ঢাকা শনিবার, ০২ আগস্ট, ২০২৫

অনুদানের সিনেমায় উরাধুরা ধান্দা

রুহুল আমিন ভূঁইয়া
প্রকাশিত: জুলাই ২৬, ২০২৫, ০১:৩৫ এএম
ছবি- রূপালী বাংলাদেশ গ্রাফিক্স

চলচ্চিত্রের প্রভাব বিশ্বব্যাপী, এর ইতিহাসও বেশ দীর্ঘ। সময়ের বাঁক বদলে কখনো কখনো দিকপালের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতেও দেখা গেছে চলচ্চিত্রকে। বাংলাদেশে চলচ্চিত্র নির্মাণের ইতিহাস প্রায় সত্তর বছরের।

প্রথম দিকে অধিকাংশ সিনেমা ব্যক্তি উদ্যোগে নির্মিত হলেও সময়ের সঙ্গে আত্মপ্রকাশ ঘটে পেশাদার প্রযোজনা সংস্থার; পরর্বতী সময়ে যুক্ত হয় রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ। ১৯৭৬ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে সরকারি অনুদানে নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্র ‘সূর্য দীঘল বাড়ী’। সেই থেকে শুরু। পরবর্তী সময়ে চলচ্চিত্র নির্মাণে দশকে দশকে বেড়েছে সরকারি অনুদানের পরিমাণ।

কিন্তু চলচ্চিত্র নির্মাণে রাষ্ট্রীয় অর্থকোষ থেকে এই যে বিপুল পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ হচ্ছে এর ফলাফল কী এবং দর্শকের প্রাপ্তি কতটা, সেই প্রশ্ন থেকে যায়। সত্তরের দশক থেকে আজ পর্যন্ত অসংখ্য চলচ্চিত্রের জন্য সরকারি অনুদান বরাদ্দ হলেও এর মধ্যে কতটি আলোর মুখ দেখেছে এই সংখ্যা নিয়ে আছে বিতর্ক; এই উদ্যোগ নিয়েও দেখা দিয়েছে সংশয়। কোনো কোনো চলচ্চিত্র শুধু লাইট-ক্যামেরা-অ্যাকশনের পর প্রথম টেক পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থেকেছে!

উল্লেখ্য, আশির দশকের শুরু থেকে রাজনৈতিক বাস্তবতায় দীর্ঘ সময় বন্ধ ছিল চলচ্চিত্র নির্মাণে সরকারি অনুদান। দীর্ঘ বিরতির পর ২০০৭-০৮ অর্থবছর থেকে আবার তা নিয়মিত হয়। দেশের প্রথম অনুদানপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র ‘সূর্য দীঘল বাড়ী’ দর্শককে যেভাবে আলোড়িত করেছে, পরবর্তী সময়ে অনুদানের অর্থে নির্মিত কোনো সিনেমা ‘সূর্য দীঘল বাড়ী’কে উতরে যেতে পারেনি। উপরন্তু, সাম্প্রতিক বছরগুলোয় চলচ্চিত্রে সরকারি অনুদান ঘিরে আছে নানা বিতর্ক। 

অনুসন্ধানে দেখা যায়, ১৯৭৬-৭৭ অর্থবছরে সরকারি অনুদান পাওয়া বেবী ইসলামের ‘মেহেরজান’ সিনেমাটি আজ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি। তেমনি, ১৯৮২-৮৩ অর্থবছরে অনুদান পাওয়া পাঁচটি সিনেমার মধ্যে ইসমাইল মোহাম্মদ পরিচালিত ‘ডাক দিয়ে যাই’, মাসুদ করিমের ‘ফুলমতি’, চিত্রনায়ক আশরাফ উদ্দিন আহমেদ উজ্জলের ‘উদয় তারা’ নামের সিনেমা তিনটিও মুক্তি পায়নি।

প্রথম দুই পরিচালকের মৃত্যুর পর সিনেমা দুটির নির্মাণকাজ বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু চিত্রনায়ক উজ্জল ১ লাখ টাকা অনুদান পেলেও সিনেমা জমা দেননি, এমনকি টাকাও ফেরত দেননি। এ প্রসঙ্গে চিত্রনায়ক উজ্জলের মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করলে তিনি সাড়া দেননি। পরে খুদেবার্তা পাঠালেও উত্তর মেলেনি।

