বিগত ১৬ বছর নির্মম নির্যাতন মুখ বুঝে সহ্য করে লড়াই-সংগ্রাম চালিয়ে দল ও দেশের জন্য হাজারো ত্যাগ স্বীকার করেছে দেশের অন্যতম বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি। এবার নিজেদের ওপরই নির্মম নির্যাতনের অভিযোগ নিয়ে ভয়াবহ বাস্তবতার মুখোমুখি দলটি। তৃণমূলের কিছু উচ্ছৃঙ্খল ও লোভী নেতাকর্মীর অপরাধে যুক্ত হওয়ার অভিযোগে দলটির সব ত্যাগ যেন হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। বাইরের দমন নয়, বরং ভেতরের বিশৃঙ্খলা, গোষ্ঠীগত সংঘাত এবং অপরাধীদের দাপটেই বিএনপির গ্রহণযোগ্যতা এখন প্রশ্নের মুখে। একসময় যে দল ‘সুশাসনের প্রতিশ্রুতি’ নিয়ে শাসনক্ষমতায় এসেছিল, সেই বিএনপির অঙ্গ সংগঠনের কর্মীর হাতই রঞ্জিত হচ্ছে আরেকজনের রক্তে। দলের হাইকমান্ড প্রথম থেকেই নেতাদের কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। এমনকি তৃণমূলের কয়েক হাজার নেতাকর্মী বহিষ্কার করেও অপরাধমূলক কর্মকা- থেকে ফেরানো যাচ্ছে না। নানা অপরাধে জড়িত হওয়া কিছু নেতাকর্মীর কারণে দলটি প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে নতুন করে ভয়াবহ রাজনৈতিক সংকটে পড়েছে বিএনপি। বর্তমান পরিস্থিতি কীভাবে সামলে ওঠা যাবে, তা নিয়ে রাজনীতির মাঠে রীতিমতো অগ্নিপরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়েছে বিএনপি।
সম্প্রতি রাজধানীর পুরান ঢাকায় মিটফোর্ডের নৃশংস হত্যাকা-ের ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাম্যমে ছড়িয়ে পড়লে নিন্দার ঝড় উঠে সব মহলে। এ ঘটনায় বিএনপির অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের সম্পৃক্ততায় ব্যাপকভাবে চাপে পড়ে দলটি। ঘটনায় জড়িত অভিযোগে যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও ছাত্রদলের পাঁচ নেতাকর্মীকে সংগঠন থেকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করা হলেও তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছে বিএনপি। সাধারণ মানুষ বলছে, শুধু বিবৃতি দিয়ে দায় এড়াতে পাড়ে না বিএনপি। হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (এইচআরএসএস) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে ২০২৫ সালের মে পর্যন্ত বিএনপির ভেতরে ৪৩২টি সংঘর্ষে নিহত হয়েছেন অন্তত ৭৪ জন। আর এই ১০ মাসে আহত হয়েছেন হাজারেরও বেশি নেতাকর্মী। খুনোখুনির এসব ঘটনার মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ ও নৃশংস হচ্ছে গত ৯ জুলাই রাজধানীর মিটফোর্ডের হাসপাতালের সামনে ঘটা হত্যাকা-।
হাসপাতালের মূল ফটকের সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়া ভয়াবহ দৃশ্যে দেখা যায়, একদল যুবক ভাঙারি ব্যবসায়ী লাল চাঁদ ওরফে সোহাগকে প্রকাশ্যে হত্যা করে নির্মমভাবে নিহতের বুকের ওপর লাফ দিচ্ছে। এ ঘটনায় যুক্ত রয়েছেÑ এমন অভিযুক্তদের অনেকেই বিএনপির অঙ্গ সংগঠনের ছাত্রদল, যুবদল বা স্বেচ্ছাসেবকদলের কর্মী। এমনকি নিহত সোহাগও যুবদলের কর্মী। রাজনৈতিক দলের নাম ব্যবহার করে প্রকাশ্যে এমন নৃশংস খুন বিএনপির নতুন রাজনৈতিক ভাষা কি নাÑ ঘটনার পর তা নিয়ে ব্যাপক চর্চা শুরু হয় সাধারণের মাঝে। বিএনপির ভেতরেও তৈরি হয় প্রবল প্রতিক্রিয়া।
সাবেক ছাত্রদল নেতা মামুন খান সামাজিক মাধ্যমে এক ভিডিও বার্তায় বলেন, ‘২৪ ঘণ্টার মধ্যে অপরাধীদের কমিটি ভেঙে না দিলে, আমরা গুলশানের চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয় অভিমুখে মার্চ করব।’ শুধু তাই নয়, ছাত্রদল থেকে পদত্যাগ করতেও দেখা গেছে বেশ কয়েকজন নেতাকে।
