অযত্ন ও অবহেলায় মলিন হতে চলেছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) মূল্যবান দৃষ্টিনন্দন প্রকল্প হাতিরঝিল। চারদিকে ভাঙাচোরা, ময়লা-আবর্জনার স্তূপ, নিরাপত্তা সংকট ও বিস্তৃত লেকের বিবর্ণ চেহারার সঙ্গে উৎকট গন্ধ হাতিরঝিলকে ক্রমশ অচেনা করে তুলেছে। অথচ শুরু থেকে এই নগরের ক্লান্ত মানুষজন দলবেঁধে এখানে এসে স্বস্তি খুঁজে পেতেন। এখন নিতান্ত প্রয়োজন না হলে কেউ আর এই এলাকায় আসতে চান না।
ফলে হাতিরঝিল হারাতে বসেছে তার অর্জিত গৌরব। আশ্চর্যের বিষয় সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই রাজউকের। নেই কার্যকর পদক্ষেপ। অবশ্য বর্তমান রাজউক চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার রিয়াজুল ইসলাম এরই মধ্যে কয়েকদিন হাতিরঝিল পরিদর্শনে এসে বেশকিছু অনিয়ম ও বিশৃঙ্খলা চাক্ষুস দেখে কিছু নির্দেশনা দিয়েছেন। কিন্তু এসব নির্দেশনা বাস্তবতার গায়ে একটুখানি স্পর্শ বলে মন্তব্য করেছেন এলাকাবাসী।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, নিরাপত্তা সংকটে রীতিমতো কাবু হয়ে পড়েছে হাতিরঝিল। সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গেই ভয়াবহ হয়ে ওঠে পুরো এলাকা। ছিনতাই, ইভিটিজিং এবং খুন এখানে নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। এমন কোনো দিন নেই, ঝিলের পানিতে লাশ ভেসে না আসে। আজ পর্যন্ত এসব ঘটনার কারণ উদঘাটন হয়নি। ধরা পড়েনি কোনো অপরাধী।
এলাকাবাসী মনে করেন, পুরো এলাকা কিশোর অপরাধীরা কব্জা করে নিয়েছে। কিন্তু সংঘবদ্ধ এই অপরাধীরা বরাবরই রয়ে গেছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। শুরুতে এলাকার নিরাপত্তা দেখভাল করত সেনাবাহিনী। এখানে সেনাবাহিনীর স্থায়ী ক্যাম্প এখনো আছে। তবে সদ্যবিদায়ী রাজউক চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) ছিদ্দিকুর রহমান সরকার নিরাপত্তার বিষয়টি আনসার বাহিনীর কাছে হস্তান্তর করেন।
এলাকাবাসীর ধারণা, এরপর থেকেই মূলত আইনশৃঙ্খলার ভয়াবহ অবনতি হয়। আনসারদের টহল খুব একটা দেখা যায় না। আর মাঝেমধ্যে টহল দলকে চোখে পড়লেও ভয়ানক অপরাধীরা তাদের মোটেও তোয়াক্কা করে না। আনসারদের সামনেই নানা সহিংসতা ঘটে।
বেশ ক’জন বয়োবৃদ্ধ এলাকাবাসী বলেন, অবস্থা এমন পর্যায়ে ঠেকেছে যে, দিনের বেলাতেই এই এলাকায় এলে গা-ছমছম করে। এখানে ওখানে চলে অপরাধীদের জটলা। কখনো কখনো ছেলেমেয়েদের মধ্যে বাগবিতণ্ডা এবং হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। আর সন্ধ্যার পর ছিনতাইকারিদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয় গোটা এলাকা। সব মিলিয়ে হাতিরঝিল এখন এক ভীতির নাম।