এদিকে, ২০০৭-০৮ অর্থবছরে সরকারি অনুদান পাওয়া এনামুল করিম নির্ঝর পরিচালিত ‘নমুনা’ আজও মুক্তি পায়নি। জানা যায়, সিনেমাটির নির্মাণ তিনি শেষ করেছিলেন, কিন্তু সেনসর বোর্ডে জমা দেওয়ার পর তাকে ‘নমুনা’র গল্প পরিবর্তন করতে বলা হয়। কিন্তু নির্ঝর তা মেনে নেননি।

সম্প্রতি গণঅভ্যুত্থানে পট পরিবর্তনের পর সেনসর বোর্ডের আগের নাম বাতিল হয়েছে। নতুন নাম ‘বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন বোর্ড’। বর্তমান বাস্তবতায় ‘নমুনা’ নিয়ে কী ভাবছেন তিনিÑ এ বিষয়ে জানতে চাইলে এনামুল করিম নির্ঝর ব্যস্ততা দেখিয়ে বিষয়টি এড়িয়ে যান।

২০০৮-০৯ অর্থবছরে অনুদান পায় পরিচালক জুনায়েদ হালিমের ‘স্বপ্ন ও দুঃস্বপ্নের কাল’ সিনেমাটি। কিন্তু সিনেমাটি এখন পর্যন্ত নির্মাণ সম্পন্ন করেননি পরিচালক। ২০০৯-১০ অর্থবছরে সরকারি অনুদান পান নির্মাতা আকতারুজ্জামান। কিন্তু সিনেমা মুক্তির আগেই মৃত্যুবরণ করেন তিনি। ‘সূচনা রেখার দিকে’ নামের সিনেমাটি মুক্তির জন্য প্রস্তুত থাকলেও আজও অন্ধকারে রয়ে গেছে আকতারুজ্জামানের স্বপ্ন।

২০১০-১১ অর্থবছরের মির্জা সাখাওয়াৎ হোসেনের ‘ধোঁকা’, ফারুক হোসেনের ‘কাকতাড়ুয়া’ও মুক্তি পায়নি। ২০১১-১২ অর্থবছরে মারুফ হাসান আরমান ‘নেকড়ে অরণ্য’-এর জন্য ৩৫ লাখ টাকা সরকারি অনুদান পান। সিনেমা নির্মাণ না করায় তার বিরুদ্ধে মামলাও হয়েছে। কিন্তু সেটি আজও অমীমাংসিত।

২০১২-১৩ অর্থবছরে ‘কাঁটা’ সিনেমার জন্য অনুদান পান কবি ও নির্মাতা টোকন ঠাকুর। সময়মতো সিনেমাটি নির্মাণ করতে না পারায় মন্ত্রণালয়ের দায়ের করা মামলায় গ্রেপ্তারও হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু ‘কাঁটা’ আজও পর্দায় আসেনি।

একই অর্থবছরে অনুদান পাওয়া নির্মাতা তারেক মাসুদের ‘কাগজের ফুল’ চলচ্চিত্রের কাজ তার মৃত্যুর পর থেকেই আটকে আছে। সিনেমাটির লোকেশন দেখে ফেরার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান তারেক মাসুদ।

এরপর নির্মাতার স্ত্রী ক্যাথরিন মাসুদ বলেছিলেন, ‘এই সিনেমার কাজ তিনিই শেষ করবেন।’ এমন কথায় আশায় বুক বেঁধেছিলেন তারেক মাসুদের ভক্তরা। এভাবে এক যুগ পার হলেও এখনো সিনেমাটি বানানোর সময় বের করতে পারেননি ক্যাথরিন। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তারেক মাসুদের স্বপ্নের এই সিনেমা আর কখনো আলোর মুখ দেখবে না।

