ঘড়ির কাঁটায় তখন দুপুর সোয়া ১টা। রাজধানীর উত্তরার খ্যাতনামা মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে গতকাল সোমবারের অধিকাংশ ক্লাসের ছুটি হয়েছে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে কেউ বাসায় ফেরার জন্য বের হয়েছে, কেউ প্রাইভেট কোচিংয়ের জন্য অপেক্ষা করছে, কেউ ক্যান্টিনে নাস্তা করছে। আরও ১০ মিনিট পর সব ক্লাস ছুটি হওয়ার কথা।
সন্তানদের বাসায় নেওয়ার জন্য স্কুলের গেটে অপেক্ষা করছেন তাদের স্বজনরা। এমন সময় স্কুলের একটি ভবনের ওপর আঁছড়ে পড়ে বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমান। সঙ্গে সঙ্গে বিকট শব্দে ছড়িয়ে পড়ে আগুন। ভবনটির নিচতলার সামনে বিমানটি আছড়ে পড়ার কারণে গেটে আগুন জ্বলছিল, এজন্য দ্বিতীয় তলা থেকে শিক্ষার্থীরা নিচে নামতেও পারছিল না। চোখের সামনে এই মৃত্যুপুরী দেখে বাকরুদ্ধ ভয়াবহ মৃত্যু থেকে বেঁচে ফেরারা। সেই সময়ের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েছেন অনেকই। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যারা নিহত হয়েছে তাদের অধিকাংশই স্কুল ছুটির পর কোচিংয়ের জন্য অপেক্ষা করছিলেন।
জানা গেছে, মাইলস্টোন স্কুলের হায়দার আলী ভবনটির মাঝখানে প্রধান ফটক ও দোতলার ওঠার সিঁড়ি। ভবনের প্রধান ফটকে আছড়ে পড়েছে বিমানটি। নিচতলার এক পাশ দিয়ে প্রবেশ করে আরেক পাশ দিয়ে কিছু অংশ বের হয়েছিল। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ও সেনাসদস্যরা বিভিন্ন যন্ত্র দিয়ে বিমানটির বিভিন্ন অংশ কেটে বের করেন।
যুদ্ধবিমান দুর্ঘটনার সময় ক্লাসে ছিলেন কলেজটির দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী শাফায়েত কবির আবির। গতকাল বিকেলে এই শিক্ষার্থী সাংবাদিকদের বলেন, যখন দুর্ঘটনা ঘটে তখন আমরা ক্লাসে ছিলাম। হঠাৎ একটা আওয়াজ হয়। ট্রান্সমিটার বিস্ফোরণ হলে যেমন আওয়াজ তেমন। জানালা দিয়ে দেখি ধোঁয়া উড়তেছে। এরপর আমরা সবাই দৌড়ে নিচে যাই, দেখি প্লেন ক্রাশ হয়েছে। দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। তখন পর্যন্ত ফায়ার সার্ভিস, আর্মি পৌঁছাতে পারেনি। তখন আমরা ওপরে উঠি, গ্রিল কেটে শিক্ষার্থীদের বের করার ট্রাই করি। এরপরই ফায়ার সার্ভিস, আর্মি আসে।’
এ শিক্ষার্থী বলেন, নিচতলায় ভবনের সামনে বিমান আছড়ে পড়ার কারণে গেটে আগুন জ্বলছিল। এ জন্য দ্বিতীয় তলা থেকে শিক্ষার্থীরা নিচে নামতে পারছিল না। ওপর থেকে তো বের হওয়া পসিবল (সম্ভব) না। এ জন্য আমরা দেয়াল বেয়ে ওপরে উঠে গ্রিল কেটে তাদের বের করার ট্রাই করি। আমার কোলে শুয়ে একজন মারা গেছে। এরপর আমি অচেতন হয়ে যাই, পরে আমাকে হসপাতালে নিয়ে যায়।
তার মতো শাহরিয়ার নামের একাদশ শ্রেণির আরেক শিক্ষার্থী বলেন, আমরা পাশের ভবনে ক্লাস করছিলাম। হঠাৎ বিস্ফোরণের শব্দে কেঁপে উঠি। জানালায় তাকিয়ে দেখি দোতলা ভবনে আগুন। কয়েক সেকেন্ড পরেই পুরো ভবনটা দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকে।
গতকাল বিকেলে রাজধানীর উত্তরার দিয়াবাড়ির এই স্কুলটির আরও কয়েকজন শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের কথায় ফুটে উঠে চোখের সামনে মৃত্যুপুরী হওয়ার এই চিত্র।
