দুই হাতে পোড়া ক্ষত। সাদা ব্যান্ডেজে মোড়ানো দুই হাত। ডান হাত দুই দিকে দিয়ে চিত হয়ে শুয়ে আছে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের দগ্ধ চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী মেহেরিন ওরফে ছোয়া। মুখম-লও ঝলসানো তার। কিছুটা ভালো থাকলেও গতকাল দুপুর থেকে অবস্থার অবনতি হচ্ছে মেয়েটির। কথা বলতে পারছে না। কাছে গেলে পোড়া হাতের দিকে তাকিয়ে আঙুল নাড়ানোর চেষ্টা করে, ইশারায় শরীরের যন্ত্রণা বোঝানো চেষ্টা করে অপলক তাকিয়ে থাকে ছোয়া। প্রাণচঞ্চল মেয়েটা একটু নড়তেও পারছে না। বাবা হিসেবে এ দৃশ্য দেখার মতো না।
জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের এফএইচডিইউ ইউনিটের সামনে কান্নাজড়িত কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন ছোয়ার বাবা সালাহউদ্দিন। আর নিবিড় পরিচর্চা কেন্দ্রের (আইসিইউ) সামনে বিলাপ করছিলেন ৭ম শ্রেণির শিক্ষার্থী মাহতাবুর রহমান ভূঁইয়ার বড় বোন নাবিলা। তিনি বলেন, ‘ও বুঝতে পারছে না শরীরে কী হইছে? সকালে একটু জুস খাইয়ে দিছি। আমাকে বলে, আমি কি বাঁচব আপু? কথাগুলো বলতে বলতে আবার কান্নায় ভেঙে পড়েন নাবিলা।’
সায়মার শরীরের ১৫ শতাংশ দগ্ধ হয়েছে। দুই হাত, দুই পা ও মুখম-ল পুড়ে গেছে। ছোট্ট এই শিশু দগ্ধের কথা যেন বুঝতেই পারছে না। শুধু বলছে, ‘আমি আর সহ্য করতে পারছি না। মা, আমার কষ্ট হচ্ছে।’ শিশুটির পাশে দাঁড়িয়ে থাকা স্বজনরা বলছে, ‘বাবা, এইতো সুস্থ হয়ে যাবে। ওপরে নিয়ে খাবার দেব। লিফট এলেই আমরা ৭ তলায় যাব। সেখানে গেলে ভালো লাগবে। কান্না করে না বাবা।’ কিন্তু কষ্ট কি বোঝে স্বজনদের সান্ত¡না। সায়মার কান্নার আর্তনাদ যেন বাড়তেই থাকে।
শুধু সালাহউদ্দিন ও নাবিলাই নয়, বার্ন ইনস্টিটিউটের সব স্বজনের একই অবস্থা। দুর্ঘটনার পর থেকেই আর্তনাদ আর আহাজারিতে কাটছে তাদের। যাদের শ্বাসনালি পুড়েছে, তাদের সবাই চোখের অথবা হাতের ইশারায় নিজের যন্ত্রণা বোঝানোর চেষ্টা করছে। যারা কথা বলতে পারছে, মা মা! আর পারছি না, অনেক কষ্ট হচ্ছে, বাবা আমাকে হাসপাতাল থেকে নিয়ে যাওÑ এমন সব কথা বলে পোড়া যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে আর বাঁচার আকুতি জানাচ্ছে। স্বজনরাও কোমলমতি শিশুদের এমন করুণ পরিণতি মানতে পারছেন না। আল্লাহর কাছে চোখের মণি সন্তানের প্রাণ ভিক্ষা চেয়ে কেউ নফল নামাজ পড়েই যাচ্ছেন, কেউ তাসবিহ পড়তে পড়তে চোখের পানি ফেলছেন, আবার কেউ কান্নায় লুটিয়ে পড়ে বিলাপ করছেন।
গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে বার্ন ইনস্টিটিউটে এমন সব হৃদয়বিদারক ঘটনা দেখা যায়। আইসিইউ, এফএইচডিইউ ও সাধারণ ওয়ার্ডগুলোর সামনে স্বজনদের বুকফাটা আহাজারি থামানো যাচ্ছে না কিছুতেই। অন্তত প্রাণে যেন বেঁচে থাকে আদরের সন্তানÑ এই একটিই প্রার্থনা সবার। এর সাথে সন্তানের মৃত্যুর খবর আসার আতঙ্ক তো আছেই। কোনো প্রয়োজনে ওয়ার্ড নাম্বার উল্লেখ করে স্বজন খুঁজলেই আতঙ্কে আঁতকে উঠছেন স্বজনরা।
মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে ভয়াবহ বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৩১ জনের মৃত্যুর খবর জানা গেছে। এ ছাড়া শহরের বিভিন্ন হাসপাতালে আরও দেড় শতাধিক দগ্ধ চিকিৎসাধীন রয়েছে। এর মধ্যে জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ৪৪ জন ভর্তি রয়েছে। হাসপতালটির ৪, ৫ ও ৭ তলায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় দগ্ধদের রাখা হয়েছে। ৪ তলায় নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্র (আইসিইউ), ৫ তলায় কেবিন ও ৭ তলায় রয়েছে হাই ডিপেন্ডেন্সি ইউনিট (এইচডিইউ)। সেখানে চিকিৎসা চলছে দগ্ধদের। হাসপাতালে স্বজনদের আহাজারিতে বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। সন্তানদের পুরোনো স্মৃতি নিয়ে কান্না করছেন স্বজনরা। আবার কাউকে কাউকে সন্তানদের এক পলক দেখার জন্য আইসিইউর সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। এদিকে বার্ন ইনস্টিটিউটে ভর্তি দগ্ধদের মধ্যে বেশির ভাগই শিক্ষার্থী এবং কোমলমতি শিশু। তাদের সবার অবস্থাই আশঙ্কাজনক বলেও জানান জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের আবাসিক সার্জন ডা. শাওন বিন রহমান।
জানা গেছে, আহতদের মধ্যে ৩০ জনের অবস্থা বিপজ্জনক। এই ৩০ জনের মধ্যে অন্তত ১০ জনের অবস্থা অত্যন্ত আশঙ্কাজনক বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
মেহেরিনের বাবা সালাহউদ্দিন বলেন, মেয়ের কষ্ট আর নিতে পারছি না। একটু ভালোর দিকে ছিল। কিন্তু গতকাল দুপুরের পর থেকে অবস্থা একটু খারাপের দিকে। শঙ্কা আর দুশ্চিন্তায় দিন কাটছে আমাদের।
আতঙ্কে ঘুমাতে পারছে না মুনতাহা: পোস্ট অপারেটিভ ওয়ার্ডে ভর্তি মুনতাহা তোয়া কর্ণর (১০) শরীরের পুড়েছে ৫ শতাংশ। তুলনামূলক ভালো আছে সে। কাদামাখা প্যান্ট, শার্ট ঘামে ভিজে আবার শুকিয়েছে বহুবার। ঘটনার পর থেকে হাসপাতালে এভাবেই অপেক্ষা করছেন তার বাবা আবুল কালাম আজাদ। কর্ণ স্কুলটির ৪র্থ শ্রেণিতে পড়ে। তার বাবা জমি কেনাবেচা করেন। থাকেন সাভার বিরুলিয়া আকড়ান এলাকায়। ২ ছেলে ও ১ মেয়ের মধ্যে মেজো কর্ণ। বড় ছেলে প্রাণন একই স্কুল থেকে এবার এসএসসি পাস করেছে।
বাবা আবুল কালাম বলেন, ঘটনার দিন সকালে আমিই মেয়েকে স্কুলে দিয়ে আসছি। যেখানে বিমান পড়েছে, ওই স্থানের পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল মুনতাহা। বিমান পড়ার সাথে সাথে অন্যদিকে দৌড় দেয় সে। তবে বিস্ফোরণের তাপ এসে লাগে তার দুই হাতে। কাঁধের স্কুল ব্যাগেও আগুন ধরে গিয়েছিল। পরে সেনাবাহিনী তাকে উদ্ধার করেছে। এরপর বার্ন ইনস্টিটিউটে আনা হয়। কয়েক হাসপাতাল ঘুরে বার্ন ইনস্টিটিউটে এসে মেয়েকে দেখতে পাই। খুব ভয় পেয়েছে আমার মেয়েটা। সারা রাতে ঘুমাতেও পারেনি।