এদিকে এলাকাটিতে চোখ বুলালেই কেমন যেন শ্রীহীন মনে হয়। আগেকার সেই চাকচিক্য নেই, সৌন্দর্য নেই এক ধরনের রুক্ষতা জেঁকে বসেছে হাতিরঝিলের অবয়বে। চারদিকের সুশোভিত গাছগাছালিগুলো প্রাণ হরিয়েছে। প্রথম নজরেই অযত্নের ছাপ দৃষ্টিতে আসে।
অন্যদিকে অভ্যন্তরীণ রাস্তাঘাট ও ওয়াকওয়ের করুণ দশা ক্ষোভ বাড়াচ্ছে। জায়গায় জায়গায় রাস্তার ছাল-বাকল ওঠে গেছে, ভেঙে গেছে ওয়াকওয়ের সিমেন্টের স্লাবগুলো। একটু পরপর দেখা যায় স্লাবের অস্তিত্বই নেই। ফলে হাঁ-হয়ে আছে গর্তগুলো। সতর্ক দৃষ্টিতে তাকালে বিশ্রী লাগে। পাশাপাশি বড় ধরনের দুর্ঘটনার শঙ্কা তো রয়েছেই।
এ ছাড়া ওয়াকওয়ে ধরে হেঁটে গেলে সারবিদ্ধ ফুলের টবগুলোর অসহায়ত্ব দৃষ্টি এড়ায় না। অনেক টবে গাছ শুকিয়ে গেছে, কোনো কোনোটিতে আবার গাছই নেই। টবগুলোতে জঞ্জালে ভরে রাখা হয়েছে। ড্রেনগুলোর অবস্থাও বহাল, অপরিষ্কার তো বটেই নানা ময়লার গন্ধে এলাকা দিয়ে চলা দায়। ড্রেনের ওপরের লোহার গ্রিলগুলো উধাও হয়ে গেছে। এলাকাবাসীর মতে, বখাটেরা এগুলো নিয়ে বেচে দিয়েছে।
তারা জানান, গাছের চারা লাগানো মূল্যবান লোহার খাঁচা এবং তারকাঁটার বেড়া প্রায় প্রতিদিনই চুরি হয়ে যাচ্ছে। এতে করে সৌন্দর্য হারানোর সঙ্গে সঙ্গে নিরাপত্তার শঙ্কা দ্বিগুণ বেড়ে গেছে। রূপালী বাংলাদেশের অনুসন্ধানে দেখা যায়, সঠিক পরিচর্যার অভাবে প্রকল্পে মূল্যবান দেশি ও বিদেশি প্রজাতির গাছগুলো রুগ্ণ হয়ে পড়েছে। কিছু কিছু গাছ একেবারে মারাই যাচ্ছে।
সৌন্দর্যবর্ধক নয়নাভিরাম সবুজ ঘাসগুলো এখন আর খুব একটা চোখে পড়ে না। জায়গায় জায়গায় ঘাসগুলো তুলে ফেলা হয়েছে। ঘাসের ওপর প্রাকৃতিক পরিবেশের স্বাদ নেওয়ার উপায় নেই। ভ্রাম্যমাণ হকারদের উৎপাতে ঘাস আচ্ছাদিত কিছু কিছু জায়গায় বসতে গিয়ে হোঁচট খান ভ্রমণেচ্ছুরা। ঘাসগুলোর ওপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে নানা জঞ্জাল বাদামের খোসা এবং চিপসের খালি প্যাকেট।
ফলে দলবদ্ধ পিঁপড়াদের আস্তানা হয়ে দাঁড়িয়েছে ঘাসে ভরা এই বিস্তীর্ণ এলাকা। সন্তর্পণে হেঁটে ডানে-বাঁয়ে তাকালে দেখা যায়, ময়লা-আবর্জনার স্তূপ। অধিকাংশ ময়লার ড্রামই খোয়া গেছে। তাই ময়লা-আবর্জনা যেখানে সেখানে ফেলে রাখা হয়েছে। এখন এই প্রকল্প আশপাশের বাসাবাড়ির ময়লা ফেলার নিরাপদ স্থান হয়ে দাঁড়িয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, হাতিরঝিলের অন্যতম সৌন্দর্য বিস্তীর্ণ লেকটিও এখন অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে বাসাবাড়ি এবং দোকানপাটের ময়লা এসে মিশছে লেকের পানির সঙ্গে। ফলে রূপ-লাবণ্য হারিয়ে পুরো লেকের পানি সবুজ রং ধারণ করেছে এবং উৎকট গন্ধে লেকের পাড়ে দাঁড়ানোই দুষ্কর।