তারা জানান, দুপুর সোয়া ১টার কিছু পর হঠাৎ বিকট শব্দে কেঁপে ওঠে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ এলাকা। বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ বিমান আচমকা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে প্রথমে স্কুলের পাঁচতলাবিশিষ্ট সাত নম্বর ভবনের ছাদে ধাক্কা লাগে। পরে বিমানটি স্কুল সেকশনের দোতলা ভবনে পড়ে বিধ্বস্ত হয়।
প্রাথমিক ধাক্কার পর বিমানটি পাশের দোতলা ভবনের ওপর ভেঙে পড়ে এবং সঙ্গে সঙ্গেই ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটে। ওই ভবনে তখন প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শতাধিক শিক্ষার্থী অবস্থান করছিল। বিস্ফোরণের তীব্রতায় ভবনে আগুন ধরে যায়, মুহূর্তেই তা ছড়িয়ে পড়ে পুরো কাঠামোয়।
মাইলস্টোনের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী মিনহাজ জানায়, আমি তখন স্কুল ক্যান্টিনে খাবার খাচ্ছিলাম, হঠাৎ বিকট শব্দ শুনি। দেখলাম, বিমানটি পাঁচতলা ভবনে ধাক্কা খেয়ে দোতলা ভবনে পড়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে আগুন ধরে যায়। সবাই চিৎকার করছে, দৌড়াচ্ছে। অনেক ছোট ভাইবোনের শরীরে আগুন ধরে যায়।
প্রতিষ্ঠানটির একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী মিরাজ বলেন, চোখের সামনে অনেক ছোট ভাইবোনকে পুড়তে দেখেছি। কারো শরীর ছিন্নভিন্ন। বুঝতেই পারছিলাম না আমি স্বপ্ন দেখছি, নাকি সত্যি!
একাদশ শ্রেণির আরেক শিক্ষার্থী অনিক শেখ বলেন, জীবনে প্রথমবার মৃত্যুকে এত কাছ থেকে দেখলাম। আগুন, ধোঁয়া আর ছোটাছুটি এই শব্দগুলো মাথায় গেঁথে গেল। আমাদের স্কুলটা যেন এক নিমিষেই মৃত্যুপুরী হয়ে উঠল।
তৃতীয় শ্রেণিপড়ুয়া শ্রেয়া ঘোষকে নিতে মা পপি ঘোষ ফটক দিয়ে ভেতরে ঢুকছিলেন। ঠিক সেই সময়ে বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমানটি স্কুল ভবনে আছড়ে পড়ে। পপি ঘোষ বলেন, আমার মেয়ের স্কুল ছুটি হয়েছে। অভিভাবকেরা সন্তানদের নিচ্ছিলেন। আমার যেতে ৫ মিনিটের মতো দেরি হয়েছে। স্কুলের ফটক দিয়ে প্রবেশ করছিলাম, এ সময় বিমান আছড়ে পড়ে। ফায়ার সার্ভিস উদ্ধারকাজে আসার পর একপর্যায়ে শ্রেয়াকে উদ্ধার করা হয়। পরে তাকে নেওয়া হয় জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে। পপির সঙ্গে থাকা স্বজনেরা চিকিৎসকের বরাত দিয়ে জানান, শ্রেয়ার শরীরের ৮-১০ শতাংশ পুড়ে গেছে।
কলেজের ভবনের যে অংশে বিধ্বস্ত হওয়া বিমানটি আছড়ে পড়ে, সেখানে কিছু শিক্ষার্থী স্কুল ছুটির পরও জড়ো হয়ে ছিল। কিছু অভিভাবকও হয়তো সেখানে ছিলেন বলে জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিস।
মাইলস্টোন কলেজের প্রভাষক রেজাউল ইসলাম জানিয়েছেন, ছুটির আগ মুহূর্ত বা ছুটি হবে হবে, এমন সময়ে ঘটনাটা ঘটেছে। প্রশিক্ষণ বিমানটি সরাসরি বিল্ডিংয়ে আঘাত করে। সেটা জুনিয়র সেকশনের বিল্ডিংয়ে পড়ে, নার্সারি, ওয়ান, টু, থ্রিÑ এসব ক্লাস ওই বিল্ডিংয়ে হয়। বিল্ডিংয়ের গেটে একেবারে গর্ত হয়ে আগুন ধরে যায়।