ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই, ২০২৫

মন্তব্য প্রতিবেদন 

অপরাধীরা দাপুটে বিড়াল তবু ঘণ্টা বাঁধতেই হবে

পারভেজ খান
প্রকাশিত: জুলাই ৫, ২০২৫, ০৭:১৯ এএম
ছবি- রূপালী বাংলাদেশ

মোতালেব হোসেন। উত্তরবঙ্গে বাড়ি হলেও থাকেন রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার একটি ভবনে। ওই ভবনেই তত্ত্বাবধায়কের চাকরি করেন তিনি। তবে অবসর পেলেই পড়েন পত্রিকা। চোখ রাখেন টেলিভিশনের পর্দায়ও। প্রচলিত শিক্ষায় সেভাবে তার দখল না থাকলেও বোধের প্রখরতা বেশ। 

কথা প্রসঙ্গে তিনি বললেন, ‘স্যার, দেশে হচ্ছেটা কী? চারপাশে এসব কী ঘটছে? পত্রিকার পাতা আর টেলিভিশনের পর্দায় চোখ রাখলেই দেখা যায় শুধু অপরাধের খবর।

ধর্ষণ, খুন, নারী-শিশু নির্যাতন, ছিনতাই, ডাকাতি, রাহাজানি, থানায় হামলা চালিয়ে আসামি বা সাজাপ্রাপ্ত আসামিকে ছিনিয়ে নেওয়া, ঘরের ভেতর হামলা চালিয়ে মা-ছেলে-মেয়েকে পিটিয়ে হত্যা, গাছের সঙ্গে বেঁধে প্রকাশ্যে শিক্ষককে মারধর, রাস্তায় কুপিয়ে-গুলি করে হত্যা, প্রকাশ্যে চাঁদাবজি, যখন যেখানে যেভাবে খুশি আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার প্রবণতা আর মব জাস্টিসসহ কি না ঘটছে চারপাশে! কারা এগুলো করছে, তা স্পষ্ট এবং প্রচারমাধ্যমে অনেক ঘটনার সচিত্র প্রতিবেদনও তুলে ধরা হচ্ছে। তার প্রশ্ন- এসব কী ঘটছে আসলে?

দেশের পরিস্থিতি যে কতটা ভয়াবহ পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে, তা বর্তমান সরকারের একজন উপদেষ্টার কথাতেই স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। উপদেষ্টার মতে, দেশে নারী-শিশু নির্যাতনের চলমান পরিস্থিতি নাকি মহামারির পর্যায়ে। পুলিশ সদর দপ্তরের পরিসংখ্যানও বলছে, দেশের অপরাধ সংঘটনের হার বেড়েছে। 

বলা হচ্ছে, রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণেই এসব ঘটছে। তাহলে ধরে নেওয়া যায়, সরকার বিরাজমান পরিস্থিতির কথা স্বীকারও করছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, দায়িত্বপ্রাপ্তরা করছেনটা কী! তাদের দায়িত্ব বা কর্তব্য কী? একটা অরাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় চারপাশে এসব কীভাবে ঘটে চলেছে?

উপদেষ্টা আরও বলেছেন, মাদ্রাসাগুলোয় শিশুদের যৌন নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে; যা অনেক সময় সরকারের চোখের আড়ালে থাকে। স্কুল ও মাদ্রাসায় মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সরাসরি যেতে হবে এবং জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। নারী ও শিশু মন্ত্রণালয়ে এখন পর্যন্ত প্রায় ৩ লাখ নানান ধরনের নির্যাতনের অভিযোগ জমা পড়েছে। এসবের মধ্যে গুরুত্ব বুঝে শতাধিক নারীকে কাউন্সেলিং ও আইনি সহায়তা দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে সহায়তা করা হয়েছে বলেও তিনি তার এই খোলামেলা বক্তব্যে উল্লেখ করেছেন। 

একজন উপদেষ্টার এই সরল মন্তব্যকে সাধুবাদ জানানো যায়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, লাগামটা টেনে ধরবে কে? ধরার দায়িত্বটা কার? প্রায় ৩ লাখ অভিযোগের মধ্যে মাত্র দুই শতাধিক নারী আইনি সহায়তা পেয়েছেন। এটা কি যথেষ্ট? তিনি জাবাবদিহির কথাও বলেছেন। জবাবদিহির আওতায় আনাটা কার দায়িত্ব? মাদ্রাসার ঘটনাগুলো চোখের আড়ালে থাকে কেন? নজরদারিতে রাখবেন কারা? উপদেষ্টা কি নিজেদের ব্যর্থতার তির নিজেদের দিকেই ছুড়লেন না! 