অথচ ইদানিং ঘনঘন হাতিরঝিল পরিদর্শনে আসেন বর্তমান রাজউক চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার রিয়াজুল ইসলাম। তাকে ঘিরে থাকেন আনসার সদস্য এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। নানা কথাবার্তার ভিড়ে হাতিরঝিলের বর্তমান দুরবস্থা তাই রাজউক চেয়ারম্যানের সামনে খুব একটা দৃশ্যমান হয় না। ফলে রাজউক চেয়ারম্যানের ঘনঘন পরিদর্শন হাতিরঝিলের জন্য খুব একটা সুফল বয়ে আনতে পারছে না বলে এলাকাবাসীর অভিমত।
এই লেক নিয়ে আরও গল্প আছে। আগেকার রাজউক চেয়ারম্যানের সময়ে লেকে প্রায় তিনশ হাঁস ছাড়া হয়েছিল। উদ্দেশ্য, সৌন্দর্য ছড়ানোর পাশাপাশি বাণিজ্যিক লাভ হাসিল। কিন্তু ক’দিন পর সেই হাঁসগুলোকে লেকে ভাসতে দেখা যায়নি।
শোনা যায়, তদারকির অভাবে হাঁসগুলো চুরি হয়ে গেছে। লাভের লাভ কিছুই হলো না, মাঝখান দিয়ে কয়েক লাখ টাকা জলে চলে গেল।
রূপালী বাংলাদেশের অনুসন্ধান চলাকালে হাতিরঝিলের বেশকিছু সড়কবাতি বিকল দেখতে পাওয়া যায়। কোনো কোনো পোস্টে সকেট আছে, বাল্ব নেই। ফলে সন্ধ্যার কিছু অংশে ঘুঁটঘুঁটে অন্ধকার নেমে আসে।
জানা যায়, প্রকল্পটির রক্ষণাবেক্ষণে একটি অস্থায়ী কার্যালয় আছে, আছেন বেশ কয়েকজন কর্মচারী। কিন্তু তাদের কোনোরকম কার্যক্রম নেই।
উল্লেখ্য, ২০০৭ সালের অক্টোবরে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) প্রকল্পটি অনুমোদিত হয়। ব্যয় বরাদ্দ ধরা হয় ১ হাজার ৯৭১ কোটি ৩০ লাখ টাকা। এর মধ্যে রাজউকের ১১৩ কোটি ৭ লাখ, এলজিইডির ২৭৬ কোটি এবং ঢাকা ওয়াসার ৮৬ কোটি ৬৭ লাখ ৫০ হাজার টাকার ফান্ডিং রয়েছে।
২০০৭ সালের হাতিরঝিল সমন্বিত উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ শুরু হয়, শেষ হয় ২০১৯ সালে। ৩১১ একর জমির ওপর নির্মিত দৃষ্টিনন্দন এই প্রকল্পটি ২০২১ সালের ৩০ জুন রাজউকের কাছে হস্তান্তর করে সেনাবাহিনী।
সার্বিক বিষয়ে রাজউক চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার রিয়াজুল ইসলাম রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, আমি এখন যাওয়া-আসা শুরু করেছি। সবকিছুতেই নজর দেওয়া হচ্ছে।
আমরা আগে সড়ক বাতিগুলো ঠিকঠাক করার চেষ্টা করছি। ইতোমধ্যে এক-দেড়শ বাতি প্রতিস্থাপনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এরপর আমরা ওয়াকওয়েসহ অন্যান্য বিষয়ে হাত দেব। তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, ধীরে ধীরে আগের রূপে ফিরে আসবে হাতিরঝিল।