ঢাকা শুক্রবার, ১৫ আগস্ট, ২০২৫

পাথরকাণ্ডে বাঘ-মহিষ এক ঘাটে

সালমান ফরিদ, সিলেট
প্রকাশিত: আগস্ট ১৫, ২০২৫, ০৫:০২ এএম
ছবি- রূপালী বাংলাদেশ

সিলেটের ভোলাগঞ্জের সাদাপাথর, জাফলং ও বিছনাকান্দির পর্যটন মূলত প্রকৃতিনির্ভর। মেঘালয় পাহাড় ছুঁয়ে নেমে আসা পাথর ও বালুর সৌন্দর্যের ওপর ভিত্তি করে সিলেটে গড়ে উঠেছে ইকো ট্যুরিজম। কিন্তু সেই ইকো ট্যুরিজম এখন ধ্বংসপ্রায়। প্রকৃতিখেকো দানবদের ধ্বংসযজ্ঞে বিলীন হতে চলেছে সিলেটের পর্যটন শিল্প। দীর্ঘদিন ধরে গোপনে বালু ও পাথর লুটের পরও কোনো রকমে টিকে ছিল।

তবে এই শিল্পের বুকে শেষ পেরেক মারার বন্দোবস্ত চলছে। সেই বন্দোবস্তে নাম লিখিয়েছেন রাজনীতির মানুষ, সরকারি প্রশাসনের লোক এবং স্থানীয় পাথরখেকো চক্র। ত্রিমুখী ছোবলে এখন সিলেটের বিখ্যাত তিন পর্যটনকেন্দ্র পরিণত হয়েছে মরুভূমিতে।

সম্প্রতি দেশব্যাপী আলোচিত বিষয়- সিলেটের ভোলাগঞ্জ থেকে সাদাপাথর লুটের ঘটনা। তবে শুধু সাদাপাথর নয়, এরই মধ্যে লুটেপুটে সাবাড় করে ফেলা হয়েছে সিলেটের আরও দুই বিখ্যাত পর্যটন স্পট বিছনাকান্দি এবং জাফলং। ভয়ংকর লুটের শিকার হয়ে সাদাপাথর, বিছনাকান্দি ও জাফলং তার চিরচেনা রূপ হারিয়ে ফেলেছে। গত এক বছরে নির্বিচারে পাথর ও বালু উত্তোলনে এসব স্থানে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এখন পুরোপুরি বিলীন।

পাথর ও বালু লুট চক্রের মূল হোতাদের মধ্যে স্থানীয় বিএনপি নেতাদের নাম সবার আগে। এ নিয়ে বিব্রত দলটি। দলটির স্থানীয় নেতা থেকে শুরু করে জেলা ও কেন্দ্রীয় দুজন নেতার নামও আলোচনায় রয়েছে। প্রাকৃতিক সম্পদ লুটের তালিকায় উচ্চারিত হচ্ছে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ নেতাদের নামও। এমনকি জামায়াতেরও কয়েকজন নেতাকর্মী এই লুটপাটের সঙ্গে জড়িত বলে নানা সূত্র থেকে জানা গেছে।

বালু ও পাথর লুটের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় এরই মধ্যে জেলা বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক গোয়াইনঘাটের জাফলংয়ের রফিকুল ইসলাম শাহপরাণ এবং কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা বিএনপি সভাপতি শাহাব উদ্দিনকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। আরও কয়েকজনের বিরুদ্ধে দল ব্যবস্থা নেওয়ার পথে রয়েছে।

দলীয় সূত্র জানায়, দুজনসহ আরও কয়েকজনের নামে অভিযোগ রয়েছে। বাকিদের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। তারা স্থানীয়ভাবে লুটের সঙ্গে জড়িত হলেও জেলা ও কেন্দ্রের কয়েকজন নেতার নাম এসেছে তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়ার বিষয়ে। গোয়েন্দাদের তালিকায়ও রয়েছে তাদের নাম। পাথরকাণ্ডে জড়িত থাকার তালিকায় সিলেট জেলা বিএনপির শীর্ষ এক নেতাসহ কেন্দ্রের দায়িত্বে আছেন এমন আরও দুজনের নামও রয়েছে।

