ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ক্ষমতার অপব্যবহার করে বিমানবন্দরের লাউঞ্জ ও দোকান বরাদ্দ, পণ্য সরবরাহ, বিনা টেন্ডারে ডিজিটাল ব্যানার ব্যবসা, ক্রেস্ট বাণিজ্যসহ বেবিচকের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অভিনেত্রী শমী কায়সারের প্রতিষ্ঠান ‘ধানসিঁড়ি কমিউনিকেশন’ ও আওয়ামী লীগ নেতা মৃণাল কান্তি দাস ‘এক্সিকিউশন’ ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের নামে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।
এসব বিষয়ে সংশ্লিষ্ট দপ্তরসহ দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) অভিযোগও জমা পড়েছে। হয়েছে একাধিক তদন্ত কমিটি। এখন পর্যন্ত কোনো তদন্তই আলোর মুখ দেখেনি। তবে সেসব অভিযোগের বিষয়ে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) ও বেসামরিক বিমান পরিবহন এবং পর্যটন মন্ত্রণালয় ফের তদন্তের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে।
গত ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর শমী-মৃণাল সিন্ডিকেটের সদস্যরা গা-ঢাকা দিলেও সম্প্রতি তারা মাথা চাড়া দিয়ে ওঠার চেষ্টা চালাচ্ছেন। এর মধ্যেই শমী কায়সার গ্রেপ্তার হওয়ায় অনেকটাই বেকায়দায় পড়েছেন সিন্ডিকেটের সদস্যরা। শমী কায়সারকে গ্রেপ্তারের পর তার দুর্নীতির দোসর মৃণাল কান্তি দাস আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরদারির মধ্যে রয়েছেন বলে জানা গেছে।
রূপালী বাংলাদেশের অনুসন্ধানে জানা গেছে, ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠান ‘ধানসিঁড়ি’র নামে শমী কায়সার ও ‘এক্সিকিউশন’-এর মাধ্যমে মৃণাল কান্তি শাহজালাল বিমানবন্দরে গত ১৫ বছর প্রভাব খাটিয়ে কোটি কোটি টাকার কাজ বাগিয়েছেন। এসব অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে অনুসন্ধানের জন্য ২০২২ সালে বিমান মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেয় দুদক। সেই তদন্ত বেশিদূর এগোয়নি। ফলে নির্ঝঞ্ঝাটে কাজ করে গেছেন তারা। বারবার তাদের ইজারা চুক্তি নবায়ন করে কোটি কোটি টাকা কামানোর সুযোগ করে দিয়েছেন বেবিচকের এক কর্মকর্তা।
ওই কর্মকর্তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সূত্রে প্রভাব খাটিয়ে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের প্রায় সব কাজই বাগিয়ে নিত শমীর প্রতিষ্ঠান। ২০২৩ সালের ১৫ অক্টোবর রাজধানীতে এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের দেশগুলোর অংশগ্রহণে ইকাও-এর ৫৮তম ডিজিসিএ সম্মেলন শুরু হয়। প্যান প্যাসিফিক হোটেল সোনারগাঁওয়ে এর উদ্বোধন করেন তৎকালীন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলী। সম্মেলনে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ৩৬ দেশ ও ১১টি আন্তর্জাতিক সংগঠনের মহাপরিচালক ও চেয়ারম্যান এবং তাদের প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেন। এই অনুষ্ঠানের ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের কাজ যৌথভাবে পায় শমী ও মৃণালের প্রতিষ্ঠান। পুরো অনুষ্ঠানে দুই কোটি টাকা খরচ না হলেও তারা বিল তুলে নেন ১৫ কোটি টাকা।
জানা গেছে, শমী কায়সার ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) সভাপতি ছিলেন। ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর গত ১৪ আগস্ট শমীকে পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। আর মৃণাল কান্তি গত ৫ আগস্ট থেকে পলাতক রয়েছেন। আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে তাদের আশীর্বাদপুষ্টদেরই বিমানবন্দরের বিলবোর্ড, লাউঞ্জ ও ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের কাজ দেওয়া হতো।