মধ্যযুগীয় কায়দায় এমন হত্যাকা- বিচ্ছিন্নতা নাকি ব্যর্থতাÑ সেই প্রশ্নের তীরও বিঁধেছে বিএনপির বুকে। কেন্দ্রীয় নেতারাও প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন বিভিন্নভাবে। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘বিএনপি কখনোই অপরাধীদের আশ্রয় দেয়নি, দেবে না। দল গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ব্যবস্থা নিচ্ছে’। স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘ঘটনা বিচ্ছিন্ন। বিএনপির বিরুদ্ধে অপরাজনীতি করা হচ্ছে’। দলকে কলুষমুক্ত করতে শিগগিরই শুদ্ধি অভিযান চালাবে বলেও জানান তিনি। অন্যদিকে ঘটনার সঙ্গে যুক্তদের স্থায়ী বহিষ্কার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে অভিযুক্ত সংগঠন যুবদল।
অপরাধ দমনে বিএনপির জিরো টলারেন্স বলা হলেও, খুনের দায়ে স্থায়ী বা অস্থায়ী বহিষ্কারই সমাধান হতে পারে না কি নাÑ তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। যদিও বিএনপি নেতারা বলছেন, বিএনপি সাংগঠনিকভাবে তাদের বহিষ্কার করতে পারে। সেই কাজটি করেছে। এখন কাজ তো পুলিশ প্রশাসনের। পুলিশ কি করছে? যাদের ছবি আছে তাদের কেন এখনো গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না তা নিয়ে উল্টো প্রশ্ন তুলেছে বিএনপি। বিএনপি বহিষ্কার করায় অভিযুক্তদের ওপর থেকে বিএনপির ছায়া সরে গেছে। এখন তো তাদের গ্রেপ্তার বা বিচারে কোনো বাধা থাকার কথা নয়।
অন্যদিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়া বা দলীয় প্রভাবশালী নেতাদের চাপে পদক্ষেপ না নেওয়ার সংস্কৃতি অপরাধপ্রবণতাকে উৎসাহিত করেছে। দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকার কারণে কেন্দ্র ও তৃণমূলের মধ্যে যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতা এর জন্য দায়ী। দীর্ঘ দমন-পীড়নের ফলে অনেক নেতাকর্মী ‘অস্তিত্ব রক্ষার’ নামে অপরাধকে হাতিয়ার বানাচ্ছেন। এ ছাড়া অনুপ্রবেশ ও বিভাজন, বহিরাগত দুর্বৃত্তদের অনুপ্রবেশে দলের অভ্যন্তরীণ সংঘাতে ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। অপরাধীর দলীয় পরিচয় বিবেচ্য না করে, শাস্তি নিশ্চিত করতে পারলে সংকট কমবে বলে মনে করেন তারা।
বিএনপির সহদপ্তর সম্পাদক তাইফুল ইসলাম টিপু রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ব্যবস্থা নিয়েছে বিএনপি। প্রয়োজনে আরও কঠোর হবো’। কোনো অপরাধীর ঠাঁই হবে না বিএনপিতে। চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, ‘দলে দুষ্ট ও সুবিধাভোগীদের জায়গা নেই। শৃঙ্খলা ফেরাতে সময় লাগবে। তবে থেমে থাকবে না বিএনপি’।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘আমরা দলের ভেতরেই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিচ্ছি। ইতোমধ্যে দুই হাজারের বেশি নেতাকর্মীকে বহিষ্কার করা হয়েছে। প্রয়োজনে আরও হবে। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান শুরু থেকেই বলে আসছেন, কোনো গুন্ডা চাঁদাবাজকে বিএনপি প্রশ্রয় দেয়নি, আর দেবেও না। আমরা একটি সুন্দর বাংলাদেশ গঠন করতে চাই। তবে এই নিয়ে যাতে কেউ অপরাজনীতি না করে, সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। বিচারহীনতার যে সংস্কৃতি সেটা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে’।