নিজের দলের কারও কারও নাম আলোচিত হচ্ছে বলে স্বীকার করেন মহানগর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রেজাউল হাসান কয়েস লোদী। তিনি বলেন, ‘আমাদের দলের অনেকের নামে অভিযোগ আসায় আমরা বিব্রত। ব্যাপারটি গুরুত্বের সঙ্গে আমলে নেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে কয়েকজনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে। দলের প্রধান নীতিনির্ধারক তারেক রহমানও বিষয়টি অবগত।’ তিনি বলেন, ‘আমরা পাথর লুট বরদাস্ত করব না। তবে সনাতন পদ্ধতিতে বালু ও পাথর উত্তোলনের পক্ষে আমরা। সরকার চাইলে লুটপাট ঠেকাতে আমাদের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও সম্পদ রক্ষা করেও শর্ত সাপেক্ষে পাথর-বালু উত্তোলনের অনুমতি দিতে পারে। অতীতে যেমনটি হয়ে আসছিল।’

নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র জানায়, ভোলাগঞ্জের সাদাপাথর লুটে রাজনৈতিক নেতাকর্মী ও পাথরখেকোদের পাশাপাশি কোম্পানীগঞ্জ থানার ওসি ওজায়ের আল মাহমুদের নামও আলোচিত হচ্ছে। কোম্পানীগঞ্জে তার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই সাদাপাথর পুরোপুরি সাবাড় করা হয়েছে। পাথর চোরাকারবারিদের সঙ্গে মিলেমিশে তিনি একাকার হয়ে গিয়েছিলেন। লুটপাটের সময় তিনি নীরব ভূমিকা পালন করেন বলে অভিযোগ। এর জন্য তিনি নিয়মিত বড় অঙ্কের উৎকোচ নিয়েছেন।

ভোলাগঞ্জের সাদাপাথর: কয়েক মাস আগেও যে স্থানটিতে সাদাপাথর ছড়ানো ছিল, সেটি আগের চেহারায় নেই। চতুর্মুখী লুটের শিকার হয়ে চিরচেনা দৃশ্য পাল্টে গেছে। লুটেরাদের থাবায় পাথরশূন্য স্থানটি পরিণত হয়েছে বিরানভূমিতে। সম্প্রতি এখানাকার পাথর চুরি আলোচিত হলেও এটি চলে আসছে গত আওয়ামী লীগ সরকারের আমল থেকে।

তবে অতীতে লুটপাট ছিল কম। ৫ আগস্টের পর যে থাবা বসানো হয়েছে চারদিক থেকে, সেই থাবায় আর নিজের অস্থিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারেনি সাদাপাথর। লুট করে নেওয়া হয়েছে পাথর ও বালু। পাল্টে দেওয়া হয়েছে আসল চেহারা। এই লুটের সঙ্গে বিএনপি, আওয়ামী লীগ, জামায়াত, প্রশাসন, পুলিশ, বিজিবি একাকার। দৈনিক রূপালী বাংলাদেশের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে লুটপাটের সঙ্গে জড়িতদের নাম।

স্থানীয় একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, সাদাপাথর লুটের প্রধান নায়ক চারজন। কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান শামীম আহমদ শামীম, বিএনপির উপজেলা সভাপতি (পদ স্থগিত) শাহাব উদ্দিন, উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আলফু মিয়া এবং কোম্পানীগঞ্জ থানার ওসি উযায়ের আল মাহমুদ। এই চারজনের কারণেই বিলীন হয়ে গেছে সাদাপাথর। সাদাপাথর থেকে পাথর লুটের পেছনে তাদের ভূমিকাই সবচেয়ে বেশি।

সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগের সময়ে এখানকার সরকারি জায়গা দখল করে রেখেছিলেন উপজেলা চেয়ারম্যান শামীম আহমদ শামীম। তার বাড়ি কোম্পানীগঞ্জের পাড়ুয়ায়। আওয়ামী লীগের আমলে তিনিই ছিলেন পুরো ভোলাগঞ্জের গডফাদার। তিনি যা বলতেন, সেখানে তা-ই হতো। প্রশাসন-পুলিশ তার কথায় উঠত-বসত। পাথর-বালু রাজ্য নিয়ন্ত্রণ করতেন তিনিই। এখন শামীম পলাতক। সরকারি ও ভোগদখলকৃত সম্পত্তি ছেড়ে পালিয়ে গেলেও তার কাছে ভোলাগঞ্জের একাধিক ব্যবসায়ীর অন্তত ১২ কোটি টাকার মতো পাওনা রয়েছে।