গত ১৫ বছর ধরে শাহজালাল বিমানবন্দরে ধানসিঁড়ির নামে ২ কোটি ৬২ লাখ ২ হাজার ৪৫৬ টাকা মূল্যের দুটি লাউঞ্জ মাত্র ৮৯ লাখ ১৫ হাজার ৬৬২ টাকায় ইজারা নিয়ে বাণিজ্য করে আসছে শমী কায়সারের প্রতিষ্ঠান। এতে সরকার দেড় কোটি টাকারও বেশি রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়। ধানসিঁড়ি লাউঞ্জটি শমী নিজে পরিচালনা না করে সিটি ব্যাংককে ভাড়া দিয়ে প্রতিমাসে হাতিয়ে নেন ২ কোটি টাকা। তাদের সিন্ডিকেট এতই শক্তিশালী যে, ফ্যাসিস্ট সরকার পতনের পরও তাদের গায়ে আঁচড় পড়েনি। ইজারা চুক্তি তো বাতিল হয়ইনি, উল্টো নবায়ন করা হয়।
মৃণাল কান্তি গত চার বছর ধরে শাহজালালে সব ধরনের ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের কাজ করতেন। করোনাকালে দূরত্ব বজায় রাখার জন্য শাহজালালে চৌকোনা ছক এঁকেই বাগিয়ে নেন দুই কোটি টাকা। সিভিল অ্যাভিয়েশনের বড় বড় অনুষ্ঠানে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের কাজ মৃণাল কান্তি ছাড়া কাউকে দেওয়া হতো না। কাজ বাগিয়ে নিতে সিন্ডিকেট সদস্যরা বেবিচকের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের দামি দামি উপহার দিতেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
এ ছাড়াও শাহজালাল বিমানবন্দরে আরও যেসব লাউঞ্জ ও বিজ্ঞাপনী সংস্থা পতিত সরকারের আমলে আওয়ামী ঘনিষ্ঠদের নামে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে সেগুলো হলো ডালাস- মালিক আমিনুল ইসলাম, আলবেট- মালিক আমিনুল ইসলাম, হলোগ্রাম- মালিক মোহাম্মদ আলি, মোহাম্মদ এন্টারপ্রাইজ-মালিক ফজলে রাব্বি, এরোস- মালিক নাঈম, ইননোভা- মালিক সাবেক মন্ত্রী রাশেদ খান মেননের ভাতিজা আওরঙ্গ ও করপোরেট সার্ভিসেস এজেন্সির মালিক গোলাম কিবরিয়া। এগুলোর বরাদ্দ বাতিল না করে পুনরায় নবায়ন করা হচ্ছে বলে গুঞ্জন রয়েছে। থার্ড টার্মিনালেও বিশেষ কোটায় তাদের রেস্টুরেন্ট বরাদ্দ দেওয়ার পাঁয়তারা চলছে বলে জানা গেছে।
এদিকে, সিভিল এভিয়েশনের বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায়, বিতর্কিত লাউঞ্জ ইজারাদারদের চুক্তির মেয়াদ আগামী ৩০ জুন শেষ হতে যাচ্ছে। তাদের ইজারার মেয়াদ আর নবায়ন করা হবে না বলে সূত্রটি আভাস দিয়েছে।
এ বিষয়ে বেবিচকের সদস্য (অপারেশন্স ও পরিকল্পনা) এয়ার কমোডর আবু সাঈদ মেহবুব খানের কাছে জানতে চাইলে তিনি রূপালী বাংলাদেশকে জানান, মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলতে তাদের বারণ রয়েছে।
বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ারভাইস মার্শাল মঞ্জুর কবীর ভূঁইয়া বর্তমানে বিদেশে থাকায় এ বিষয়ে তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
এদিকে, বেবিচকের দায়িত্বশীল সূত্রের বরাতে জানা যায়, মাহবুবা ট্রেডার্স, ওয়ার্ল্ড ট্রাস্ট ট্যুরিস্ট অ্যান্ড কার সার্ভিস, সজল এন্টারপ্রাইজ, এভিয়েশন ট্রান্সপোর্ট লি., এ ফাইভ রেডওয়ে লি., এরোস ট্রেডিং (৩৮ বর্গফুট, ৩৫ ও ৭৫ বর্গফুট), নাহার কনস্ট্রাকশন এবং শিরিন এন্টারপ্রাইজ পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে দোকান, লাউঞ্জ এবং পরিবহন কাউন্টারসহ অন্যান্য জায়গা বরাদ্দ নিয়েছিল। এভসেক পরিচালক এসব ইজারা বাতিলের সুপারিশ করেছেন। এ ছাড়া তালিকায় আওয়ামী দোসর ২৮ সাংবাদিকের নাম রয়েছে।
এই প্রতিবেদন তৈরির সময় জানা যায়, ‘নাহার কনস্ট্রাকশনস’-এর মালিক হলেন আওয়ামী লীগের সাবেক নেতা শওকত হাসি হাসানুর রহমান রিমন, যার বাড়িতে গত ৫ আগস্ট বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা অগ্নি সংযোগ করে। এ ছাড়া সাবেক আওয়ামী লীগ নেতা মো. তাজুল ইসলাম ও তার মা গ্রেনেড হামলায় আহত হওয়ার দোহাই দিয়ে বেবিচকের জায়গাটি ইজারা নেওয়া হয়।
আপনার মতামত লিখুন :