২০১৩-১৪ অর্থবছরে অনুদান পান অভিনেতা ড্যানি সিডাক। ‘কাঁসার থালায় রুপালি চাঁদ’ নামের সিনেমাটি তার প্রযোজনা ও পরিচালনায় নির্মাণের কথা ছিল। মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে যুদ্ধপরাধীদের পুনর্বাসন ও তাদের সামাজিক প্রতিষ্ঠার গল্পে এই সিনেমাও রয়ে গেছে অসম্পূর্ণ। এ প্রসঙ্গে জানতে যোগাযোগ করা হলে অভিনেতার বড় ভাই তার ফোন রিসিভ করেন। ফলে ড্যানি সিডাকের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলা যায়নি। 

২০১৫-১৬ অর্থবছরে অনুদান পাওয়া কামাল আহমেদ সাইমনের ‘শিকলবাহা’ এখনো মুক্তি পায়নি; সিনেমাটির নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে অনেক আগেই। সিনেমাটি ‘শঙ্খধ্বনি’ নামে অনুদান পেলেও পরে নাম পরিবর্তন করে ‘শিকলবাহা’ নামকরণ করা হয়। কবে মুক্তি পাবে জানতে এই নির্মাতাকে একাধিকবার ফোন করলেও সাড়া পাওয়া যায়নি।

২০১৮-১৯ অর্থবছরে অনুদান পাওয়া সারাহ বেগম কবরীর ‘এই তুমি সেই তুমি’, হোসেন মোবারক রুমীর ‘অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া’ মুক্তি পায়নি। এ ছাড়া শমী কায়সার পরিচালিত ‘স্বপ্ন মৃত্যু ভালোবাসা’র এখনো শুটিং শুরুই হয়নি বলে জানা গেছে। বর্তমানে শমী কায়সার হত্যা মামলায় কারাগারে রয়েছেন। তাই বলা যায় সিনেমাটির ভবিষ্যৎও অন্ধকারে।

‘এই তুমি সেই তুমি’ সিনেমাটি নিয়ে কবরীর ছিল নানা পরিকল্পনা। করোনার ভয়কে উপেক্ষা করে শুটিংয়ে অংশ নিয়েছিলেন তিনি। ছিল যথাসময়ে সিনেমাটি মুক্তি দেওয়ার তাড়া। শুটিংও প্রায় শেষ করে এনেছিলেন। আর মাত্র দুই দিনের দৃশ্য ধারণ বাকি ছিল।

কিন্তু তার আকস্মিক মৃত্যু থামিয়ে দেয় সবকিছু। কবরীর অসমাপ্ত সিনেমাটির কাজ শেষ করবেন তার ছেলে শাকের চিশতীÑ বেশ কয়েক দফা মায়ের শেষ সিনেমা শেষ করার কথা জানালেও শুরু হয়নি বাকি দৃশ্য ধারণ। প্রয়াণের দুই মাস আগে শেষবারের মতো শুটিং করেছিলেন কবরী। তিনি নেই, থেমে আছে তার শেষ সিনেমার কাজ। সিনেমাটির কাজ এগোবে, নাকি অসমাপ্তই থেকে যাবে এমন নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। এ প্রসঙ্গে জানতে কবরীর ছেলে শাকের চিশতীর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।

২০১৯-২০ অর্থবছরে ১৬টি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র অনুদান পায়। তার মধ্যে এস এ হক অলিকের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ‘যোদ্ধা’ সিনেমার কাজ শুরুই হয়নি। ফজলুল কবীর তুহিনের প্রযোজনা ও পরিচালনায় ‘গাঙকুমারী’, ইফতেখার আলমের প্রযোজনা ও পরিচালনায় ‘লেখক’, আবদুল মমিন খানের প্রযোজনা ও ফজলুল কবীর তুহিনের পরিচালনায় ‘বিলডাকিনি’ মুক্তি পায়নি। ‘বিলডাকিনি’ সিনেমায় অনুদানের তালিকায় মনজুরুল ইসলাম মেঘের নাম থাকলেও পরে পরিচালক পরিবর্তন করা হয়, যা নানা বিতর্কের জন্ম দেয়। একই অর্থবছরে অনম বিশ্বাসের প্রযোজনা ও পরিচালনায় ‘ফুটবল ৭১’ সিনেমাটি এখনো মুক্তি পায়নি।

