সংস্কারের মাধ্যমে উন্নয়নকে গুরুত্ব দিয়ে ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট উপস্থাপন করা হবে আজ। অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ এই বাজেট উপস্থাপন করবেন। এই বাজেটের মাধ্যমে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আমদানি পর্যায়ে বর্তমান শুল্ক-কর কাঠামোকে আরও যৌক্তিক পর্যায়ে নির্ধারণ করার পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে। স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে মধ্যম আয়ের দেশের কাতারে উত্তরণে বিশ্ব বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্তি এবং বৈদেশিক সাহায্য ও সহজ ঋণপ্রাপ্তির সুযোগ সংকুচিত হবে, যা থেকে উত্তরণের দিকনির্দেশনাও তুলে ধরবেন অর্থ উপদেষ্টা। আর দেশের চিকিৎসাসেবা সহজলভ্য ও সাশ্রয়ী করারও উদ্যোগ থাকবে প্রস্তাবিত এই বাজেটে।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলরে (আইএমএফ) শর্ত অনুযায়ী বর্তমান সরকার জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সংস্কার বাস্তবায়নের বিষয়টিও প্রস্তাবিত বাজেটে প্রতিফলিত হবে। শর্ত অনুযায়ী এরই মধ্যে এনবিআরকে ভেঙে রাজস্বনীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা নামে পৃথক দুটি বিভাগ সৃষ্টি করা হয়েছে। আর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণে থাকা বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারকে পুরোপুরি বাজারভিত্তিক করা হয়েছে।
জানা গেছে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর যেসব সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়েছে, সেসব বিষয়ে প্রস্তাবিত বাজেটে প্রতিফলন থাকবে। এ ছাড়া মুক্তিযোদ্ধা ও জুলাই যোদ্ধা এবং তাদের পরিবারের জন্য বেশ কিছু সুবিধার ঘোষণা থাকবে। তরুণ ও যুবকদের জন্যও থাকবে বিশেষ বরাদ্দ।
নির্বাচিত সরকার জাতীয় সংসদে বাজেট উপস্থাপন করে। কিন্তু বর্তমানে জাতীয় সংসদের কার্যক্রম না থাকায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বাজেট উপস্থাপন করা হবে টেলিভিশন চ্যানেলের মাধ্যমে। বেলা ৩টায় অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ জাতির উদ্দেশ্যে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট উপস্থাপন করবেন। জাতীয় বাজেট বক্তৃতাটি বাংলাদেশ টেলিভিশনসহ অন্য সব বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল ও বেতারে একই সময়ে প্রচার করবে বলে জানা গেছে।
জাতীয় বাজেট বাস্তবায়নে রাজস্ব আহরণ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সরকার তাই বাজেট বাস্তবায়নে রাজস্ব আয় করতে চাইছে ৫ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে এনবিআর কর রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যে নেওয়া হতে যাচ্ছে ৪ লাখ ৯৯ হাজার কোটি টাকা। এর বাইরে এনবিআর-বহির্ভূত রাজস্ব লক্ষ্য ১৯ হাজার কোটি টাকা এবং করবহির্ভূত রাজস্ব আদায় লক্ষ্য ৪৬ হাজার কোটি টাকা নির্ধারণ হতে যাচ্ছে।
এনবিআর কর রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যে সরকার কর ব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নিয়েছে। তাই কিছু খাতে কর বাড়ানোর পাশাপাশি মানুষের সুবিধার্থে কিছু খাতের কর কমানো হবে। এ ছাড়া কিছু কর সুবিধা চলতি অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ঘোষণা থাকলেও তা বাস্তবায়ন হবে ২০২৬-২৭ ও ২০২৭-২৮ অর্থবছরে, যা সরকারের বিশেষ কৌশল হিসেবে নেওয়া হচ্ছে। তবে একে অর্থনীতিবিদেরা বলছেন চাতুরতা। কারণ আগামী অর্থবছরে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে নির্বাচিত সরকার পরবর্তীতে যে বাজেট প্রস্তাব করবে তাতে এর প্রতিফলন না থাকার আশঙ্কাই বেশি।
