিত্র এঁকে দিয়েছে। রাস্তায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করে হেঁটে গন্তব্যে যেতে দেখা গেছে সাধারণ মানুষকে।
আন্দোলন সামাল দিতে ক্লান্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। জনদুর্ভোগ এড়ানো এবং নিরাপত্তার স্বার্থে সড়ক বন্ধ করে সভা-সমাবেশে নানা বিধিনিষেধ থাকলেও কেউ মানছে না। দফায় দফায় বিজ্ঞপ্তি দিয়েও আন্দোলকারীদের থামাতে পারছে না পুলিশ। নগরবাসীকে জিম্মি করে দিনের পর দিন চলছে আন্দোলন। এতে জনমনে বাড়ছে হতাশা ও ক্ষোভ।
অন্তর্বর্তী সরকারের গত ৯ মাসে চাকরিচ্যুতি ও পুনর্বহাল, গণঅভ্যুত্থানে হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার ও বিচার, শহিদ পরিবারের পুনর্বাসন ও আহতদের উন্নত চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত, সরকারি চাকরিজীবীদের বিভিন্ন দাবি, শ্রমিক স্বার্থ, শিক্ষাসংশ্লিষ্ট আন্দোলন, সংখ্যালঘু ও ধর্মীয় সংগঠনগুলোর আন্দোলন, পরিবহন ও যানবাহনসংক্রান্ত, অটোরিকশাসংশ্লিষ্টসহ আরও অনেক ইস্যুতে চলে আন্দোলন।
গতকাল বুধবার রাজধানীতে ইশরাককে মেয়র হিসেবে শপথ পড়ানোসহ বিভিন্ন দাবিতে অন্তত ৮ স্থানে চলে বিক্ষোভ ও সড়ক অবরোধ করে আন্দোলন। ফলে ঢাকার কাঁধে এখন শুধু আন্দোলনের চাপ। দাবির ইস্যুতে ক্লান্ত ঢাকা।
পথচারীরা বলছেন, যেকোনো সংগঠন তাদের অধিকার আদায়ের জন্য দাবি জানাতেই পারে। তবে যে প্রক্রিয়ায় দাবি জানানো হচ্ছে, সেটা যথাযথ নয়। কিছু হলেই রাজপথ দখল করে আন্দোলন। এতে মানুষের ভোগান্তি বাড়ছে। পরিবহন শ্রমিকরা বলছেন, রাস্তায় গাড়ি নামালেও প্রতিনিয়ত আন্দোলনের কারণে খালি হাতে ফিরতে হচ্ছে তাদের। ফলে গাড়ির মালিককে খরচের টাকা দিতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) হিসাবে, ঢাকায় গড়ে প্রতিদিন কমপক্ষে তিনটি আন্দোলন কর্মসূচি পালিত হয়। সে হিসাবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়ে পাঁচ শতাধিক আন্দোলন হয়েছে ঢাকায়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শেখ হাসিনার আমলে কেউ দাবি-দাওয়া নিয়ে সড়কে নামতে পারত না। পুলিশের লাঠিচার্জ-গুলি, পাশাপাশি হেলমেট বাহিনীর তাণ্ডবে আন্দোলন থমকে যেত। মানুষ এখন মুক্তভাবে কথা বলতে পারছে। ফলে তারা চাইছে আন্দোলন করে নিজেদের অধিকার আদায় করে নিতে। এতে যানজটে স্থবির সড়কে আটকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ভুগতে হচ্ছে নগরবাসীকে। অফিস শেষে হেঁটে বাসায় ফিরতে বাধ্য হচ্ছেন লাখো মানুষ। তবে রাজপথ চলমান রাখতে আন্দোলন ইস্যুতে উপদেষ্টাদের নিয়ে একটি সেল গঠন করার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের।