গণঅভ্যুত্থানের মুখে হাসিনা সরকারের পতনের পর আমেরিকা পাড়ি জমিয়েছেন ‘যোদ্ধা’ সিনেমার নির্মাতা এস এ হক অলিক। ছাত্র-জনতার বিপক্ষে অবস্থান নেওয়ায় তার নামে মামলা হয়েছে বলে জানা গেছে। শিগগিরই তিনি দেশে ফিরছেন না। ফলে অনেকটাই অনিশ্চিত এই সিনেমার ভবিষ্যৎ।

২০২০-২০২১ অর্থবছরে মোট ২০টি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র অনুদান পায়। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক শাখায় ৬০ লাখ টাকা অনুদান পায় জেড এইচ মিন্টু পরিচালিত ‘ক্ষমা নেই’, নঈম ইমতিয়াজ নেয়ামুলের ‘সাড়ে তিন হাত ভূমি’ ও উজ্জ¦ল কুমার ম-লের ‘মৃত্যুঞ্জয়ী’। সাধারণ শাখায় অনুদান পাওয়া অনিরুদ্ধ রাসেল পরিচালিত ‘জামদানি’, জাহিদুর রহিম অঞ্জন পরিচালিত ‘চাঁদের অমাবস্যা’, রকিবুল হাসান চৌধুরী (পিকলু) পরিচালিত ‘দাওয়াল’ এবং কবিরুল ইসলাম রানা (অপূর্ব রানা) পরিচালিত ‘জলরঙ’ নামের সিনেমাগুলো আজও আলোর মুখ দেখেনি। জানা গেছে, নিয়ম থাকলেও প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায়নি ‘জলরঙ’। যদিও সিনেমাটি গত ঈদে একটি বেসরকারি টেলিভিশনে প্রিমিয়ার হয়েছে।

বলা প্রয়োজন, ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশন (বিএফডিসি) দুটি সিনেমার জন্য সরকারি অনুদান পায়। সিনেমা দুটি হলো ‘আকাশ যুদ্ধ’ (মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক) ও ‘চাদর’। ‘আকাশ যুদ্ধ’ সিনেমাটি পরিচালনায় ছিলেন ‘ঢাকা অ্যাটাক’ খ্যাত পরিচালক দীপংকর দীপন আর ‘চাদর’ সিনেমাটি খ্যাতিমান নির্মাতা জাকির হোসেন রাজুর। রাজুর সিনেমাটির নির্মাণকাজ শেষ হলেও খবর নেই দীপনের সিনেমার। কবে মুক্তি পাবে, তা-ও জানা যায়নি।

অনিরুদ্ধ রাসেলের ‘জামদানি’ সিনেমাটি ২০২২ সালের ডিসেম্বরে মুক্তির কথা থাকলেও এখনো আলোর মুখ দেখেনি। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সিনেমাটির নির্মাতা রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘সিনেমাটি মুক্তির জন্য প্রস্তুত আছে। আমরা মুক্তির পরিকল্পনা করছি। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে চূড়ান্ত তারিখ জানাতে পারব।’ 

