ঢাকা মঙ্গলবার, ০৫ আগস্ট, ২০২৫

জুলাই স্পেশাল

অভ্যুত্থানে ১৭৩০ মামলা চার্জশিট মাত্র ১৫টির

শহিদুল ইসলাম রাজী
প্রকাশিত: আগস্ট ৪, ২০২৫, ১১:৫৩ পিএম
  • প্রায় ৭০ শতাংশ মামলার তদন্তে সন্তোষজনক অগ্রগতি: টিআইবি
  • ৬০-৭০টির তদন্ত শেষ পর্যায়ে
  • বিচার পাওয়া নিয়ে সংশয় স্বজনদের

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট। উত্তাল সারা দেশ। মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচিতে যোগ দিয়েছিলেন, সেলুনকর্মী বিপ্লব ম-ল। আশুলিয়ার বাইপাইল মোড়ে সে দিন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিক্ষোভকারীদের ওপর এলোপাতাড়ি গুলি চালায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে শ্বাসনালি ছিঁড়ে যায় বিপ্লবের। মারা যান এই তরুণ। সুরতহাল প্রতিবেদন ও ময়নাতদন্ত ছাড়াই দাফন করা হয় তার লাশ। বিপ্লব হত্যার ২৫ দিন পর আশুলিয়া থানায় একটি মামলা করেন তার বড় বোন মোছামাৎ মেমী। এ মামলার তদন্তকালে তদন্ত কর্মকর্তা গুলি চালানোর কোনো সিসি ক্যামেরা ফুটেজ কিংবা অন্য কোনোভাবে ধারণ করা কোনো ভিডিওফুটেজও সংগ্রহ করতে পারেননি। 


জুলাইয়ের শুরুতে রণক্ষেত্র ছিল চট্টগ্রামের ঘোলশহর, মুরাদপুর। আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে হামলা চালায় নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও সহযোগী সংগঠন। ওই বছরের ১২ জুলাই বিকেলে মুরাদপুরে সংঘর্ষে প্রথম শহিদ হন চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক ওয়াসিম আকরাম। সে দিন শহিদ হন আরও দুজন। তার একজন এমইএস কলেজে ব্যবস্থাপনা বিভাগের ছাত্র ফয়সাল আহমেদ শান্ত। সন্তানের মৃত্যুর পর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে মামলা করেন শান্তর বাবা। ১৮০ দিনে সে মামলার তদন্ত শেষ করার কথা থাকলেও এক বছরেও হয়নি। এ ছাড়া উল্লেখযোগ্য কোনো আসামি গ্রেপ্তার না হওয়ায় হতাশ পরিবার।
শুধু বিপ্লব আর শান্তই নয়, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে নিহত ছাত্র-জনতার একটি বড় অংশেরই মরদেহ দাফন করা হয়েছে ময়নাতদন্ত ছাড়াই। সুরতহাল প্রতিবেদনও তৈরি করেনি থানা পুলিশ। মামলার অভিযোগ প্রমাণে যেসব আলামত বা সাক্ষ্যপ্রমাণ প্রয়োজন, তা উদ্ধারে হিমশিম খেতে হচ্ছে তদন্ত কর্মকর্তাদের। 


জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতা হত্যাসহ বিভিন্ন ঘটনায় সারা দেশে ১ হাজার ৭৩০টি মামলা করা হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর। নির্মম এ হত্যাযজ্ঞের এক বছর পেরিয়ে গেলেও অধিকাংশ মামলার তদন্ত শেষ করেত পারেনি পুলিশ। তবে, রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা বলছেন, মামলার বিচার শেষ করতে তাড়াহুড়ো করবে না তারা। এদিকে, মামলাবাণিজ্যসহ বিচারকাজের ধীরগতি নিয়ে হতাশ স্বজন হারানো পরিবারগুলো। তবে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, সাক্ষ্য-প্রমাণে দুর্বল হওয়ার কারণে এসব হত্যাকা-ের মামলায় অপরাধীদের শাস্তি নিয়ে সংশয়, অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। 


পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র জানায়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে হতাহতের ঘটনায় দেশের বিভিন্ন স্থানে ১ হাজার ৭৩০টি মামলা করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৫টি মামলায় অভিযোগপত্র দিয়েছে পুলিশ। হত্যা মামলা রয়েছে পাঁচটি, বাকিগুলো অন্য ধারার মামলা। পাঁচটি হত্যা মামলার মধ্যে তিনটি শেরপুর, একটি কুড়িগ্রাম ও একটি চট্টগ্রাম মহানগর এলাকার। অন্যদিকে ঢাকা ও বরিশাল মেট্রোপলিটন এলাকায় একটি করে এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জে তিনটি, সিরাজগঞ্জে দুটি ও পাবনায় একটি মামলা রয়েছে। পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) আরও দুটি মামলার তদন্ত করছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বেশির ভাগ মামলা হয়েছে গত বছরের ১৯ জুলাই এবং ৪ ও ৫ আগস্টের হতাহতের ঘটনায়। এসব মামলায় সবচেয়ে বেশি তদারকি পুলিশ সদর দপ্তরের। ৬০ থেকে ৭০টি হত্যা মামলার তদন্ত শেষ পর্যায়ে আছে। পর্যায়ক্রমে এসব মামলার প্রতিবেদন দেওয়া হবে বলে জানায় পুলিশ সদর দপ্তর।


পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) এ এইচ এম শাহাদাত হোসাইন বলেন, পুলিশ সদর দপ্তরের মনিটরিংয়ের মাধ্যমে মামলাগুলোর তদন্ত চলছে। অনেক মামলারই তদন্তে অগ্রগতি আছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে পুলিশের গুলিতে হতাহতের ঘটনায় মামলা হয়েছে ৭৬১টি। এসব মামলায় অন্যান্য আসামির পাশাপাশি ১ হাজার ১৬৮ জন পুলিশ সদস্যকে আসামি করা হয়েছে। আসামিদের মধ্যে পুলিশের সাতজন সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) থেকে শুরু করে কনস্টেবল পদের সদস্যরা রয়েছেন। মামলায় তাদের বিরুদ্ধে গুলি করা কিংবা গুলি চালানোর নির্দেশ দেওয়ার অভিযোগ আনা হয়েছে। দেড় হাজারের বেশি পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে মামলা হলেও এ পর্যন্ত গ্রেপ্তার তার হয়েছেন মাত্র ৬৩ জন। এর মধ্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দুটি মামলায় ৯ পুলিশ সদস্যের বিচার শুরু হয়েছে। এ ছাড়া অন্য কোনো মামলার তদন্তই শেষ হয়নি।


জানা গেছে, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে সময়ে ডিএমপির বিভিন্ন থানায় রুজু হওয়া ৪৭টি মামলার তদন্ত করছে ডিবি পুলিশ। মামলাগুলো ডিএমপি সদর দপ্তরের কর্মকর্তারা নিয়মিত তদারকি করছেন। এ ছাড়া পুলিশ সদস্যরা আসামি থাকা মামলাগুলোর মধ্যে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) ৬৮টি মামলার তদন্ত করছে। 


পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) সদর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, পিবিআইর তদন্তাধীন মামলাগুলোর মধ্যে ৩৪টি মামলায় ভিকটিমের মরদেহ ময়নাতদন্ত ছাড়াই দাফন করা হয়েছে। শ্যোন অ্যারেস্টসহ পিবিআই এ পর্যন্ত ২১৫ আসামিকে গ্রেপ্তার করেছে। এটি হচ্ছে মামলার এজাহারভুক্ত আসামির মধ্যে মাত্র ৫ শতাংশ। যদিও পিবিআই বলছে, তাদের কর্মকর্তারা মামলাগুলোর ৬০ থেকে ৮০ শতাংশ তদন্তের কাজ এরই মধ্যেই শেষ করেছেন।


তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নিহতদের অধিকাংশ আলামতই নষ্ট হয়ে গেছে। এখন আসামিদের দোষী প্রমাণের পর্যাপ্ত তথ্য-প্রমাণ জোগাড় করাও কঠিন। এ ছাড়া সাক্ষী হতে অনেকেই অনাগ্রহ দেখাচ্ছেন। ফলে তদন্তের ক্ষেত্রে এখন মোবাইল ফোনের সিডিআর, গণমাধ্যমে প্রচারিত ভিডিও এবং সিসি ক্যামেরার ফুটেজসহ ডিজিটাল প্রমাণের ওপর ভরসা করতে হচ্ছে। 


