ঢাকা মঙ্গলবার, ২৪ জুন, ২০২৫

টেলকোর পকেটে কোটি টাকা, সরকারের শূন্য

শাওন সোলায়মান
প্রকাশিত: জুন ২৪, ২০২৫, ১২:০৭ এএম
ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

বিদেশ থেকে বাংলাদেশের মোবাইল ব্যবহারকারীদের কাছে আসা ‘শর্ট মেসেজ সার্ভিস (এসএমএস)’ বা ক্ষুদেবার্তা থেকে মোবাইল নেটওয়ার্ক অপারেটর (এমএনও) তথা টেলকো প্রতিষ্ঠানগুলোর কোটি কোটি টাকা আয় হচ্ছে। এ বাবদ বছরে অন্তত ১ হাজার ২০০ কোটি টাকার লেনদেনের প্রায় সবটুকুই হচ্ছে দেশের বাইরে। আর নামমাত্র তথ্যের ভিত্তিতে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দেওয়া হচ্ছে সামান্যই। 

দেশে কার্যক্রমে থাকা এমএনওগুলো ঠিক কী পরিমাণ আন্তর্জাতিক এসএমএস দেশে আনছে এবং সেগুলো থেকে ঠিক কী পরিমাণ আয় হচ্ছে; সেসব তথ্য তদারকির ব্যবস্থা নেই নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) কাছে। ফলে টেলকো প্রতিষ্ঠানগুলোর দেওয়া তথ্য আর রাজস্ব নিয়েই ‘সন্তুষ্ট’ থাকতে হয় সংস্থাটিকে। তবে বিটিআরসি জানিয়েছে, অচিরেই এ বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ নীতিমালা কার্যকর হতে যাচ্ছে। 

আন্তর্জাতিক এসএমএস কী এবং কীভাবে কাজ করে:

বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমার বাইরে থেকে বাংলাদেশের মোবাইল ব্যবহারকারীদের কাছে আসা ক্ষুদেবার্তাগুলোই আন্তর্জাতিক এসএমএস। এই এসএমএসগুলো দুই ধরনের যথা ‘অ্যাপ্লিকেশন টু পারসন (এটুপি)’ এবং ‘পারসন টু পারসন (পিটুপি)’। তবে বর্তমান সময়ে বিদেশ থেকে এটুপি এসএমএসই বেশি আসে দেশীয় ব্যবহারকারীদের কাছে। আর এটুপি এসএমএসের সিংহভাগ আবার ‘ওয়ান টাইম পাসওয়ার্ড (ওটিপি)’ এসএমএস। ফেসবুক, গুগল, হোয়াটস অ্যাপ, নেটফ্লিক্সের মতো প্রযুক্তি প্ল্যাটফর্মগুলোতে অ্যাকাউন্ট বা আইডি খুলতে এবং সেগুলোতে প্রবেশের ক্ষেত্রে নিরাপত্তা ব্যবস্থার অংশ হিসেবে ওটিপি এসএমএস পাঠানো হয়। আন্তর্জাতিক এসএমএস বাংলাদেশের একজন মোবাইল ব্যবহারকারীর কাছে কীভাবে আসে,

সেই কারিগরি দিক তুলে ধরে প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ আনোয়ার হাসান সাবির বলেন, ‘গুগল, ফেসবুক বা এদের মতো প্রতিষ্ঠানের এসএমএস বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মোবাইল ব্যবহারকারীদের কাছে পৌঁছে দিতে ‘ইন্টারন্যাশনাল এগ্রিগেটর’ প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এই এগ্রিগেটরদের সাথে টেলকোগুলোর চুক্তি থাকে। গুগল তার এসএমএসগুলো তেমনি একটি ইন্টারন্যাশনাল এগ্রিগেটরকে দেয়, আর সেই এগ্রিগেটর এসএমএসকে টেলিকম অপারেটরের কাছে দেয়। সবশেষে সেখান থেকে ব্যবহারকারী সেই আন্তর্জাতিক এসএমএস পায়’।