২০২১-২২ অর্থবছরে পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র বিভাগে ১৯ জনকে ১২ কোটি ১৫ লাখ টাকা অনুদান দেওয়া হয়। অনুদান পাওয়া মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সিনেমা হচ্ছে ‘জয় বাংলার ধ্বনি’, প্রযোজক ও পরিচালক খোরশেদুল আলম খন্দকার (খ ম খুরশীদ), ‘একাত্তর-করতলে ছিন্নমাথা’, প্রযোজক ও পরিচালক রফিকুল আনোয়ার (রাসেল)। এ ছাড়া সাধারণ শাখায় অনুদান পায় ‘যুদ্ধজীবন’ (প্রযোজক ও পরিচালক রিফাত মোস্তফা) ‘যাপিত জীবন’ (প্রযোজক ও পরিচালক হাবিবুল ইসলাম হাবিব), ‘বনলতা সেন’ (প্রযোজক ও পরিচালক মাসুদ হাসান উজ্জ্বল), ‘অতঃপর রোকেয়া’ (প্রযোজক ও পরিচালক শামীম আখতার), ‘১৯৬৯’ (প্রযোজক মাহজাবিন রেজা চৌধুরী, পরিচালক অমিতাভ রেজা চৌধুরী), ‘বঙ্গবন্ধুর রেণু’ (প্রযোজক ও পরিচালক মারুফা আক্তার পপি), ‘ডোডোর গল্প’ (প্রযোজক নাজমুল হক ভূঁইয়া, পরিচালক রেজা ঘটক), ‘বকুল কথা’ (প্রযোজক সঞ্জিত কুমার সরকার, পরিচালক মাসুদ মহিউদ্দিন ও মাহমুদুল হাসান শিকদার), ‘আর্জি’ (প্রযোজক ও পরিচালক কামাল মোহাম্মদ কিবরিয়া), ‘এইতো জীবন’ (প্রযোজক ও পরিচালক সৈয়দ আলী হায়দার রিজভী), ‘অন্তরখোলা’ (প্রযোজক সারা যাকের, পরিচালক রতন কুমার পাল), ‘ভাষার জন্য মমতাজ’ (প্রযোজক ও পরিচালক সরোয়ার তমিজ উদ্দিন), ‘মায়া’ (প্রযোজক শাকিব খান, পরিচালক হিমেল আশরাফ), ‘মুক্তির ছোট গল্প’ (প্রযোজক দৌলত হোসাইন, পরিচালক মাসউদ যাকারিয়া চৌধুরী ও আব্দুস সামাদ খোকন)। এসব সিনেমার মধ্যে দু-একটির নির্মাণকাজ শেষ হলেও অধিকাংশের এখনো শুটিংই শুরু হয়নি বলে জানা গেছে।

সম্প্রতি দৈনিক রূপালী বাংলাদেশে খবর প্রকাশের পর অনুদানের টাকা ফেরত দিয়েছেন শাকিব খান। ‘ডোডোর গল্প’ সিনেমার প্রযোজক নাজমুল হক ভূঁইয়া রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘আমরা যথাসময়ে সিনেমাটির নির্মাণকাজ শেষ করেছি। মুক্তির প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছি। ভালো একটা সময় দেখে সিনেমাটি মুক্তি দেব।’

অনেক আগেই ‘যাপিত জীবন’ সিনেমার কাজ শেষ হয়েছে জানিয়ে প্রযোজক ও পরিচালক হাবিবুল ইসলাম হাবিব রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘পট পরিবর্তনের পর সিনেমাটি আনকাট সেনসর হয়েছে। এখন অস্থির সময় চলছে, আমরা স্থির সময়ে সিনেমাটি মুক্তি দিতে চাই। সবকিছু ঠিক থাকলে চলতি বছরই সিনেমাটি মুক্তি পাবে।’

২০২২-২৩ অর্থবছরে ২৩টি পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমা অনুদান পায়। সাধারণ শাখায় ‘দেনা পাওনা’ (প্রযোজক ও পরিচালক সাদেক সিদ্দিকী), ‘সার্কাস’ (প্রযোজক ও পরিচালক নূর ইমরান মিঠু), ‘লাল মিয়া’ (প্রযোজক মাতিয়া বানু শুকু ও পরিচালক নূরুল আলম আতিক), ‘মাস্টার’ (প্রযোজক ও পরিচালক রেজওয়ান শাহরিয়ার সুমিত), ‘দি আগস্ট’ (প্রযোজক ও পরিচালক মাসুদ পথিক), ‘রেণুর মুক্তিযুদ্ধ’ (প্রযোজক ও পরিচালক রোকেয়া প্রাচী), ‘লারা’ (প্রযোজক জ্যোতিকা পাল জ্যোতি, পরিচালক শেখর দাশ), ‘দুই পয়সার মানুষ’ (প্রযোজক ও পরিচালক ঝুমুর আসমা জুঁই)।