জীবন বাজি রাখলাম, তা-ও মেয়েটা বাঁচল না!: মাইলস্টোনের ৪র্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী সামিয়া আক্তারের বাবা আবদুর রহিম আইসিইউর সামনে অশ্রুসিক্ত অবস্থায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। কান্নাবিজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ঘটনার সময় সামিয়াকে নিতে আমি স্কুলের বাইরেই অপেক্ষা করছিলাম। হঠাৎ করে বিকট শব্দে বিস্ফোরণের পর আগুন দেখে আতঙ্কিত হয়ে পড়ি। যেখানে আগুন ওখানেই তো আমার মেয়ে এটি দেখে আমি ভেতরে প্রবেশ করি। নিচতলা থেকেই আমার মেয়েকে দেখতে পাই। দেয়াল বেয়ে ওপরে উঠি। মেয়েকে খুঁজে পাচ্ছিলাম না। গ্রিল ভেঙে মেয়েকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিই। তখনো বুঝিনি ওর শ্বাসনালি পুড়ে গেছে। এখন কী হবে জানি না? তাপে ওর ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মেয়েকে বাঁচাতে নিজের জীবন বাজি রাখলাম, এখন বুঝতেছি, মেয়ে আমার বাঁচত না। আক্ষেপ করে আবদুর রহিম বলেন, কোনো ঘটনা ঘটলে সবাই ভিডিও করতে ব্যস্ত হয়ে যায়। শুরুতে বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার পর সবাই চিল্লাচিল্লি শুরু করলে সবাই দৌড়ে নিরাপদ স্থানে সরে যায়। অনেকে ভিডিও করতে ব্যস্ত হয়ে যায়। কিন্তু আহতদের দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবেÑ এই বোধ শুরুতেই সবার মধ্যে কাজ করা উচিত।
গুরুতর ৩০ জনের মধ্যে ১০ জনই আশঙ্কাজনক: বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ৪২ জনের মধ্যে ৩০ জনের অবস্থা বিপজ্জনক। এই ৩০ জনের মধ্যে অন্তত ১০ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার স্বাস্থ্যবিষয়ক বিশেষ সহকারী অধ্যাপক মো. সায়েদুর রহমান। গতকাল বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে এক জরুরি ব্রিফিংয়ে এই তথ্য জানান তিনি। এ সময় উপস্থিত ছিলেন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম।
অধ্যাপক মো. সায়েদুর রহমান বলেন, ‘আমাদের কাছে থাকা তথ্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত ২৯ জন মারা গেছে। তাদের মধ্যে ছয়জনের মরদেহ এখনো শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। চারটি পরিবার দাবি করেছে, মরদেহ তাদের। তবে চূড়ান্তভাবে ডিএনএ টেস্টের পরই হস্তান্তর করা হবে।’ হাসপাতালে দগ্ধ রোগীদের বিষয়ে মো. সায়েদুর রহমান বলেন, ‘জাতীয় বার্ন ইউনিটে বর্তমানে ৪২ জন ভর্তি আছে। তাদের মধ্যে ৩০ জন বিপজ্জনক অবস্থায় রয়েছে। ১০ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। অন্যদের মধ্যে ১০ জন শঙ্কামুক্ত এবং দুজনকে সাধারণ ওয়ার্ড থেকে কেবিনে স্থানান্তর করার প্রস্তুতি চলছে।’
স্বাস্থ্যসেবা আরও জোরদার করতে সরকারের পক্ষ থেকে আন্তর্জাতিক সহায়তা নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বলেও জানান উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম। তিনি বলেন, ‘সিঙ্গাপুর থেকে একটি বিশেষ মেডিকেল টিম আজই ঢাকায় পৌঁছবে। তাদের পরামর্শ অনুযায়ী পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। প্রয়োজনে আহত ব্যক্তিদের বিদেশে পাঠানোর ব্যবস্থাও করা হবে।’ এদিকে গুরুতর দগ্ধদের উন্নত চিকিৎসা দিতে গতকাল রাতেই সিঙ্গাপুরের চিকিৎসকদল ঢাকায় এসেছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে।
আপনার মতামত লিখুন :