বাংলাদেশ ব্যাংক জুলাই মাসের শেষ নাগাদ নতুন মুদ্রানীতি প্রকাশ করবে, যা মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে সম্প্রসারিত করার লক্ষ্য নেওয়ার ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। ফলে বর্তমান সংকোচনমূলক অবস্থান থেকে সরে আসবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে নীতি সুদহার ২৫ বেসিস পয়েন্ট থেকে ৫০ বেসিস পয়েন্ট কমানো হতে পারে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।
সূত্রমতে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) নির্দেশনা অনুসারে নীতি সুদের হারে সামান্য সমন্বয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছে। তারিখ চূড়ান্ত না হলেও নতুন মুদ্রানীতি চলতি মাসের শেষের দিকে ঘোষণা করা হতে পারে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মূল লক্ষ্য বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি, মুদ্রা বিনিময় হার নিয়ন্ত্রণ ও মূল্যস্ফীতি কমানো। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি ও মুদ্রা বিনিময় হার নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছে। তবে মূল্যস্ফীতি কমে আসলেও তা কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জন হয়নি। গভর্নর এ বিষয়ে চিন্তিত। তার লক্ষ্য ছিল মূল্যস্ফীতি সাত থেকে সাড়ে সাত শতাংশে নামিয়ে আনা।
তিনি বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে বিনিয়োগ বাড়াতে হলে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি থেকে বের হয়ে আসা উচিত। তবে মূল্যস্ফীতির কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জন না হওয়ায় গভর্নর এখনো সিদ্ধান্ত নেননি নীতি সুদহার কমাবেন না বর্তমান অবস্থায় থাকবে। তাই এই মুহূর্তে কিছু বলা যাচ্ছে না মুদ্রানীতি কি হতে যাচ্ছে। তবে সব দিক বিবেচনা করে, এবার আমরা কিছুটা ভিন্ন পদ্ধতি দেখতে পাব, এটি ততটা সংকোচনমূলক নাও হতে পারে।
জানা গেছে, ২৭ অক্টোবর নীতি সুদহার ৫০ ভিত্তি পয়েন্ট বাড়ানো হয়েছিল। ফলে ওভারনাইট রেপো সুদহার ১০ শতাংশে উন্নীত হয় এবং ঋণসহ সব ধরনের ব্যাংকিং পণ্যের সুদের হার বেড়ে যায়।
ওই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, নীতি সুদহার করিডরের ঊর্ধ্বসীমা স্ট্যান্ডিং ল্যান্ডিং ফ্যাসিলিটি (এসএলএফ) সুদহার ১১ শতাংশ থেকে ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ১১ দশমিক ৫০ শতাংশে পুনর্নির্ধারণ করা হয়েছিল। এ ছাড়া নীতি সুদহার করিডরের নি¤œসীমা স্ট্যান্ডিং ডিপোজিট ফ্যাসিলিটি (এসডিএফ) সুদহার ৮ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৮ দশমিক ৫০ শতাংশে বেসিস পয়েন্ট করা হয়েছিল।
চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে, বাংলাদেশ ব্যাংক মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং বেসরকারি বিনিয়োগ পুনরুজ্জীবিত করার মধ্যে একটি সূক্ষ্ম ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য তার কৌশলকে সূক্ষ্মভাবে কাজে লাগিয়েছিল।
ব্যবসায়ী নেতারা দীর্ঘদিন ধরে যুক্তি দিয়ে আসছেন যে, বিদ্যমান কঠোর নীতি বিনিয়োগকে হ্রাস করেছে, সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে।
ডিসিসিআই সভাপতি তাসকিন আহমেদ বলেন, আমরা আশা করি, আসন্ন মুদ্রানীতি আরও ব্যবসাবান্ধব হবে এবং ঋণপ্রবাহ বৃদ্ধির লক্ষ্যে তা করা হবে। আমরা আরও নমনীয় মুদ্রানীতির আশা করছি, বিশেষ করে উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাওয়া সুদের হার হ্রাসের আশায় রয়েছি।
ক্রমবর্ধমান ভোক্তা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক পূর্বে তার নীতিমালার হার ৮ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়েছিল। যদিও এই পদক্ষেপ মুদ্রাস্ফীতি কমাতে সাহায্য করেছিল, তবে এটি বিনিয়োগের গতিকেও বাধাগ্রস্ত করেছিল। এই বিষয়টি স্বীকার করে নীতিনির্ধারকরা এখন তাদের দৃষ্টিভঙ্গি সহনীয় করার দিকে ঝুঁকছেন বলে আভাস পাওয়া গেছে।
গবেষণা সংস্থা পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান মাসরুর রিয়াজ সতর্ক করে বলেন, মুদ্রাস্ফীতি কেবল মুদ্রা সরবরাহের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। মুদ্রাস্ফীতি কেবল অর্থ সরবরাহের কারণে হয় না। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশ ব্যাংক নীতি সুদ হার বৃদ্ধি করলেই বাংলাদেশের মুদ্রাস্ফীতি কমে আসবে না। মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য, আমাদের সরবরাহ শৃঙ্খলকে কার্যকরভাবে পরিচালনা করতে হবে।
বিশ্লেষকরা একমত যে, সরবরাহ শৃঙ্খলকে শক্তিশালী করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যদিও এই ধরনের সংস্কার বাস্তবায়ন এখনো কঠিন চ্যালেঞ্জ। বিনিময় হারের চাপ, টাকার অবমূল্যায়ন এবং ঋণের ব্যয় বৃদ্ধির ফলে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি হ্রাস পেয়েছে, যা বর্তমানে ৮ শতাংশের নিচে।
কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এই মাসের শেষের দিকে ঘোষিত নতুন নীতিমালায় দেখা যাবে যে, বাংলাদেশ ব্যাংক মুদ্রাস্ফীতিকে আবারও বাড়তে না দিয়ে তাদের টাকার চাপ কমাতে কতটা প্রস্তুত, তা প্রকাশ পাবে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) জুনের মূল্যস্ফীতির চিত্র প্রকাশ করেছে। এতে দেখা যায়, গত জুনে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমে ৮ দশমিক ৪৮ শতাংশ হয়েছে, যা বিগত ৩৫ মাসের মধ্যে সর্বনি¤œ। এর আগে ২০২২ সালের জুলাইয়ে ৭ দশমিক ৪৮ শতাংশ মূল্যস্ফীতি হয়েছিল। এরপর গত জুনের মতো এত কম মূল্যস্ফীতি আর হয়নি।
বিবিএস বলছে, গত জুনে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৭ দশমিক ৩৯ শতাংশ। আর খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি হয় ৯ দশমিক ৩৭ শতাংশ।