‘সর্দার বাড়ির খেলা’ {প্রযোজক মীর জাহিদুল হাসান (মীর জাহিদ হাসান) ও পরিচালক সাজীব আহমেদ (রাখাল সবুজ)}, ‘ঠিকানা’ (প্রযোজক ও পরিচালক আনোয়ার হোসেন পিন্টু), ‘জীবন আমার বোন’ (প্রযোজক মোহাম্মদ জাহিদুল করিম ও পরিচালক এনায়েত করিম বাবুল), ‘সূর্য সন্তান’ (প্রযোজক সৈয়দ আশিক রহমান ও প্রযোজক কৌশিক শংকর দাস), ‘শিরোনাম’ (প্রযোজক কাজী রুাবায়াৎ হায়াৎ ও পরিচালক এস এম তারেক রহমান), ‘নীল আকাশে পাখি ওড়ে’ (প্রযোজক ও পরিচালক এস ডি রুবেল), ‘গ্রহণের কাল’ (প্রযোজক কাজী সাইফুল ইসলাম ও পরিচালক ফুয়াদ চৌধুরী), ‘নীল জোসনার জীবন’ (প্রযোজক ও পরিচালক ফাখরুল আরেফিন খান), ‘রুখসার’ (প্রযোজক ও পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান মানিক), ‘শাপলা শালুক’ (প্রযোজক ও পরিচালক রাশেদা আক্তার লাজুক) এবং ‘আমার মুক্তি আলোয় আলোয়’ (প্রযোজক ইয়াসির আরাফাত ও পরিচালক জহির রায়হান)।

‘শাপলা শালুক’ সিনেমাটির নির্মাণকাজ সম্প্রতি শেষ হয়েছে। বর্তমানে সম্পাদনার টেবিলে রয়েছে। চলতি বছরই সিনেমাটি মুক্তি দিতে চান পরিচালক লাজুক। এস ডি রুবেলের সিনেমাটির দুই দিন এবং মোস্তাফিজুর রহমান মানিকের ‘রুখসার’ সিনেমার অর্ধেক শুটিং হলেও বাকিগুলোর খবরই নেই। কবে নাগাদ শুটিং শুরু হবে, তা জানা যায়নি।

‘লারা’ সিনেমার জন্য প্রযোজক হিসেবে ৬০ লাখ টাকা সরকারি অনুদান পেয়েছিলেন অভিনেত্রী জ্যোতিকা জ্যোতি। সিনেমাটির খবর জানতে চাইলে আক্ষেপ করে তিনি রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা দায়িত্ব নেওয়ার পর তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে আমাকে ফোন করে জানানো হয় আবারও সিনেমাটির স্ক্রিপ্ট জমা দিতে। তিনটি পর্যায়ে প্রাথমিক ও চূড়ান্ত বাছাইয়ে অনুদান পেয়ে প্রথম কিস্তির টাকাও পেয়েছি। শুটিংয়ের পরিকল্পনাও শেষ। তবু নতুন করে স্ক্রিপ্ট জমা দিতে হয়েছে। আট মাস আগে জমা দিয়েছি কিন্তু আজও খবর নেই। সিনেমাটির নির্মাণকাজ শুরু করব নাকি বাতিল হবেÑ কিছুই জানানো হচ্ছে না। তাদের মন্তব্যের অপেক্ষায় রয়েছি।’

১৯৭৬-৭৭ অর্থবছর থেকে দেশীয় চলচ্চিত্রে সরকারি অনুদানের প্রথা চালু হয়। এরপর বিভিন্ন অর্থবছরে অনুদান স্থগিত হয়ে গেলেও একেবারে থেমে থাকেনি এই প্রক্রিয়া। ২০০৭-০৮ অর্থবছর থেকে এখন পর্যন্ত নিয়মিতভাবেই চলচ্চিত্রে অনুদান প্রদান করা হচ্ছে। কিন্তু অনুদানের অসংখ্য সিনেমা এখনো অন্ধকারে। যেগুলোর ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। এ প্রসঙ্গে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের সচিব মাহবুবা ফারজানার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে গুরুত্বপূর্ণ মিটিংয়ে ব্যস্ত আছেন বলে জানান। পরে মেসেজ দেওয়া হলেও তিনি কোনো সাড়া দেননি।