পুলিশ আসামি থাকা মামলার তদন্তের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সব স্পর্শকাতর মামলা। পুলিশ সদস্যরা আসামি থাকায় তদন্ত করতে হবে নির্ভুল। কারণ, তাদের বেশির ভাগ বাহিনীতে কর্মরত থাকায় তাড়াহুড়োর তদন্তে ভুল হলে বাহিনীতে ক্ষোভের সৃষ্টি হতে পারে। এ জন্য সব ধরনের প্রশ্ন ও বিতর্কের ঊর্ধ্বে থেকে মামলাগুলোর তদন্ত করতে চান তারা। 


তবে টিআইবির এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, গণঅভ্যুত্থান চলাকালে হত্যাকা-ে জড়িত বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে মামলার পরিপ্রেক্ষিতে কিছু বিভাগীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলেও, কার্যকর জবাবদিহির ক্ষেত্রে সরকারের সদিচ্ছা ও সক্ষমতার ঘাটতি দেখা গেছে।


টিআইবির ফেলো শাহজাদা এম আকরাম বলেন, ছাত্র-জনতার ওপর হামলাকারী ও হত্যার নির্দেশদাতাদের বিরুদ্ধে হওয়া ১ হাজার ৬০২টি মামলার মধ্যে ৬৩৮টি হত্যা মামলা। পতিত সরকারের আনুমানিক ৮৭ জন মন্ত্রী ও সংসদ সদস্য গ্রেপ্তার রয়েছেন। প্রায় ৭০ শতাংশ মামলার তদন্তে সন্তোষজনক অগ্রগতি হয়েছে। ৬০-৭০টি হত্যা মামলার তদন্ত এখন শেষ পর্যায়ে।


তিনি আরও জানান, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রমও গত এক বছরে শুরু হয়েছে। এখন পর্যন্ত অভিযোগ এসেছে ৪২৯টি, মামলা হয়েছে ২৭টি। অভিযুক্তদের তালিকায় শেখ হাসিনাসহ ২০৬ জন রয়েছেন, যাদের মধ্যে ৭৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সংশোধিত আইন কার্যকর হওয়ার আগেই বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, তবে বিচারকাজে ধীরগতি রয়েছে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
জুলাই আন্দোলনে নিহত ফয়সাল আহমেদ শান্তর বাবা বলেন, যেখানে অন্তত ৫০ শতাংশ আশা ছিল, তা এখন ১০ শতাংশে নেমে এসেছে। বাধা প্রতিবন্ধকতা থাকতে পারে, তারপরেও বিচারকাজ আগানো উচিত ছিল।


গত বছরের ১৯ জুলাই উত্তরায় নিহত হন মোহাম্মদ আসাদুল্লাহ, পেশায় ছিলেন গাড়িচালক। তার স্ত্রী ফারজানা বেগম জানান, ওই ঘটনায় আসাদুল্লাহর মা বাদী হয়ে মামলা করেছেন। ফারজানা বলেন, ‘মামলায় কতজন আসামি, কেউ গ্রেপ্তার হয়েছে কি না, তার কিছুই আমি জানি না। আমার শাশুড়িও জানে না। তার সঙ্গে কথা বললে তিনি কিছু বলতে পারেন না। পুলিশও আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে না। আসলে এ মামলার ব্যাপারে আমরা কোনো খবর এখন আর রাখি না।’
ডিএমপির উপ-পুলিশ কমিশনার (মিডিয়া) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান বলেন, ‘আমরা আশা করি দ্রুততম সময়ের ভেতরে কিছু মামলার যে অগ্রগতি প্রতিবেদন সেগুলো বিজ্ঞ আদালতে দাখিল করতে পারব।’


জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ঘটনায় হওয়া মামলার তদন্তে অগ্রগতি হয়েছে উল্লেখ করে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, মামলাগুলোয় ২০ জন আসামি হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু দেখা গেছে ২০০ জনকে আসামি করা হয়েছে। এ জন্য তদন্তে সময় বেশি লাগছে। কোনো নিরপরাধ ব্যক্তি যেন কোনো অবস্থায়ই শাস্তির আওতায় না আসেন। অনেকে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য নিরপরাধ ব্যক্তিকে আসামি করেছেন। প্রকৃত আসামিদের নাম দেওয়া হলে তদন্তে এত সময় লাগত না।