ঢাকা বৃহস্পতিবার, ৩১ জুলাই, ২০২৫

তিন দলের দ্বন্দ্বে মাথাচাড়ার চেষ্টায় আওয়ামী লীগ

মেহেদী হাসান খাজা
প্রকাশিত: জুলাই ৩০, ২০২৫, ০৭:৩১ এএম
বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপি। ছবি- সংগৃহীত

সম্ভাব্য জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশের বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ ও জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ (এনসিপি) ছোট দলগুলোর মধ্যে বর্তমানে বিভিন্ন বিষয়ে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব দৃশ্যমান। দিন যতই যাচ্ছে এ দ্বন্দ্ব ক্রমশ সামনে আসছে।

জুলাই অভ্যুত্থান-পরবর্তী পরিস্থিতি আশার আলো দেখালেও বর্তমানে নির্বাচন ঘিরে দলগুলোর অন্তঃকোন্দলের সুযোগ কাজে লাগিয়ে দেশে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ ফের মাথাচাড়া দেওয়ার চেষ্টা করছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের পতনের পর রাজনীতির মাঠে নতুন পরিস্থিতি তৈরি হয়। ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে থাকা দলগুলো এখন পারস্পরিক দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছে। এই দ্বন্দ্বে একদিকে আছে বিএনপি; আরেক দিকে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)।

সাম্প্রতিক সময়ে নানা ইস্যুকে কেন্দ্র করে এই দুই শিবিরের মধ্যে স্লোগান ও কথার যুদ্ধ যেমন চলছে, পাশাপাশি বক্তৃতা-বিবৃতিতে পরস্পরের সমালোচনায়ও তারা সোচ্চার। এসব স্লোগান-বক্তৃতা কখনো কখনো রাজনৈতিক শালীনতা বা শিষ্টাচারেরও সীমা অতিক্রম করছে।  রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, আগামী জাতীয় নির্বাচন ও ক্ষমতার রাজনীতিকে কেন্দ্র করে এই কাদা ছোড়াছুড়ির সুযোগ কাজে লাগাতে চাইছে আওয়ামী লীগ। 

সাম্প্রতিক সময়ে দেশে অরাজকতার নেপথ্যেও কাজ করছে দলটি। এ ছাড়া বিভিন্ন ধরনের বিশৃঙ্খলা ও কৌশলে মাঠে নেমেছে পতিত আওয়ামী লীগ। বিদ্যমান মতবিরোধের ফলে দলটি আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠার চেষ্টা করছে। 
গত ১৬ জুলাই জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) পদযাত্রা ও সমাবেশ কর্মসূচি ঘিরে গোপালগঞ্জে শহরে হামলা-সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় পাঁচজন নিহত হন। এ সহিংসতার ঘটনায় এক যৌথ বিবৃতির মাধ্যমে ২০ জুলাই রোববার সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ‘সর্বাত্মক’ হরতালের ডাক দেয় কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের চার সংগঠন যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, জাতীয় শ্রমিক লীগ ও নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ। আওয়ামী লীগ ও সংগঠনগুলোর নিজেদের ফেসবুক পেইজে বিবৃতিটি প্রকাশের পাশাপাশি সংবাদমাধ্যমেও তা পাঠানো হয়।

এরও আগে চলতি বছরের ১৬ ও ১৯ ফেব্রুয়ারি যথাক্রমে অবরোধ ও হরতাল ডাকলেও কার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকা দলটির ও সহযোগী সংগঠনের কাউকে প্রকাশ্যে দেখা যায়নি। এদিকে পুলিশ সদর দপ্তরের একটি সূত্র জানায়, গত কয়েক দিনে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীসহ নানা ধরনের অপকর্ম করার অপরাধে সারা দেশ থেকে প্রায় ৫ হাজারের বেশি দুষ্কৃতকারী গ্রেপ্তার হয়। 