তিনি আরও বলেন, ‘নিজ দলের ভেতরে কেউ অপকর্ম করলে তার বিরুদ্ধেও সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। অনেকে আছে, গত ১৭ বছরে বিভিন্ন সময়ে জেলে গেছে, ত্যাগ স্বীকার করেছে কিন্তু এখন বিশৃঙ্খলায় জড়িয়েছে, তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্যও দল থেকে অনুরোধ করা হচ্ছে’। এমন বিশৃঙ্খলা হলে নির্বাচনে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে জানান তিনি।
শীর্ষ এই নেতা বলেন, আমরা যেখানে প্রতিনিয়ত প্রতিটি ঘটনার পর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিচ্ছি, সাধারণ মানুষ বুঝতে পারছে বিএনপিতে কেউ অপরাধ করলে পার পাওয়ার সুযোগ নেই। অবশ্যই আমরা বিশৃঙ্খলা বন্ধ করব। হয়তো কিছুটা সময় লাগবে’।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সাব্বির আহমেদ রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, রাজনীতির সবচেয়ে গভীর সংকট হলো দল গঠনে কোনো স্ট্যান্ডার্ড মানদ- নেই। আজ দলগুলোতে অসংখ্য অঙ্গসংগঠন রয়েছে যেমন- যুবদল, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক দল কিংবা স্বেচ্ছাসেবক লীগ। এসব অঙ্গসংগঠনের প্রকৃত প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কোনো বিচার-বিশ্লেষণ নেই। এসব সংগঠনের হাতে প্রকৃত কোনো কাজ না থাকায় তারা নিজেরা কাজ তৈরি করে নেয়, যার সহজ পথ হলো চাঁদাবাজি। রাজনৈতিক দলের কোনো কার্যকর নিয়ন্ত্রণ নেই, নেতার কথাও তৃণমূল কর্মীরা শুনতে চায় না। গত ১৫ বছরের কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা একটি বড় পরিবর্তন এনেছে রাষ্ট্রক্ষমতা যেন এখন লুটপাটের উৎস। যখন একটি দল রাষ্ট্রকে লুটে নেয়, তখন অন্য দলগুলোও সেই সংস্কৃতিতে উৎসাহিত হয়।
তিনি আরও বলেন, এখন আইন থাকলেও তা ক্ষমতাশীলদের পক্ষে ব্যবহার হয়। আগে আওয়ামী লীগ ছিল, এখন বিএনপিও ক্ষমতায় না গিয়েই সেই একই মানসিকতা নিয়ে চলছে। কোনো রাজনৈতিক দলে নেই শৃঙ্খলা, নেই নৈতিক শিক্ষা। আমাদের দলগুলো চলছে চরম বিশৃঙ্খলার মধ্যে দিয়ে।
তিনি আরও বলেন, দেশে আইনের শাসনের অভাব ভয়াবহ। অগণিত অঙ্গসংগঠন থাকার দরকার নেই, নেতাকর্মীরা যেখানে তেমন কাজই করছে না, সেখানে ১০১টি সংগঠন করে শুধু বিশৃঙ্খলা ও গুন্ডামি বাড়ানো হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও রাজনীতি বিশ্লেষক মোবাশ্বের হোসেন বলেন, বিএনপি বা তার অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা কখনোই কোনো অপরাধে জড়াবে না এমন নিশ্চয়তা দলটির পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়। তবে অপরাধীদের যদি প্রশ্রয় দেওয়া হয়, তাহলে তার দায় অবশ্যই বিএনপির। এখন পর্যন্ত দেখা গেছে, বিএনপির যেসব নেতাকর্মী অপরাধে জড়িয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে দল শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েছে। সে কারণে দলটিকে পুরোপুরি দায়ী করার সুযোগ নেই। বরং আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ব্যর্থতার দায় সরকারের ঘাড়ে বর্তায়। গত ১৬-১৭ বছরে কোনো ভদ্রলোকের পক্ষে রাজনীতি করা কার্যত অসম্ভব করে তোলা হয়েছে, ফলে সেই শূন্যতা পূরণ করেছে দুর্বৃত্তরা।
তিনি আরও বলেন, শুধু বহিষ্কার করলেই সমস্যার সমাধান হবে না। এখন সময় এসেছে অপরাধীর পাশাপাশি তাদের মদদদাতাদের, বিশেষ করে সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন নেতাদেরও বহিষ্কার করার। তার ভাষায়, ‘সময় বড়ই নির্মম। এখনই শুদ্ধি অভিযান শুরু না করলে, ভবিষ্যতে হয়তো বিএনপির সামনে কোনো পথই খোলা থাকবে না’।