এসএমএসগুলো ইন্টারনেট গেটওয়ের (আইজিডব্লিউ) মধ্য দিয়ে আসে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে সাবির বলেন, ‘না, আসে না। যদিও নীতিমালা অনুযায়ী (আইএলডিটিএস, ২০১০) আইজিডব্লিউ হয়েই আসার কথা। কিন্তু আইজিডব্লিউ ধারণা তৈরির আগে থেকেই আন্তর্জাতিক এসএমএসগুলো সরাসরি টেলকোর কাছে যাচ্ছে। পরবর্তীতে এটাকে আইজিডব্লিউতে নিয়ে আসার কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।’ তাহলে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি এসএমএসগুলো তদারকি করতে পারে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে সাবির আরও বলেন, ‘বর্তমানে যেভাবে চলছে, তাতে আন্তর্জাতিক এসএমএস নিয়ে এমএনও’র দেওয়া তথ্যেই সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে বিটিআরসিকে। এর ফলে কোনো এমএনও যদি চায়, সে তথ্যে হেরফের করতেই পারে।’ 

আন্তর্জাতিক এসএমএসের লেনদেন হয় বিদেশে: 

অনুসন্ধানে জানা যায়, বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে বাংলাদেশের এমএনও তথা গ্রামীণফোন, রবি (এয়ারটেল), বাংলালিংক এবং টেলিটকের কাছে আন্তর্জাতিক এসএমএস নিয়ে আসতে ইন্টারন্যাশনাল এগ্রিগেটর হিসেবে কাজ করে ‘চিঞ্জ’, ‘জিএমএস’ এবং ‘ইনফোবিপ’র মতো প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানের সাথে এমএনও প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকানা বা মূল প্রতিষ্ঠানের চুক্তি হয়। 

মালিকানা এসব প্রতিষ্ঠান দেশের বাইরেই এসব চুক্তি করে এবং এসএমএস বাবদ লেনদেনও দেশের বাইরেই সম্পন্ন হয়। যেমন গ্রামীণফোনের মূল প্রতিষ্ঠান নরওয়ের টেলিনর, বাংলালিংকের নেদারল্যান্ডসভিত্তিক ভিওন এবং রবি’র মালয়েশিয়াভিত্তিক আজিয়াটা। টেলকোগুলোর মধ্যে একমাত্র রাষ্ট্রীয় অপারেটর টেলিটক আন্তর্জাতিক এসএমএস ঘোষণা দিয়ে বাংলাদেশে আনে।

এক্ষেত্রে টেলিটকের ইন্টারন্যাশনাল এগ্রিগেটর হিসেবে কাজ করে ইনফোবিপ এবং বাংলাদেশের লোকাল পার্টনার হিসেবে থাকে উইনটেল।

টেলিকম খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, টেলিটকের কোনো মালিকানা প্রতিষ্ঠান দেশের বাইরে থাকার সুযোগ না থাকায়, ইন্টারন্যাশনাল এগ্রিগেটরদের দেশেই চুক্তি করতে হয়। তবে অভিযোগ আছে, আন্তর্জাতিক এসএমএসের প্রকৃত মূল্যের চেয়ে অনেক কম আয় দেখানো হয় টেলিটকে, আর সেই অনুযায়ীই রাজস্ব বিনিময় (রেভিনিউ শেয়ারিং) করা হয় বিটিআরসির সাথে। দেশে এটুপি এসএমএস এগ্রিগেটর হিসেবে নিবন্ধিত একটি সূত্রের মতে, প্রতি মাসে গড়ে প্রায় ৭ লাখ আন্তর্জাতিক এসএমএস আসে টেলিটক ব্যবহারকারীদের কাছে। প্রতি এসএমএসের বিপরীতে টেলিটকের আয় দেখানো হয় মার্কিন মুদ্রায় গড়ে ৬ থেকে ৭ সেন্ট (১০০ সেন্টে ১ মার্কিন ডলার) যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৮ টাকা। 