দেশের রাজনৈতিক মাঠ থেকে হারিয়ে গেলেও সম্প্রতি গোপালগঞ্জের সহিংসতা ও হরতাল আহ্বানের মাধ্যমে ফের আলোচনায় আসে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম। শেখ হাসিনার পতনের পর থেকেই সাংগঠনিকভাবে বিপর্যস্ত দলটি। প্রকাশ্যে নেই নেতাকর্মীরা, দলীয়ভাবে সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি বা নির্দেশনাও নেই তৃণমূলেও। এ অবস্থায় সভানেত্রী শেখ হাসিনা ভারত পলায়নের পর গত বছরের ১২ আগস্ট প্রথমবারের মতো ফোনালাপের মাধ্যমে নেতাকর্মীদের সামনে আসেন। সে সময় একটি জেলার আওয়ামী লীগ নেতার সঙ্গে তার কথোপকথন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এরপর মাসখানেক ধরে শেখ হাসিনা কথা বলেন বিভিন্ন এলাকার তৃণমূলের নেতাদের সঙ্গে। এসব ফোনালাপও প্রকাশ পায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। পরবর্তী সময়ে শেখ হাসিনা কথা বলেন দলীয় ফোরামে।

সর্বশেষ গত কয়েক মাস ধরে মাঝেমধ্যেই দেশ ও বিদেশে অবস্থানরত নেতাকর্মীদের সঙ্গে হাসিনার ভার্চুয়াল বৈঠক অনুষ্ঠিত হচ্ছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে। এসব বৈঠকের উদ্দেশ্য দলকে সাংগঠনিকভাবে সক্রিয় করা। কিন্তু দেশের ভেতরে যেখানে দলের কোনো নেতাকে প্রকাশ্যে দেখা যাচ্ছে না, সেখানে দল কীভাবে সংগঠিত হবে সেটা নিয়ে বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠছে।

এ বিষয়ে রাজনীতি বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জোবাইদা নাসরীন বলেন, গণঅভ্যুত্থানে পতন হওয়ার পর আওয়ামী লীগ দল হিসেবে জনগণের মুখোমুখি কীভাবে হবে সেটা হচ্ছে দলটির জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। মানে কী কৌশল নিয়ে দাঁড়াবে, কী বার্তা নিয়ে নিয়ে দাঁড়াবে, কী উদ্দেশ্য নিয়ে দাঁড়াবে এবং কী কর্মসূচি নিয়ে দাঁড়াবে। আবার জনগণের সামনে এলেও জনগণ তাদের বার্তাকে কীভাবে নেবে, এগুলো এখনো অনিশ্চিত। এ ছাড়া তৃণমূলে যে দুর্বল অবস্থা, সেখানে দলকে চাঙা করাও বিরাট চ্যালেঞ্জ।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকা দক্ষিণ আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক কমিটির এক সদস্য বলেন, এখন তো আওয়ামীগ নেই, তাহলে দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ও জামায়াতে ইসলামীর মধ্যে নানা সময়ে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব দেখা যাচ্ছে কোনো। সবাই স্বার্থ নিয়ে চলছে এটা কিন্তু জনগণ বুঝে গেছে। স্বার্থ ফরিয়ে গেলে সব কিছু পরিষ্কার। আশা করি, দল ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। এর কারণে হলো, গোপালগঞ্জের ঘটনায় দেশবাসী দেখেছে কীভাবে আওয়ামী লীগ নেতাদের গুলি থেকে শুরু করে সব ধরনের নিযার্তন করা হয়েছে।  দিন দিন আওয়ামী লীগ রাজনৈতিকভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করবে এটা স্বাভাবিক, তবে ৫ আগস্টের পর যে পরিমাণ সময় লাগার কথা ছিল সেই পরিমাণে সময় হয়তো লাগবে না। দল রাজনৈতিক মাঠে ঘুরবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। অনেকেই ভেবেছিল ২০ বছরেও আওয়ামী লীগ ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না। কিন্তু বছর ঘুরতেই আওয়ামী লীগ মানুষের সামনে আসতে শুরু করেছে। 

