স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আর দুই বিভাগে বিভক্ত থাকবে না। বিভক্তির প্রায় আট বছর পর আবারও দুই বিভাগকে এক করা হবে। প্রশাসনিক উন্নয়নসংক্রান্ত সচিব কমিটির ২০২৫-২৬ অর্থবছরের দ্বিতীয় সভায় এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এর আগে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস দুই বিভাগ এক করার ইচ্ছা পোষণ করে অনুমোদন দিয়েছেন। প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের পরিচালক এ কে এম মনিরুজ্জামানের সই করা এক চিঠিতে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে নির্দেশনা দিয়েছেন।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের প্রশাসনিক উন্নয়ন ও সমন্বয়-১ অধিশাখা সূত্রে জানা গেছে, জননিরাপত্তা বিভাগ ও সুরক্ষা সেবা বিভাগকে একত্রিকরণের মাধ্যমে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গঠনের লক্ষ্যে বিভাগ দুটির বিদ্যমান কার্যতালিকা সমন্বয় করে প্রস্তাবিত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কার্যতালিকা অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
জানা গেছে, কাজের সুবিধার যুক্তিতে ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে দুই ভাগে ভাগ করা হয়। একটি বিভাগের নাম হয় জননিরাপত্তা বিভাগ এবং আরেকটির নাম হয় সুরক্ষা সেবা বিভাগ। বর্তমানে জননিরাপত্তা বিভাগের অধীন রয়েছে পুলিশ অধিদপ্তর, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি), বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী, বাংলাদেশ কোস্টগার্ড, তদন্ত সংস্থা ও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালস, ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার। আর সুরক্ষা সেবা বিভাগের অধীন রয়েছে বহিরাগমন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তর, কারা অধিদপ্তর, বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর।
এটি হওয়ার পর সুযোগ-সুবিধা ও দায়িত্ব নিয়ে দুই বিভাগের কর্মীদের মধ্যে মতানৈক্য তৈরি হয়। এ অবস্থায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে আগের মতো একটি বিভাগে পরিণত করার উদ্যোগ নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। এরপর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দুই বিভাগ একীভূত করার অনুমোদন দেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে নির্দেশনা প্রদান করে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দুই বিভাগ একীভূত হলে ব্যয় কমে আসবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। চিঠিতে দুই বিভাগের অধীনে থাকা ১০টি দপ্তর ও অধিদপ্তর একত্র করে একীভূত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালনার নির্দেশনা দেওয়া হয়। বর্তমানে সিনিয়র সচিব মোহাম্মদ আবদুল মোমেন জননিরাপত্তা বিভাগের পাশাপাশি সুরক্ষা সেবা বিভাগেরও সচিবের দায়িত্ব পালন করছেন।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানিয়েছে, বর্তমানে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দুই বিভাগে মোট পদ রয়েছে ৫১৮টি। এর মধ্যে জননিরাপত্তা বিভাগে ২১৬ এবং সুরক্ষা সেবা বিভাগে ৩০২টি ক্যাডার ও নন ক্যাডার পদ রয়েছে। দুই বিভাগে বিদ্যমান ৫১৮টি পদ থেকে ৩টি ক্যাডার পদ এবং ১২টি নন ক্যাডার পদ বিলুপ্তির প্রস্তাব করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এ ছাড়া নতুন করে ৩১টি পদ সৃষ্টির প্রস্তাব করা হয়েছে প্রশাসনিক উন্নয়নসংক্রান্ত সচিব কমিটির কাছে। ৩১টি নতুন পদ সৃষ্টির প্রস্তাবে ৫টি ক্যাডার পদ স্থায়ীভাবে এবং ২৬টি নন ক্যাডার পদ অস্থায়ীভাবে বছর বছর সংরক্ষণের প্রস্তাব করা হয়েছে।