স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানান, এই টাকা দিয়ে তিনি এলসির ব্যবসা করতেন। কিন্তু ৫ আগস্টের পর টাকা না দিয়ে তিনি এখন লাপাত্তা হয়ে যান। এখন কেউ তার খবর জানে না। তার বাহিনীই এক বছর আগে পর্যন্ত সাদাপাথর নিয়ন্ত্রণ করত। কিন্তু সেই আমলে সরকার কিছু স্থাপনা নির্মাণ এবং জমি উদ্ধার করতে পেরেছিল।

কিন্তু ৫ আগস্টের পর চিত্র পুরোপুরিই পাল্টে যায়। এখন সেই সাদাপাথর নিয়ন্ত্রণ করেন পদ স্থগিত হওয়া উপজেলা বিএনপির সভাপতি আলোচিত শাহাব উদ্দিন। ভোলাগঞ্জের এলসি স্টেশন, মোবাইল ক্রাসারসহ পুরো এলাকা দখলে তার।

সূত্রমতে, প্রশাসন থেকে এলসি এলাকা ও মোবাইল ক্রাসার এলাকায় সরকারি সম্পত্তি দেয়াল দিয়ে আলাদা করে দেওয়া হয়েছিল। নির্মাণ করা হয়েছিল শুল্ক ভবনসহ সরকারি স্থাপনা। কিন্তু ৫ আগস্টের পর শামীমের পুরো সাম্রাজ্য দখলে নেন শাহাব উদ্দিন। এক দিনের ব্যবধানে তিনি হয়ে ওঠেন ভোলাগঞ্জের অধিপতি। সরকারি স্থাপনা ও দেয়াল ভেঙে রাতারাতি সব গুঁড়িয়ে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেন শাহাব উদ্দিন। লুটপাট করেন এবং দখলে নেন প্রায় হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি।

তিনি তার নিকটজনদের বলেন, বাংলাদেশের পাশে বর্ডার ঘেঁষে ভারতের ভোলাগঞ্জে পাথর ব্যবসাকে কেন্দ্র করে উন্নয়ন করছে না সরকার। তাহলে বাংলাদেশে কেন পাথর ব্যবসাকে লক্ষ্য করে এখানে উন্নয়ন হবে? সরকারি স্থাপনা তৈরি হবে? বর্তমানে তার দখলে রয়েছে অন্তত ৭০ কোটি টাকার সরকারি ভূসম্পত্তি। বিভিন্ন পাথর ব্যবসায়ী ও ক্রাসার মিলমালিকদের কাছে এসব জায়গা তিনি ভাড়া দিয়েছেন। এসব ভূসম্পত্তির এক কিয়ার ভাড়া নিতে প্রতি বছর ব্যবসায়ীদের ৫০ থেকে ৬০ লাখ টাকা ভাড়া গুনতে হয়।

তার কাছ থেকে ভাড়া নিয়ে পাথর আমদানির ব্যবসা করেছেন এমন এক ব্যবসায়ী বলেন, যে কয় বছর তার ভোগদখলীয় সরকারি সম্পত্তিতে ভাড়া ছিলাম, ততদিনে অন্তত ৪ কোটি টাকা আমি তাকে ভাড়া দিয়েছি। ওই জায়গা ছিল সরকারি। শাহাব উদ্দিন যুগযুগ ধরে তা দখল করে রেখেছেন। তিনি জানান, ভোলাগঞ্জের ১০ নম্বর এলাকার ৯০ ভাগ জায়গা শাহাব উদ্দিনের দখলে। বাকি ১০ ভাগ তারই আত্মীয়স্বজনের।

লুটপাটে জড়িত আরেকজন হলেন সিলেট নগরীর বরইকান্দি থেকে ভোলাগঞ্জে গিয়ে বসতি করে বালু-পাথর ব্যবসায় প্রতিষ্ঠিত হওয়া আলফু মিয়া। তিনি কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি এবং সিলেট জেলা যুবদলের সাধারণ সম্পাদক মকসুদ আহমদের বোনজামাই।

মকসুদের আশীর্বাদে আওয়ামী লীগ নেতা হলেও তিনি আছেন বহালতবিয়তে। কুকর্ম করে যাচ্ছেন সমানতালে। আলফু মিয়ার সঙ্গে আছেন তার ডান হাত মায়া। এই মায়ার নামেই মূলত আলফু মিয়া তার সব অপকর্ম করেন। তার নামেই ধলাই নদীর ওপর নির্মিত ধলাই সেতুর দক্ষিণ দিকের বালু লিজ এনে একেবারে সিলেটের দ্বিতীয় দীর্ঘতম সেতু ‘ধলাই সেতু’ পর্যন্ত গ্রাস করতে শুরু করেছেন।

জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দলের নেতা হলেও ইউপি চেয়ারম্যান আলমগীর হোসেন বালু ও পাথর লুটে যোগ দিয়েছেন আলফু সিন্ডেকেটের সঙ্গে। বৃহস্পতিবার তিনি পুলিশের হাতে বালু লুটের ঘটনায় আটক হন। আলফু মিয়ার ভাই ও আওয়ামী লীগ নেতা আকদ্দুস মিয়া, রুহেল মিয়া, আলী বক্স বালু লুটের হোতাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। তারা সবাই মিলে ধলাই নদীর বালু লিজ এনেছেন। ধলাই সেতু থেকে ১ হাজার ৬০০ ফুট দূরের নদী পর্যন্ত বালু উত্তোলনের অনুমোদন থাকলেও তারা ব্রিজের একেবারে পিলার পর্যন্ত এসে বালু তুলছেন। এতে ধলাই সেতু হুমকির মুখে পড়েছে। তারাও পাথর লুট করেছেন গত এক বছর ধরে।

এই চক্রের আরেকজনের নামও আলোচিত হচ্ছে। তিনি আবুল হোসেন। আবুল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কোয়ারি নিয়ে লাইভ করতেন। কিন্তু গত দুই মাস ধরে তিনি নীরব। পাথর লুটপাট নিয়ে আলোচনা শুরুর পর তিনি আড়ালে চলে গেছেন।

স্থানীয় সূত্র জানায়, ভোলাগঞ্জের সাদাপাথর ও বাঙ্কারে শামীমের সময়েও কেউ হাত দেয়নি। ৫ আগস্টের পর শাহাব উদ্দিন রাজত্ব দখলে নিয়ে সব মাটির সঙ্গে একাকার করে দিয়েছেন। তাদের সহযোগী হয়ে নীরবে সহায়তা দিয়েছেন কোম্পানীগঞ্জ থানার ওসি ওজায়ের আল মাহমুদ। তার বাড়ি ভৈরব। আচরণে খুবই স্বজ্জন এবং মিষ্টভাষী। ৫ আগস্টের পরে পুলিশ প্রশাসনে অফিসার-শূন্যতার সময় তাকে পাঠানো হয় সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ থানায়। সেই থেকে গত এক বছর ধরে তিনি সেখানেই আছেন। 

কোম্পানীগঞ্জে এসে তিনি শাহাব উদ্দিন, আলফু মিয়া ও শ্রমিক দলের নেতা ইউপি চেয়ারম্যান আলমগীর হোসেনকে নিয়ে সাদাপাথর লুটের প্ল্যান করেন। সেই প্ল্যানের অংশ হিসেবে সাবাড় করে দেওয়া হয়েছে পুরো সাদাপাথর। বিষ্ময়করভাবে সাদাপাথর লুটেরাদের প্রশ্রয়দাতা ও কমিশনভোগী ওসি ওযায়ের আল মাহমুদের নামে গুঞ্জন থাকলেও সিলেট জেলা পুলিশ গত এক বছরে দুবার তাকে শ্রেষ্ঠ ওসি হিসেবে পুরস্কৃত করে।

অভিযোগ আছে, ওসি ওযায়ের সাদাপাথর থেকে তোলা টাকার ভাগ তার ওপরমহলেও পাঠাতেন। ফলে তার কুকীর্তি জানার পরও তাকে সেখানে রেখে একাধিকবার পুরস্কৃত করা হয়েছে। তার হয়ে কোয়ারি থেকে টাকা তুলতেন দোলা মেম্বার, মিজান মাস্টার, বৃহস্পতিবার আটক হওয়ায় শ্রমিক দলের নেতা ইউপি চেয়ারম্যান আলমগীর হোসেন। দোলা বিএনপি নেতা শাহাব উদ্দিনের এবং আলমগীর আলফু মিয়াদের টাকা পৌঁছে দেন তার হাতে। এরাও পাথর লুটের সঙ্গে সরাসরি জড়িত।