বাংলাদেশে রাজস্ব আদায়ের গুরুত্বপূর্ণ খাতের মধ্যে মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট খাত উল্লেখযোগ্য। কর-জিডিপির অনুপাত বৃদ্ধি, দেশীয় শিল্প বিকাশে সহায়তা প্রদান, কাক্সিক্ষত রাজস্ব প্রবৃদ্ধি অর্জন, নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি, বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ, ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি, সম্মতি ব্যবধান হ্রাস, ভ্যাটের হিসাবরক্ষণ পদ্ধতি সহজীকরণ ইত্যাদি বিষয় এ বছর বাজেট প্রণয়নের মূল কৌশল হিসেবে গ্রহণ করা হচ্ছে। মূল্য সংযোজন কর খাতে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের লক্ষ্যে কিছু ক্ষেত্রে মূসকের সংকুচিত হার আদর্শ হারে উন্নীতকরণ ও সম্পূরক শুল্ক হার যৌক্তিকী করাসহ আইনের কিছু বিধান সহজীকরণ করা হয়েছে, যা রাজস্ব আদায় বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা রাখবে বলে সরকার মনে করছে।
অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ তার প্রস্তাবিত বাজেট বক্তৃতায় যা বলতে পারেন বলে ধারণা করা হচ্ছে, প্রত্যক্ষ কর একটি দেশের রাজস্ব আহরণের অন্যতম প্রধান ও টেকসই উৎস। এটি আয়বৈষম্য হ্রাস ও সামাজিক ন্যায্যতা নিশ্চিতকরণ এবং প্রগতিশীল করব্যবস্থা গঠনে কার্যকর ভূমিকা রাখে। প্রত্যক্ষ করের মাধ্যমে করদাতা ও রাষ্ট্রের মধ্যে পারস্পরিক আস্থা ও জবাবদিহিমূলক সম্পর্ক তৈরি হয়, যা সুশাসনভিত্তিক রাষ্ট্র পরিচালনার অপরিহার্য পূর্বশর্ত। এ ছাড়া অভ্যন্তরীণ সম্পদ সংগ্রহের মাধ্যমে পরনির্ভরশীলতা কাটিয়ে একটি স্বনির্ভর ও টেকসই অর্থনীতি গঠনে প্রত্যক্ষ করের গুরুত্ব অপরিসীম।
তিনি বলতে পারেন, বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে মধ্যম আয়ের দেশের কাতারে উত্তরণের দ্বারপ্রান্তে। গৌরবজনক এই উত্তরণ অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে অপার সম্ভাবনা সৃষ্টির পাশাপাশি দেশের বহির্বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্তি এবং বৈদেশিক সাহায্য ও সহজ ঋণপ্রাপ্তির সুযোগ সংকুচিত করবে। এই প্রেক্ষাপটে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের দর্শনের আলোকে একটি বৈষম্যবিরোধী, সমতাভিত্তিক, আত্মনির্ভরশীল ও উন্নত দেশ গঠনে প্রত্যক্ষ কর তথা আয়করব্যবস্থা আরও সক্ষম ও গতিশীল করার কোনো বিকল্প নেই। দেশের রাজস্বব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর উদ্দেশ্যে এরই মধ্যে মধ্য ও দীঘ মেয়াদি রাজস্ব কৌশল (মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি রাজস্ব কৌশলÑএমএলটিআরএস) প্রণয়ন করা হয়েছে এবং কর-সেবা পুরোপুরি প্রযুক্তিনির্ভর করার পরিকল্পনা গৃহীত হয়েছে।
বিদ্যমান কর ব্যয় কাঠামোকে যৌক্তিক করার লক্ষ্যে এবং কর অব্যাহতি সংস্কৃতির রাশ টানার লক্ষ্যে সম্প্রতি কর ব্যয় নীতিমালা ও এর ব্যবস্থাপনা কাঠামো প্রণয়ন করা হয়েছে এবং যৌক্তিকভাবে ও পর্যায়ক্রমে কর ব্যয় সংকোচনের নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। এখন থেকে অবারিত সময়ের জন্য কর অব্যাহতি প্রদান নিরুৎসাহিত করা হবে এবং প্রয়োজন ও প্রাসঙ্গিকতার ভিত্তিতে জাতীয় সংসদের অনুমোদনক্রমে কর অব্যাহতি প্রদান করা হবে।
অর্থ উপদেষ্টা তার বক্তৃতায় বলতে পারেন, চলতি অর্থবছরে অনলাইন রিটার্ন করদাতাদের কাছে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। এ বছর ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর জেলার সব সরকারি কর্মকর্তা, সমগ্র বাংলাদেশের সব তপশিলি ব্যাংক ও কতিপয় নির্দিষ্ট কোম্পানির কর্মকর্তা-কর্মচারীর ক্ষেত্রে অনলাইন রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক করার পরিপ্রেক্ষিতে ১৬ লাখের অধিক করদাতা অনলাইনে রিটার্ন দাখিল করেছেন। আগামী বছর স্বাভাবিক ব্যক্তি শ্রেণির সব করদাতার জন্য অনলাইনে রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। এ ছাড়া আগামীতে যাতে কোম্পানি করদাতাগণ অনলাইনে রিটার্ন দাখিল করতে পারেন সেই লক্ষ্যে কার্যক্রম এগিয়ে চলেছে।