তবে খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, এটুপি হিসেবে আসা আন্তর্জাতিক এসএমএসের প্রকৃত মূল্য আরও বেশি। অন্য এমএনওগুলোর সাথে ইন্টারন্যাশনাল এগ্রিগেটরদের এসএমএস প্রতি ১২ থেকে ২৫ সেন্টের চুক্তি হয়। যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১৫ থেকে ৩০ টাকা। সেই হিসাবে এসএমএস প্রতি এমএনওদের আয় হয় গড়ে ২৫ টাকা। অবশ্য কখনো কখনো ইন্টারন্যাশনাল এগ্রিগেটররা অপারেটরদের সাথে নির্দিষ্ট অঙ্কের বিনিময়ে বছর হিসেবে ‘আনলিমিটেড’ বা ‘বাল্ক’ এসএমএসের চুক্তি করে। অর্থাৎ ইনফোবিপ, চিঞ্জ বা জিএমএসের মতো এগ্রিগেটরগুলো এমএনওকে নির্দিষ্ট অঙ্কের অর্থ পরিশোধ করে, এক বছরের জন্য সব এসএমএস কিনে নেয়। 

লেনদেনের পরিমাণ এবং সরকারের রাজস্ব ফাঁকি: 

দেশে ঠিক কী পরিমাণ আন্তর্জাতিক এসএমএস আসে তার প্রকাশিত কোনো সংখ্যা নেই। গ্রামীণফোন এবং বাংলালিংকের কাছে তাদের ব্যবহারকারীদের কাছে আসা আন্তর্জাতিক এসএমএসের সংখ্যা জানতে চাইলেও, উত্তর দেয়নি অপারেটর দুটি। তবে দেশের অন্তত তিনজন এটুপি এসএমএস ব্যবসায়ী এবং প্রযুক্তিবিদের সাথে কথা বলে প্রতিবেদক। তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রতি মাসে প্রায় ৪ কোটি আন্তর্জাতিক এসএমএস আসে। 

গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এক হিসাবে, এই এসএমএসের মাসিক গড় ছিল প্রায় সাড়ে ৩ কোটি। তবে সম্প্রতি এই সংখ্যা ৫ কোটিকেও ছাড়িয়ে যায়। পরিচয় গোপন রাখার শর্তে এক এগ্রিগেটর ব্যবসায়ী বলেন, ‘এসএমএসের থেকে ভয়েস কল সাশ্রয়ী। তাই মাঝের কিছু সময় ফেসবুক, গুগলের মে তা প্রতিষ্ঠানগুলো ওটিপি ক্ষুদেবার্তার বদলে ভয়েস কলের মাধ্যমে পাঠাচ্ছিল। মাইক্রোসফট তাদের সব ওটিপি এখন ভয়েস কলের মাধ্যমে পাঠায়। তাই এসএমএসের মাসিক গড় কিছুদিন কম ছিল। এখন আবার সেটি বাড়ছে।’

এই হিসাবে এসএমএস প্রতি ২৫ টাকা গড় ধরলে, আর মাসিক এসএমএসের গড় ৪ কোটি হিসাবে, আন্তর্জাতিক এসএমএস বাবদ প্রতি মাসে এমএনওগুলোর আয় হচ্ছে ১০০ কোটি টাকা। ফলে বছর হিসাবে এই লেনদেনের পরিমাণ অন্তত ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা। অভ্যন্তরীণ এটুপি এসএসএম এগ্রিগেটর নীতিমালা অনুযায়ী, এসএমএস থেকে আয়ের ৬ দশমিক ৫ শতাংশ দিতে হয় বিটিআরসি তথা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে। 

এগ্রিগেটর লাইসেন্স পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোকে লাইসেন্স পাওয়ার দ্বিতীয় বছর থেকে রেভিনিউ শেয়ারিং বাবদ আয়ের ৫ দশমিক ৫ শতাংশ এবং সামাজিক দায়বদ্ধতা তহবিলের চাঁদা হিসেবে ১ শতাংশ বিটিআরসিকে দিতে হয়। সেই হিসাবে, বছরের ১ হাজার ২০০ কোটি টাকার মধ্যে থেকে ৭৮ কোটি টাকা পাওয়ার কথা বিটিআরসির। 

তবে টেলিটক বাদে বাকি এমএনওগুলোর সাথে ইন্টারন্যাশনাল এগ্রিগেটরদের চুক্তি এবং লেনদেন দেশের বাইরে হওয়াতে, একদিকে যেমন বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রায় দেশে আসছে না, তেমনি সরকারও রাজস্ব থেকে হচ্ছে বঞ্চিত। অবশ্য বেসরকারি অপারেটর বাংলালিংক আন্তর্জাতিক এসএমএসের লেনদেন বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমানায় করার উদ্যোগ নিয়েছে বলে টেলিকম খাতসংশ্লিষ্ট এক সূত্রের মাধ্যমে জানা যায়। 