সময়ের সঙ্গে বেড়েছে সরকারি অনুদানের অর্থের পরিমাণ ও সিনেমার সংখ্যা। তবে টাকা কিংবা সিনেমার সংখ্যা বাড়লেও শুরু থেকে এ পর্যন্ত এই উদ্যোগের পিছু ছাড়েনি সমালোচনা। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, কয়টি সিনেমাকে কত টাকা করে অনুদান দিতে পারলÑ এটিকে যতটা গুরুত্ব দেওয়া হয়, বছর শেষে অনুদানপ্রাপ্ত কোন কোন সিনেমা নির্মিত হলো, সেটির হয় না তদারকি। এ ছাড়া নীতিমালা ভঙ্গ করে তদবিরের মাধ্যমে সিনেমা অনুদান পাওয়ার অভিযোগ তো রয়েছেই। 

কিন্তু এসব অভিযোগ চলতি অর্থবছরে সবকিছু ছাপিয়ে তৈরি হয়েছে মহাবিতর্ক। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ১৩ কোটি টাকা সরকারি অনুদান পাচ্ছে ৩২ চলচ্চিত্র। অনুদানের প্রজ্ঞাপন প্রকাশ্যে আসতেই তৈরি হয় বিতর্ক, যা বিগত দিনের সব বিতর্ককে উতরে গেছে। এবারই প্রথমবারের মতো তালিকায় ছিল না কোনো পরিচালকের নাম। এ ছাড়া যেসব নির্মাতা অনুদান পেয়েছেন, তাদের নিয়েও রয়েছে নানা প্রশ্ন।

বছরের পর বছর অনুদানের সিনেমা মুক্তি না পাওয়া এবং চলচ্চিত্র উন্নয়নে অনুদান ভূমিকা রাখে কি নাÑ এ নিয়ে সংস্কৃতি উপদেষ্টা ও নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর অভিমত জানতে যোগাযোগ করা হলে তাকে পাওয়া যায়নি। এ বিষয়ে খুদেবার্তা পাঠালে উত্তরে তিনি রূপালী বাংলাদেশকে জানান, ‘দয়া করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সাথে কথা বলুন। আমার বিশ্বাস, আপনি জানেন যে এটা আমার মন্ত্রণালয় নয়।’

নীতিমালা অনুযায়ী অনুদানপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র প্রথম চেক প্রাপ্তির ৯ মাসের মধ্যে নির্মাণকাজ শেষ করতে হবে। তবে বিশেষ অবস্থায় অনুরোধ সাপেক্ষে পরিচালক ওই সময় বাড়াতে পারবেন। আর এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে অনেক নির্মাতা সিনেমা নির্মাণে বছরের পর বছর পার করছেন। অনুদান প্রক্রিয়া নিয়ে রয়েছে এমন নানা অস্বচ্ছতার গল্প। অনুদানের সিনেমা নীরবেই নামেমাত্র দু-চারটি হলে মুক্তি পাচ্ছে। এসব সিনেমা দর্শকদের আগ্রহও জাগাতে পারেনি। এসব দেখার যেন কেউ নেই। এখানে অনিয়মই যেন অলিখিত নিয়ম।

১৯৭৬ সাল থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত ৬৫টি অনুদানের সিনেমা আলোর মুখ দেখেনি, যার মধ্যে অনেক সিনেমার নির্মাণকাজ এখনো শুরুই হয়নি। হবে কি না, তা নিয়েও রয়েছে সংশয়। অর্ধেকের বেশি সিনেমার ভবিষ্যৎ এখনো অন্ধকারে। অভিযোগ, এভাবেই বছরের পর বছর সরকারি টাকা নিয়ে নয়-ছয় হচ্ছে। গত ১৫ বছরে অনুদানের সিনেমার সংখ্যা ও অর্থ যেমন বেড়েছে, তেমনি অনিয়ম আর সিনেমা আটকে রেখে টাকা খরচ করার অভিযোগও বিস্তর। তবু এ বিষয়ে অনেকটাই নীরব সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়। 

চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টদের মতে, অনুদান কমিটির অস্বচ্ছতার কারণেই যোগ্য লোকের কাছে পৌঁছায় না অনুদানের টাকা। অথচ অনুদানের সিনেমাই আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে আনতে পারে পুরস্কার। এর প্রমাণ সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত প্রথম চলচ্চিত্র ‘সূর্য দীঘল বাড়ী’।গত শিল্পী সমিতির নির্বাচনের আগে এই প্রতিবেদকের প্রশ্নের জবাবে অভিনেতা, প্রযোজক ও নির্মাতা মনোয়ার হোসেন ডিপজল বলেছিলেন, ‘অনুদানের সিনেমা বন্ধ করে দেওয়াই ভালো। কারণ, অনুদানের টাকা দিয়ে ভালো সিনেমা নির্মাণ হয় না। বরং সরকারি টাকা নষ্ট হয়। তবে দু-একটা ভালো হলেও বেশির ভাগ সিনেমা মানহীন।’
এই প্রশ্নে পরিচালক দেলোয়ার জাহান ঝন্টু রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘অদক্ষ নির্মাতার হাতে যাচ্ছে সরকারের টাকা, যা সিনেমা শিল্পে উন্নয়নে ভূমিকা রাখে না।’ একই কথা বলেন বরেণ্য নির্মাতা ছটকু আহমেদও।

প্রযোজক ও পরিচালক মো. ইকবাল বলেন, ‘পৃথিবীর কোনো দেশে সরকারি অনুদানে চলচ্চিত্র নির্মাণ হয় না। কিন্তু আমাদের দেশে অনুদান দিয়ে সরকারি টাকা নষ্ট করা হয়। অনুদানের সিনেমা কেউ দেখে না। অনুদানের টাকার থাকে না হিসাব। নামে মাত্র সিনেমা নির্মাণ করে অর্ধেকের বেশি টাকা মেরে দেওয়া হয়। অনুদানের সিনেমার পুরো প্রক্রিয়াই দুর্নীতি। এ কারণে অনুদানের সিনেমা বন্ধ করে দেওয়া উচিত। অনুদান সিনেমার জন্য ক্ষতিকর। আগে সিনেমা হল ধ্বংস হয়েছে, এখন প্রযোজকেরা হচ্ছেন। শৌখিন প্রযোজক আর মেধাহীন পরিচালকদের দৌরাত্ম্যে ঢাকার সিনেমা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন দর্শক।’

বাংলা সিনেমার আগের সেই সুদিন নেই। হলবিমুখ দর্শককে হলমুখী করতে অনুদান নয়, সিনেমা হল সংস্কার করার কথা বলছেন চলচ্চিত্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। এ ছাড়া অনুদান যদি দিতেই হয়, তবে সেটা দেওয়া উচিত বাণিজ্যিক সিনেমার নির্মাতাদেরÑ এমনটাই ভাষ্য সবার। 

অনুদানের সিনেমা নিয়ে প্রচলিত রয়েছে নানা অস্পষ্টতার গল্প। অনুদানের সিনেমা প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পাওয়া সুখরকরও হয় না। নানা কাঠখড় পেরিয়ে অনুদানের সিনেমা মুক্তি পেলেও অধিকাংশ সিনেমা পায়নি দর্শকপ্রিয়তা। এ ছাড়া লোকসানের ভয়ে অনুদানের সিনেমার প্রতি প্রেক্ষাগৃহ মালিকেরা দেখান না ন্যূনতম আগ্রহ।

সরকারি অনুদান পাওয়ার দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও ৬৫টি সিনেমা আজও আলোর মুখ দেখেনি। এসব সিনেমা কবে আলোর মুখ দেখবে, জানে না কেউই। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, বিতর্কিত এক উদ্যোগের নাম অনুদানের সিনেমা। অথচ সরকারি অনুদানেই নির্মিত হতে পারত ‘সূর্ঘ দীঘল বাড়ি’র মতো কালজয়ী সিনেমা।