গতকাল শপথ ইস্যুতে বেলা ১১টার পর মৎস্য ভবন, কাকরাইল মসজিদের সামনের সড়কে যান চলাচল বন্ধ করে দেন ইশরাক হোসেনের সমর্থকরা। তবে রোগীবাহী অ্যাম্বুলেন্স যেতে দিচ্ছিলেন তারা। এতে কদম ফোয়ারা থেকে মৎস্য ভবন হয়ে শাহবাগ-কাকরাইল, শাহবাগ থেকে মৎস্য ভবন হয়ে কাকরাইল-প্রেসক্লাব, কাকরাইল চার্চ মোড় থেকে কাকরাইল মসজিদ হয়ে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল এবং মৎস্য ভবন হয়ে শাহবাগমুখী যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এতে আশপাশের এলাকার সড়কে যানবাহনের চাপ বেড়ে যায়। তৈরি হয় তীব্র যানজট।
জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে একটি কর্মসূচিতে যোগ দিতে গতকাল ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া থেকে বিভিন্ন মাধ্যমিক স্কুলের একদল শিক্ষক ঢাকায় আসেন। বেলা সোয়া ১১টায় তাদের বহনকারী আলম এশিয়া পরিবহনের বাসটি মৎস্য ভবনের সামনে আটকা পড়ে। তখন কিছু শিক্ষক হেঁটে চলে যান, বাকিরা আর যেতে পারেননি। পরে বেলা পৌনে ২টার দিকে বাসটি পেছনের দিকে নিয়ে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের সামনে থেকে ঘুরে চলে যায়।
রবিউল ইসলাম নামে ওই বাসের একজন যাত্রী বলেন, প্রায় আড়াই ঘণ্টা এক জায়গায় বসা। এইখানে প্রোগ্রামের কারণে আমাদের এমনিতেই দেরি হয়ে গেছিল। প্রোগ্রাম শেষ, এ কারণে আর যাইনি। আলম এশিয়া পরিবহনের ঠিক পেছনেই ছিল মোহাম্মদপুর থেকে রামপুরা রুটের রমজান পরিবহনের দুটি বাস। ওই দুটো বাসও পরে পেছনের দিকে ঘুরিয়ে চলে যায়। মৎস ভবন ও শাহবাগ এলাকা ঘুরে দেখা যায়, ইশরাকের শপথের দাবিতে খণ্ড খণ্ড মিছিলের কারণে সড়কে দীর্ঘ যানজট লেগে যাওয়ায় অনেকেই বাধ্য হয়ে গাড়ি থেকে নেমে যাচ্ছেন। কোনো কোনো গণপরিবহন আবার যাত্রী নামিয়ে দিয়ে গাড়ি ঘুরিয়ে চলে যাচ্ছে।
পরিবহন শ্রমিকরা বলছেন, প্রতিদিন এমন সড়ক অবরোধের কারণে তারা বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়ছেন। কাজে এলেও দিন শেষে খালি হাতে ফিরতে হচ্ছে। ফলে গাড়ির মালিককে খরচের টাকা দিতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের।
রমজান পরিবহনের হেলপার আজিজ মিয়া বলেন, রাস্তা বন্ধ করে প্রতিদিনই আন্দোলন করছে। আমরা কোথায় যাব, আমাদের দোষ কী? আমাদের গাড়ি চালাতে দেন। সারাদিন এভাবে আটকে থেকে দিন শেষে মালিককে দেওয়ার টাকা হয় না। আমাদেরও তো পরিবার আছে। আমরা কীভাবে চলব।
শাহবাগ থেকে হেঁটে পল্টনের দিকে যাচ্ছিলেন মো. রশিদ। তিনি বলেন, প্রতিটা দিন আন্দোলন আর সড়ক অবরোধ ভালো লাগে না। এভাবে কী রাস্তায় চলাচল করা যায়? যেদিনই আন্দোলন হয় সেদিনই ঠিক টাইমে অফিসে যেতে পারি না। এভাবে প্রত্যেক দিন যদি আন্দোলন আর রাস্তা বন্ধ করা হয় তাহলে আমরা কীভাবে চাকরি করব?
