দীর্ঘ ২৩ দিনের রাজনৈতিক সংলাপ শেষে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন রাষ্ট্রকাঠামো সংস্কার ইস্যুতে ৩০টি দল ও জোটের সঙ্গে ১৯টি বিষয়ে আলোচনা সম্পন্ন করেছে। এর মধ্যে আটটি বিষয়ে পূর্ণ রাজনৈতিক ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হলেও বাকি ১১টি বিষয়ে বিভিন্ন দল বিশেষ করে বিএনপি, সিপিবি, বাসদ, এনসিপি, জাসদ ও কয়েকটি ইসলামপন্থি দলের পক্ষ থেকে নোট অব ডিসেন্ট বা লিখিত আপত্তি জানানো হয়েছে।
এই সংলাপের মাধ্যমে যে সিদ্ধান্ত ও প্রস্তাব তৈরি হয়েছে, সেটিকে ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’ নামে অভিহিত করে চলতি মাসের প্রথমার্ধেই জাতির সামনে উপস্থাপন করবে কমিশন।
গত ২ জুন রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস সংলাপের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। ৩ জুন থেকে ৩১ জুলাই পর্যন্ত ২৩ কর্মদিবসে বিভিন্ন দল ও জোটের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সরাসরি আলোচনায় বসে কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রিয়াজের নেতৃত্বে গঠিত টেকনিক্যাল কমিটি।
সূত্র জানায়, আলোচনায় প্রতিটি বিষয়েই আগে প্রস্তুত করা প্রস্তাব পেশ করা হয়, যা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর পর্যবেক্ষণ, সংশোধন ও ভিন্নমত বিবেচনায় নেওয়া হয়। সবশেষে প্রস্তাবিত ১৯টি পয়েন্ট নিয়ে কমিশন একটি খসড়া সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
রাষ্ট্রকাঠামো সংস্কারে ‘জাতীয় ঐকমত্য কমিশন’-এর সংলাপ বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি বিরল প্রয়াস হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। তবে এই সনদের ভিত্তিতে বাস্তব সংস্কার কতটুকু সম্ভব হবে, তা নির্ভর করবে আগামীতে রাজনৈতিক সমঝোতা ও নির্বাচনি রূপরেখার ওপর।
যেসব বিষয়ে ঐকমত্য: কমিশন সূত্রে জানা গেছে, আলোচনায় যেসব বিষয়ে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত এসেছে, সেগুলো হলো সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতিত্বে বিরোধীদলীয় নেতৃত্ব; নির্বাচনি সীমানা নির্ধারণে স্বাধীন কমিশনের ক্ষমতা বৃদ্ধি; রাষ্ট্রপতির ক্ষমা প্রদানের ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা; জরুরি অবস্থা ঘোষণার কাঠামোগত সংস্কার; সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট আইন প্রণয়ন; প্রধানমন্ত্রী হওয়ার মেয়াদ সর্বোচ্চ দুই মেয়াদে সীমাবদ্ধ করা; পুলিশ কমিশন গঠনের মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিরপেক্ষতা রক্ষা এবং মৌলিক অধিকার সংরক্ষণে সাংবিধানিক গ্যারান্টির বিস্তৃতি। এই আট সিদ্ধান্তকে কমিশনের মূল অর্জন হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। সূত্র জানায়, এসব ধারাকে ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’-এর কেন্দ্রীয় স্তম্ভ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
যেসব বিষয়ে মতানৈক্য: অন্যদিকে বাকি ১১টি বিষয়ে ভিন্নমত দিয়েছে কয়েকটি রাজনৈতিক দল। বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট ও বামধারার দলগুলো এই সিদ্ধান্তগুলো নিয়ে তাদের আপত্তি লিখিত আকারে জমা দিয়েছে। মতানৈক্যের বিষয়গুলোর সারাংশ নিচে তুলে ধরা হলো:
তত্ত্বাবধায়ক সরকার: কমিশনের প্রস্তাবে ছিলÑ পাঁচ সদস্যের নিরপেক্ষ কমিটির মাধ্যমে নির্বাচনের তত্ত্বাবধান হবে, প্রয়োজনে র্যাংকড চয়েস ভোট হবে। কিন্তু বিএনপি এই কাঠামো ‘নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের’ সঙ্গে সাংঘর্ষিক দাবি করে আপত্তি জানিয়েছে।
উচ্চকক্ষ গঠন: প্রস্তাব ছিল অনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতিতে ১০০ আসনের একটি দ্বিতীয় কক্ষ গঠন। কিন্তু বিএনপিসহ কয়েকটি দল এটিকে ‘সংবিধানবিরোধী’ এবং ‘গণতন্ত্রে দ্বৈত সংসদের হস্তক্ষেপ’ বলে উল্লেখ করেছে।
সংবিধান সংশোধনে উচ্চকক্ষের অংশগ্রহণ: কমিশনের মতে, দুই কক্ষের সম্মিলিত সম্মতিতে সংবিধান সংশোধন হবে। কিন্তু বিরোধীদলীয় নেতারা মনে করেন, কেবল নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের মাধ্যমেই সংবিধান সংশোধন হওয়া উচিত।
রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বৃদ্ধি: প্রস্তাবে রাষ্ট্রপতিকে নির্দিষ্ট নিয়োগক্ষমতা দেওয়ার কথা বলা হলেও বিএনপি এতে বিরোধিতা করেছে। তারা মনে করে, এতে সংসদীয় কাঠামোর ভারসাম্য নষ্ট হবে।
মহাপরীক্ষক, দুদক, পিএসসির স্বশাসন: সংবিধানে এসব প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব ও নিয়োগকাঠামো সংযুক্ত করার প্রস্তাব দিলেও আপত্তি জানানো হয় নিয়োগে নির্বাহী ক্ষমতা সীমিত করার বিষয়ে।
নারী আসনে সরাসরি নির্বাচন: কমিশনের খসড়া প্রস্তাবে ৫ শতাংশ নারীকে সরাসরি নির্বাচনে বাধ্যতামূলক করার কথা বলা হয়েছে। সিপিবি ও বাসদ এই সংখ্যা অন্তত ১৫ শতাংশ করার দাবিতে আপত্তি জানিয়েছে।
মূলনীতি পরিবর্তন: নতুন সংবিধানিক মূলনীতি প্রস্তাবিত হলে তা বামপন্থি দলগুলোর বিরোধিতার মুখে পড়ে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সূত্রে জানা গেছে, রাজনৈতিক দলগুলোর চূড়ান্ত মন্তব্য ও আপত্তিসমূহ পর্যালোচনা করে আগামী ১০ আগস্টের মধ্যে ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’ জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে। এরপর তা অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে জাতির উদ্দেশে উপস্থাপন করা হতে পারে, যা ভবিষ্যৎ নির্বাচনের অন্যতম দিকনির্দেশক দলিল হয়ে উঠবে।
এ বিষয়ে কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রিয়াজ বলেন, এটি একটি বহুমাত্রিক প্রক্রিয়া। শতভাগ ঐকমত্য একধরনের কল্পনা। তবে আমরা আটটি মৌলিক বিষয়ের ওপর সব রাজনৈতিক শক্তিকে একমত করতে পেরেছি, এটা ঐতিহাসিক সাফল্য।
তিনি আরও বলেন, নোট অব ডিসেন্ট থাকাটা প্রমাণ করে, আমরা মতপার্থক্যকে স্বীকার করি এবং গঠনমূলক বিতর্ককে স্বাগত জানাই।