এ ধরনের প্রশ্ন এখন দেশের প্রত্যেক সচেতন নাগরিকের। তাদের কথা, পুলিশকে সাহায্য করতে তিন বাহিনীর সদস্যরা মাঠে আছেন। এমনকি তাদের বিচারিক ক্ষমতাও দেওয়া হয়েছে। এর পরও প্রতিদিন কোনো না কোনো বড় ধরনের ঘটনা ঘটছে। যেসব ঘটনা শুধু দেশে নয়, আন্তর্জাতিক পর্যায়েও সুনাম ক্ষুণ্ন হচ্ছে। 

সম্প্রতি ঘটে যাওয়া দুই-একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করা যেতেই পারে। গেল বুধবার রাতের ঘটনা। রাজনৈতিক পরিচয়ধারী দুর্বৃত্তরা লালমনিরহাটের পাটগ্রাম থানায় হামলা চালিয়ে হাজতখানা খুলে সাজাপ্রাপ্ত দুই আসামি বেলাল হোসেন ও সোহেল রানা চপলকে ছিনিয়ে নেয়। রাত সাড়ে ১০টার দিকে দুই শতাধিক ব্যক্তি থানায় ঢুকে প্রথমে ভাঙচুর শুরু করে। 

তারা থানার চেয়ার, টেবিল, কম্পিউটার ও ল্যাপটপ ভাঙচুর, গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র তছনছ, ইট-পাটকেল ছুড়ে থানার জানালার কাচ ও দরজা ভেঙে ফেলে। বাধা দিলে উভয় পক্ষে সংঘর্ষ হয়। হামলায় ওসিসহ অন্তত ২০ পুলিশ সদস্য আহত হন। পরে আশপাশের তিন থানা থেকে অতিরিক্ত পুলিশ, সেনাবাহিনী ও বিজিবি সদস্যরা এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন।

ওসির ভাষ্য, হামলাকারীরা স্থানীয় বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। যদিও স্থানীয় বিএনপি এই অভিযোগ সঠিক নয় বলে দাবি করেছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ওসির দাবি বা বিএনপি নেতাদের অস্বীকার করাটাই কি একমাত্র সাক্ষ্য? কারা এটা করেছে এবং কেন করেছে, সেটা বের করা কি প্রশাসনের জন্য খুব কঠিন কাজ? বর্তমান সরকার কোনো রাজনৈতিক সরকার নয়। ফলে রাজনীতিসংশ্লিষ্ট যেই হোক না কেন, তিনি যদি কোনো অপরাধ করেও থাকেন, তাকে ধরতে বাধাটা কোথায়? এই প্রশ্নও সবার। 

সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জের হরিপুরে বিদ্যুৎকেন্দ্রের ঠিকাদারি নিয়ে বিএনপির দুই পক্ষে বিরোধের জেরে ‘আওয়ামী লীগের দোসর’ আখ্যা দিয়ে ‘মব’ তৈরি করে মহানগর বিএনপির এক সাবেক সহসভাপতিকে বিবস্ত্র করে মারধরের ঘটনা ঘটেছে।

কুমিল্লার মুরাদনগরে এক নারীকে ধর্ষণ এবং পরে ঘটনাটির ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে দেশজুড়ে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। মুরাদনগরে পৃথক অপর ঘটনায় হামলা চালিয়ে মা এবং তার দুই সন্তানকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। কুষ্টিয়ায় একটি লাশবাহী অ্যাম্বুল্যান্সে সশস্ত্র ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে।

অ্যাম্বুল্যান্সে থাকা স্বজনদের মারধরের পাশাপাশি তাদের স্বর্ণালংকার ও টাকা লুট করা হয়। অলংকারের জন্য মরদেহেও তল্লাশি চালিয়েছে ডাকাতের দল। কোথাও এক স্কুলশিক্ষককে গাছের সঙ্গে বেধে মারধর করা হচ্ছে। কোথাও কোথাও চাঁদা না দেওয়ায় মারধর করা হচ্ছে ব্যবসায়ীকে। আর এসবের পেছনেই রয়েছে কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্যদের সম্পৃক্ততা। 

পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণ করলেও একই চিত্র মিলছে। হত্যা, নারী ও শিশু নির্যাতন, ধর্ষণ, ডাকাতি, দস্যুতা ও চুরি-ছিনতাইয়ের ঘটনা দিনে দিনে বাড়ছে। পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্যে দেখা গেছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত পাঁচ মাসে দেশে ১ হাজার ১৩৯টি ডাকাতি ও দস্যুতার মামলা হয়েছে; যা গড়ে প্রতি মাসে ২২৮টি। গত বছর প্রতি মাসে এই সংখ্যা ছিল গড়ে ১৫৮। এই পাঁচ মাসে হত্যা মামলা হয়েছে ১ হাজার ৫৮৭টি; যা গড়ে প্রতি মাসে ৩১৭টি। 

আগের বছর প্রতি মাসে ছিল ২৮৬টি। নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনায় গত পাঁচ মাসে ৯ হাজার ১০০ মামলা হয়েছে; যা গড়ে প্রতি মাসে ১ হাজার ৮২০টি। আগের বছর গড়ে প্রতি মাসে নারী ও শিশু নির্যাতনের আইনে মামলা ছিল ১ হাজার ৪৬৪টি। অপহরণের মামলা এই পাঁচ মাসে গড়ে প্রতি মাসে ৮৭টি; গত বছর প্রতি মাসে ছিল ৫৪টি। চুরি-ছিনতাইয়ের ঘটনায় এই পাঁচ মাসের মধ্যে গড়ে প্রতি মাসে ৯৮৫টি মামলা হয়েছে। এই পরিসংখ্যানই বলে দিচ্ছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কতটা অবনতি হয়েছে। 

বিশ্লেষকেরা বলছেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো আগের মতো পুরোপুরি অপরাধ নিয়ন্ত্রণে কাজ করতে পারছে না। তারা বলছেন, কোনো অপরাধের ঘটনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হলে তখন পুলিশ তা নিয়ে তৎপর হয়। এর বাইরে পুলিশ এখনো মাঠ পর্যায়ে সক্রিয়তার প্রমাণ দিতে পারেনি।

বিরাজমান দেশের এই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে পুলিশের দুজন সাবেক প্রধান বলেন, গণঅভ্যুত্থানের পর প্রত্যাশা অনুযায়ী এখনো মনোবল ফেরেনি পুলিশের। তার পরও পুলিশ চেষ্টা করছে পরিস্থিতি যতটা সম্ভব স্বাভাবিক রাখতে। তবে এর চাইতেও আরেকটি প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে সেই পুরাতন প্রবাদ ‘বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাধবে কে’ কথাটির মতো। 

এই দুষ্ট আর দাপুটে বিড়াল কারা, সেটা পুলিশ দেখছে ঠিকই, কিন্তু তার গলায় ঘণ্টা পরানোর সাহস পাচ্ছে না। কেননা, এই দুষ্টরা যদি ভবিষ্যতে আরও ক্ষমতাবান হয়ে তাদের মনিব হয়ে ওঠে, তখন তো সমূহ বিপদ দেখা দেবে। আর এ কারণেই তারা দেখেও মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছে। ফলে রাজনৈতিক স্বচ্ছতা না আসা পর্যন্ত এই পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে আসাটা নিতান্তই অসম্ভব। 

পুলিশের সাবেক এ দুই আইজির মতে, আরেকটি বড় সমস্যা হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। কিছু মহল এটিকে তাদের অপপ্রচারের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। দেশকে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে অচল করে রাখতেই তাদের এই অপপ্রায়স। 

আর এই চক্রের সঙ্গে সম্প্রতি বিদায় নেওয়া ফ্যাসিবাদী সরকারের দোসররাও রয়েছে। ফলে এখান থেকে বের হয়ে আসতে হলে শুধু সরকার নয়, গণমাধ্যমসহ সব সচেতন নাগরিকদের এগিয়ে আসতে হবে। 

লেখক: ব্যবস্থাপনা সম্পাদক, দৈনিক রূপালী বাংলাদেশ