উত্তরা থেকে আসা নাঈমুল ইসলাম নামের এক পিকআপ চালক জানান, বাবুবাজার ব্রিজ যেতে বেলা ১১টায় উত্তরা থেকে রওনা হন তিনি। দুপুর ১২টায় পৌঁছান সাতরাস্তা পর্যন্ত। এরপর সেখান থেকে কাকরাইল পর্যন্ত যেতে তিন ঘণ্টা সময় লেগেছে তার।
তিনি বলেন, আমি সব সময় কাকরাইল মসজিদ, মৎস্য ভবন, গুলিস্তান হয়ে যাই। আজ (গতকাল) যানজটের কারণে আটকে গেছি। এখন কাকরাইল, বিজয়নগর হয়ে যাওয়া লাগবে। কিন্তু প্রচণ্ড জ্যাম।
পল্টনে যানজটে আটকে ছিলেন সিএনজিচালিত অটোরিকশাচালক আমিরুল ইসলাম। তিনি বলেন, সকাল থেকে মাত্র একটা ভাড়া মারতে পেরেছি। তারপর থেকেই যানজটে আটকে আছি। সারাদিন যদি এভাবে যানজটে আটকে থাকতে হয় তাহলে মালিককে গাড়ির টাকা দেব কীভাবে আর নিজের পরিবারের খরচ তুলব কীভাবে।
এত আন্দোলন অবরোধকে ঘিরে সড়কে বিকল্প ব্যবস্থা নিলেও যানজট নিরসন হচ্ছে না উল্লেখ করে ডিএমপির ট্রাফিক রমনা বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) শফিকুল ইসলাম বলেন, মৎস্য ভবন, কাকরাইল মসজিদ এবং হেয়ার রোড বন্ধ থাকায় যানবাহনকে বিকল্প সড়কে ঘুরিয়ে দিচ্ছেন তারা। এর প্রভাবে মগবাজার, কাকরাইল, শাহবাগ এলাকায় যানবাহনের চাপ অনেক বেড়েছে। সে চাপ অধিকাংশ স্থানে যানজট তৈরি করেছে। সড়কে যানবাহনের দীর্ঘ সারি সামলাতে বেগ পেতে হচ্ছে।
তিনি বলেন, প্রতিদিন চার-পাঁচ ঘণ্টা প্রধান সড়কে ডাইভারশন দিতে হচ্ছে। এরই মধ্যে ভিআইপি ও ভিভিআইপি চলাচল থাকে। যানজটের কারণে মানুষ কোনো দিকেই ঠিকমতো চলাচল করতে পারছে না।
জানতে চাইলে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সাব্বির আহমেদ বলেন, এতদিন একপক্ষ সুবিধা নিয়েছে। বঞ্চিতরা তাই ব্যস্ত দ্রুত নিজেদের ঘাটতি মেটাতে। এ জন্য তারা দাবি আদায়ে রাজপথে নামছেন। তারা মনে করছেন, একটা অপরচুনিটি সামনে আসছে, এই সময়টাকে ইউটিলাইজ করতে সরকারের কাছ থেকে বিভিন্ন গোষ্ঠী তাদের স্বার্থ আদায়ের জন্য নানাভাবে চেষ্টা করছেন। তবে আন্দোলন করতে গিয়ে যাতে মানুষের জনদুর্ভোগ না হয় সেই দিকে সবার দৃষ্টি থাকা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে রাজপথ চলমান রাখতে আন্দোলন ইস্যুতে উপদেষ্টাদের নিয়ে একটি সেল করা যেতে পারে।
মানবাধিকার কর্মী নূর খান এ প্রসঙ্গে বলেন, যারা আন্দোলন করছেন তাদের দাবির যৌক্তিকতা আছে। গত ১৫ বছরে অনেক বৈষম্য ও অনিয়মে অনেকেই বঞ্চিত। ফলে বঞ্চিতরা মনে করছেন, এখনই সময় এই বৈষম্য অবসানের। কিন্তু তারা এই দাবি জানাতে গিয়ে নিয়মতান্ত্রিক পথে না গিয়ে সমস্যার সৃষ্টি করছেন।
আপনার মতামত লিখুন :