আন্তর্জাতিক এসএমএস প্রসঙ্গে ইনফোবিপের সাথে সংশ্লিষ্টতা নিয়ে জানতে চাওয়া হলে গ্রামীণফোনের হেড অব কমিউনিকেশনস শারফুদ্দিন আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘আন্তর্জাতিক এসএমএসের ক্ষেত্রে গ্রামীণফোনের ইনফোবিপের সাথে কোনো সরাসরি বা আনুষ্ঠানিক চুক্তি নেই। 

আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্ম অথবা ওটিটি যেমন ফেসবুক ও গুগলের পাঠানো এসএমএস বার্তাগুলো বিভিন্ন আন্তর্জাতিক এগ্রিগেটর দ্বারা গ্রামীণফোনের গেটওয়ের মাধ্যমে গ্রামীণফোন নেটওয়ার্কে আসে এবং সেসব এগ্রিগেটরের মধ্যে ইনফোবিপ একটি সম্ভাব্য রুট হতে পারে, তবে গ্রামীণফোন এই বিষয়ে কোনো সরাসরি বাণিজ্যিক অংশীদার নয়। গ্রামীণফোন শুধু বৈধ ও অনুমোদিত আন্তর্জাতিক ট্রানজিট পার্টনারদের মাধ্যমেই বার্তা গ্রহণ করে এবং সংশ্লিষ্ট আইন ও বিটিআরসি নির্দেশনা অনুযায়ী সব প্রযোজ্য কর ও রেভিনিউ শেয়ারিং নিষ্পত্তি করে থাকে।’ 

পাশাপাশি এক লিখিত বক্তব্যে বাংলালিংক জানায়, ‘বাংলালিংক একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে তার সব কার্যক্রমে সর্বোচ্চ মানের কমপ্লায়েন্স, স্বচ্ছতা ও নৈতিকতা বজায় রাখে। প্রতিটি সেবার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য সব আইন, বিধি ও নীতিমালা কঠোরভাবে অনুসরণ করি।’

বিটিআরসির তদারকি:

প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ আনোয়ার হাসান সাবির বলেন, ‘বিটিআরসি চাইলে মাত্র এক মাসেই এমন ব্যবস্থা দাঁড় করাতে পারে, যা দিয়ে দেশে আসা আন্তর্জাতিক এসএমএস তদারকি করা সম্ভব’।

দেশের তথ্যপ্রযুক্তি ও টেলিকম খাতের দীর্ঘদিনের ব্যবসায়ী ফয়সাল আলিম রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘আন্তর্জাতিক এসএমএসের বিষয়টি বিটিআরসির তদারকিতে আনা উচিত। এ থেকে এখন বিটিআরসি তথা সরকার প্রচুর পরিমাণে রাজস্ব হারাচ্ছে। বিদ্যমান আইএলডিটিএস (ইন্টারন্যাশনাল লং ডিসটেন্স টেলিকমিউনিকেশন্স সার্ভিস, ২০১০) পলিসিতেই এটা করা যায়’। 

এ বিষয়ে বিটিআরসির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) এমদাদ উল বারী রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, আন্তর্জাতিক এসএমএসের বিষয়ে একটি নীতিমালা করে ইতোমধ্যে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পেলেই সেটি কার্যকর করা হবে। সেই নীতিমালার আলোকে আন্তর্জাতিক এসএমএসের জন্য লাইসেন্স দেওয়া হবে। তখন এই সমস্যার সমাধান হবে’। 

আন্তর্জাতিক এসএমএসকে আইজিডব্লিউ ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে আনা হবে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে বিটিআরসি চেয়ারম্যান বলেন, ‘নতুন লাইসেন্সিং পলিতে আইজিডব্লিউ স্তর না রাখার সুপারিশ করা হয়েছে। আইজিডব্লিউর স্থলে যে ব্যবস্থা বা স্তর রাখা হবে, আন্তর্জাতিক এসএমএসকেও সেই ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে দেশে আনা হবে’।