প্রস্তাবিত বাজেটে জন্মসূত্রে বাংলাদেশি ছিলেন অথচ পরে বাংলাদেশি নাগরিকত্ব পরিত্যাগ করেছেন এমন ব্যক্তি কর্তৃক বাংলাদেশে অর্জিত আয়ের ওপর যথাযথভাবে কর পরিশোধ না করে নানা উপায়ে বিদেশে পাচার করা অর্থ-সম্পদের ওপর কর ও জরিমানা আরোপের বিধান করা হতে যাচ্ছে।
জানা গেছে, বাজেটের অংশ হিসেবে ‘প্রত্যক্ষ কর ব্যয় প্রতিবেদন’ প্রকাশ করা হয়। প্রত্যক্ষ কর ব্যয় হলো কোনো নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠী বা করদাতাদের অর্থনৈতিক বা সামাজিক সুরক্ষা প্রদানের লক্ষ্যে কোনো কর অব্যাহতি, সংকুচিত কর হার বা অনুরূপ কোনো কর সুবিধা প্রদানের ফলে যে পরিমাণ কর কম আদায় হয় তার সমষ্টি। এই প্রকার ব্যয়ের কারণে সম্ভাব্য রাজস্ব আদায় কমে যায়। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের করনীতি উইং ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রত্যক্ষ কর ব্যয় প্রাক্কলন করেছে, যার পরিমাণ ১ লাখ ৭ হাজার ১৩৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে করপোরেট পর্যায়ে কর ব্যয় ৭৩ হাজার ৯৯০ কোটি টাকা এবং স্বাভাবিক ব্যক্তি পর্যায়ে কর ব্যয় ৩৩ হাজার ১৪৩ কোটি টাকা। সামগ্রিকভাবে, ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য এই প্রত্যক্ষ কর ব্যয় মোট জিডিপির ২ দশমিক ৩৮ শতাংশ, যা পূর্ববর্তী অর্থবছরে ছিল ২ দশমিক ৯১ শতাংশ। ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রত্যক্ষ কর ব্যয় প্রাক্কলিত হয়েছিল ১ লাখ ১৫ হাজার ৫৬ কোটি টাকা, অর্থাৎ ২০২২-২৩ অর্থবছরে কর ব্যয় ৬ দশমিক ৮৮ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে।
সরকারের গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপ এর কারণে কর ব্যয় হ্রাসের প্রবণতা সৃষ্টি হয়েছে, যা ভবিষ্যতে আরও বেগবান হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
প্রস্তাবিত বাজেটে বক্তৃতায় উপস্থাপন করা হতে পারে, স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ-পরবর্তী সময়কালের চ্যালেঞ্জ ও বেশ কয়েক বছর ধরে চলে আসা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিরতা এবং সাম্প্রতিক সময়ে ট্রাম্প প্রশাসন কর্তৃক যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রপ্তানিতে পাল্টা শুল্ক আরোপ, আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে বিদ্যমান শুল্ককাঠামো বিষয়ে বাংলাদেশের অবস্থানকে পুনর্মূল্যায়ন করার প্রেক্ষাপট তৈরি করেছে।
এ জন্য আমদানি পর্যায়ের বিদ্যমান বিভিন্ন শুল্কহার ক্রমান্বয়ে হ্রাস করার প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখার মাধ্যমে করভার হ্রাস এবং গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক অংশীদার দেশের সঙ্গে প্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি (টিপিএ)/শুল্কমুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) করার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে নিজেদের অবস্থান সংহত করতে হবে। পাশাপাশি ব্যক্তি, প্রাতিষ্ঠানিক ও সরকারি পর্যায়ে শুল্ক অব্যাহতির সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসতে হবে। সর্বোপরি, পণ্য আমদানিতে রাজস্বনির্ভরতা কমিয়ে কাস্টমস ব্যবস্থাপনাকে পূর্ণাঙ্গ ডিজিটাইজেশনের মাধ্যমে ‘পেপারলেস, ফেইসলেস’ ও ব্যবসাবান্ধব করার কার্যক্রম আরও এগিয়ে নিতে কাজ করবেন অর্থ উপদেষ্টা।
আপনার মতামত লিখুন :