দুই বিভাগ এক করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাংগঠনিক কাঠামোতে সচিবের দপ্তর ১টি, অনুবিভাগ ১৫টি, অধিশাখা ৩০টি এবং ৭৬টি শাখার জন্য বিদ্যমান ৫১৮টি পদের অতিরিক্ত ৫১টি পদ সৃজনসহ মোট ৫৬৯টি পদ অনুমোদনের প্রস্তাব জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় জননিরাপত্তা বিভাগ এবং সুরক্ষা সেবা বিভাগ দুটিকে একত্রীকরণের জন্য সাংগঠনিক কাঠামোতে বিদ্যমান ৫১৮টি পদের মধ্যে ১৫টি পদ বিলুপ্ত এবং রাজস্ব খাতে ৪৭টি (স্থায়ীভাবে ৫টি ক্যাডার পদ এবং অস্থায়ীভাবে অন্যান্য ৪২টি) পদ সৃজনের সুপারিশসহ ৫৫০টি (স্থায়ীভাবে ১১৯টি ক্যাডার পদ ও অস্থায়ীভাবে অন্যান্য ৪৩১টি) পদের সমন্বয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গঠনের সম্মতি দেয়। অর্থ বিভাগ (ব্যয় ব্যবস্থাপনা) দুই বিভাগ একত্রীকরণের জন্য সাংগঠনিক কাঠামোতে বিদ্যমান ১৫টি পদ বিলুপ্ত এবং রাজস্ব খাতে ৩১টি পদ সৃজনের সম্মতিসহ সর্বমোট ৫৩৪টি (স্থায়ীভাবে ১১৯টি ক্যাডার পদ ও অস্থায়ীভাবে অন্যান্য ৪১৫টি) পদের সমন্বয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গঠনের সম্মতি দেয়।
২০১৪ সালে বিদেশে পাসপোর্ট প্রদানের কাজ পররাষ্ট্র থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আনা হয়। তিন বছর পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে দুই বিভাগে বিভক্ত করা হলে বিদেশে পাসপোর্ট অফিসে কাজ করার সুযোগ নিয়ে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। পাসপোর্ট ইস্যুর কাজটি সুরক্ষা সেবা বিভাগ করে বলে এ বিভাগের কর্মীরা বিদেশে পাসপোর্ট অফিসে কাজ করার সুযোগ পেয়ে আসছেন। একপর্যায়ে উভয় বিভাগের কর্মীদের সমান হারে বিদেশে যাওয়ার সুযোগ দিতে পরিপত্র জারি করা হয়। বিষয়টি নিয়ে জননিরাপত্তা বিভাগ থেকে উচ্চ আদালতে মামলা হয়। এতে জননিরাপত্তা বিভাগের পক্ষে রায় হয়। এর আলোকে উভয় বিভাগের মধ্যে সমহারে বিদেশে যাওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়। পরে সুরক্ষা সেবা বিভাগ এ নির্দেশনার বিরুদ্ধে আপিল করে।
সংশ্লিষ্টরা বলেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দুই ভাগে ভাগ হওয়ায় কর্মকর্তাদের সুবিধা হলেও কর্মচারীদের সমস্যা হয়। সহায়ক জনবলের ঘাটতি পূরণে মন্ত্রণালয়ে অন্তত ৪০-৪৫ জন পুলিশ সদস্যের পদায়ন হয়েছিল। এ নিয়ে কর্মচারীদের মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে। বিক্ষুব্ধদের মত হচ্ছে, দুই বিভাগ একত্র হলে অতিরিক্ত জনবল প্রয়োজন হবে না। এদিকে, সুরক্ষা সেবার অধীনে থাকা পাসপোর্ট ভেরিফিকেশন ও ইমিগ্রেশনে দায়িত্ব পালন করছেন পুলিশ সদস্যরা। অথচ পুলিশের পদায়নের দায়িত্বে রয়েছে জননিরাপত্তা বিভাগ। এটিও উভয় বিভাগের মধ্যে অসন্তোষের কারণ।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, এখন কোনো মন্ত্রণালয়ই অর্গানোগ্রাম অনুযায়ী চলছে না। কাজের সুবিধার যুক্তিতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কেও স্বাস্থ্যসেবা এবং স্বাস্থ্যশিক্ষা ও পরিবারকল্যাণ এ দুই বিভাগে বিভক্ত করা হয়। কিন্তু সেখানে ৮০ শতাংশ ক্ষমতা স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের হাতে রয়ে যায়। এ নিয়ে বিভাগ দুটির মধ্যে চলছে দ্বন্দ্ব।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বিদেশে পদায়নের সুযোগ পাওয়া না-পাওয়া এবং এক বিভাগের কর্মীদের পদায়নের দায়িত্ব অন্য বিভাগের হাতে থাকার মতো বিষয়ে দুই বিভাগের মধ্যে টানাপোড়েন চলছে।
আপনার মতামত লিখুন :