ঘুরে দাঁড়ানোর আশায় ভারতের দিকে তাকিয়ে আছে আ. লীগ কর্মী-সমর্থকরা: বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের নিবন্ধন বাতিল বা নিষিদ্ধ করার দাবি যখন জোরালো হচ্ছে, সেই সময় সারা দেশে প্রবল চাপের মুখে থাকা দলটির তৃণমূল নেতাকর্মীদের অনেকে ভারত কী ভূমিকা নিচ্ছে সেই অপেক্ষায় আছেন। অনেকের বিশ্বাস এবং প্রত্যাশা, ভারত কিছু একটা ভূমিকা রাখবে, যার মাধ্যমে আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের রাজনীতিতে ঘুরে দাঁড়াবে এবং পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে। দেশে ও দেশের বাইরে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্তরের কর্মী-সমর্থকেরা প্রত্যাশা করছেন, বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের সঙ্গে ভারত যে ভূমিকা নিয়েছে, এরপর তারা একটি চাপ সৃষ্টি করতে পারে। নাম-পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগের একাধিক রাজনৈতিক নেতাকর্মীর ধারণাÑ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ওপর হামলা-মামলা, বিশেষ করে সনাতন বা হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর-মন্দিরে যেসব হামলা হয়েছে, সেটি ভারত ভালো চোখে দেখছে না এবং ভারত তাদের স্বার্থেই এ পরিস্থিতিতে কিছু একটা উদ্যোগ নেবে বলে আভাস পেয়েছেন।  সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকদের বোঝাপড়ার সারমর্ম হলো, ভারতের একটা ভূমিকা থাকবে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রাশেদা রওনক খান বলেন, রাজনীতিতে ফেরার ক্ষেত্রে ভারতের সাহায্যের বিষয়টি আওয়ামী লীগ পুরোদমে বিশ্বাস করে। একদম যদি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বা বিভিন্ন টক শো বা আলোচনায় আমরা দেখতে পাই যে তারা আশা করছে, ভারত আবার তাদের সহায়ক শক্তি হিসেবে সাহায্য করবে ফিরে আসার ক্ষেত্রে। এটা তো আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বক্তব্যে খুব স্পষ্ট।’

আওয়ামী লীগের নেতাদের দাবি, বাংলাদেশে রাজনীতিতে ঘুরে দাঁড়ানোর সঙ্গে ভারতনির্ভরতার কোনো সম্পর্ক নেই। দলটির য্গ্মু সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম অবশ্য স্বীকার করেনÑ যে বৃহৎ গণতান্ত্রিক এবং প্রতিবেশী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ প্রশ্নে ভারত কী অবস্থান নেবে সেটার গরুত্ব রয়েছে। তার ভাষায়Ñ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক, সাংগঠনিক ও আদর্শিক কার্যক্রম বন্ধ করা সহজ নয়।  

এদিকে নিজেদের মধ্যে নানা বিষয়ে অনৈক্য থাকলেও আওয়ামী লীগের ফিরে আসা কিংবা ফ্যাসিস্ট শক্তির বিরোধিতার বিষয়ে এককাট্টা দেশের বিদ্যমান দলগুলো। 

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, ‘আওয়ামী লীগ গণহত্যাকারী দল, তাদের জন্য মায়াকান্না করে কোনো লাভ নেই। আওয়ামী লীগ আর রাজনীতিতে ফিরতে পারবে না। ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনে পতনের সময় শেখ হাসিনা পালাতে পর্যন্ত সময় পাননি। যারা জনরোষ থেকে বাঁচতে পালিয়ে বেড়ায়, তাদের ভবিষ্যৎ বলে রাজনীতিতে আর ফেরার কোনো সুযোগ নেই।’

এ বিষয়ে জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেন, ‘রাজনীতিতে ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগের ফেরার নিশ্চয়তা নেই। সাধারণ মানুষ তাদের আর কখনোই গ্রহণ করবে না। আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের দাবিতে জনতাসহ ফ্যাসিবাদবিরোধী সব শক্তি একাত্ম।  

জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের হাতে বিএনপি নির্যাতিত হয়েছে, জামায়াত নির্যাতিত হয়েছে। এই ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে আমাদের জাতীয় ঐক্য গড়ে উঠছে। তা ছাড়া আওয়ামী লীগের আর রাজনীতি করার কোনো সুযোগ নেই। দেশের মানুষ এদের আর চায় না।

জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম বলেন, আওয়ামী লীগের বাংলাদেশে ফিরে আসার সুযোগ নেই, খুনি হাসিনার ফিরে আসার সুযোগ নেই। এলে একটা কারণে আসবে, সেটা বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়ানোর জন্য। বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগের প্রশ্নে সবাই ঐক্যবদ্ধ।

এসব বিষয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, আওয়ামী লীগের পক্ষে আপাতত রাজনীতিতে ফিরে আসা সম্ভব নয়। আওয়ামী লীগের কোনোভাবেই আসার সুযোগ নেই। তারা ফ্যাসিবাদী জনগণ তাদের প্রত্যাখ্যান করেছে, কাজেই এসব চিন্তা করে লাভ নেই।’