তবে এ অভিযোগ অস্বীকার করেন ওসি ওযায়ের আল মাহমুদ। বলেন, ‘আমি লুটেরাদের শত্রু। আমরা তাদের বিরুদ্ধে ১৯টি মামলা করেছি। বিভিন্ন সময়ে লুটেরাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গিয়ে আমি ও আমার বাহিনী আক্রান্ত হয়েছি। পুলিশ আক্রান্তের মামলা আছে পাঁচটি। যদি তাদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক থাকত বা লুটপাটে সহায়তা করতাম, তাহলে আমার ওপর হামলাও হতো না, মামলাও করতে হতো না পুলিশকে।

শাহাব উদ্দিনের লাঠিয়াল বাহিনীর প্রধান হলেন বিএনপির দোলা মেম্বার। চোরাচালান ও পাথর লুটের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে কয়েক দিন আগে তাকে মেম্বার পদ থেকে বরখাস্ত করা হয়। তার কাজ শাহাব উদ্দিনের হয়ে প্রশাসন, পুলিশ, বিজিবি ম্যানেজ করা। এমনকি ছোট ছোট ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান এবং পর্যটকদের নৌকা থেকে তিনিই চাঁদার টাকা তোলেন। চাঁদার টাকা তিনিই পৌঁছে দেন প্রশাসন, পুলিশ, বিজিবির কাছে। স্থানীয়দের দাবি, যদি তাদের সম্পৃক্ততা না থাকে, তাহলে বিজিবির দুই ক্যাম্পের মাঝখানে থানার পাশ থেকে কীভাবে বালু-পাথর লুট হয়?

পাথর ও বালু লুটের তালিকায় নাম উঠে এসেছে কলাবাড়ীর নিজাম উদ্দিন মাস্টারের। তিনি ভোলাগঞ্জে পাথর ও বালু লুটের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের একজন। সম্প্রতি আলফু মিয়ার সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় এবং ভাগের অর্থ কম ও বালু-পাথরে প্রভাব কমে যাওয়ায় তিনি ধলাই সেতু রক্ষার নামে আন্দোলন শুরু করেন। মূলত ভোলাগঞ্জে পাথর ও বালু লুটে তার নাম শীর্ষ লুটেরাদের নামের সঙ্গে উচ্চারিত হয়। এর আগে তিনি একটি প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। এখন সেই পেশায় নেই। সাদাপাথর লুটে সিলেট জেলা যুবদলের সাধারণ সম্পাদক মকসুদ আহমদ, সহসাধারণ সম্পাদক বাহার আহমদ রুহেল, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা যুবদল যুগ্ম আহ্বায়ক সিয়াস উদ্দিন, রজন মিয়ার সম্পৃক্ততার অভিযোগ রয়েছে। 

জাফলং: জাফলংয়ে পাথর ও বালু লুটে বিএনপি, আওয়ামী লীগ, জামায়াত, এনসিপি- সবাই মিলেমিশে একাকার। এখানেও গত ৫ আগস্টের আগে নিয়ন্ত্রণ ছিল আওয়ামী লীগের হাতে। তারাই ছিলেন পাথররাজ্যের অধিপতি। নিয়ন্ত্রণ করতেন খোদ সাবেক মন্ত্রী ও স্থানীয় এমপি ইমরান আহমদ। ৫ আগস্টের পরে সেটি হাতছাড়া হয়ে যায় আওয়ামী লীগের। রাজত্বে আসেন নতুন কয়েকজন কর্ণধার।

স্থানীয় একাধিক সূত্র জানায়, রাত গভীর হওয়ার সঙ্গে জাফলংয়ের নদীর ঘাটে আসে শত শত ট্রাক। প্রতিদিন যার সংখ্যা হবে ২০০ থেকে ২৫০। অন্যদিকে চা-বাগানের পাশের ছোট ছোট খাল দিয়ে গভীর রাতে এসে নামে শত শত নৌকা। সঙ্গে হাজার হাজার শ্রমিক। তারা রাতের অন্ধকারে হামলে পড়ে জাফলংয়ের বালুমহালে। এ সময় পুলিশ দায়িত্ব পালন করলেও হাজার হাজার বালুখেকোর সঙ্গে তারা পেরে ওঠে না। রাতব্যাপী অনেকটা চোর-পুলিশ খেলা চলতে থাকে লুটপাটে নামা শ্রমিক ও পুলিশের মধ্যে।
 
জাফলংয়ের বল্লাঘাট, জুমপার নয়াবস্তি, জাফলং নদীর ঘাট ব্রিজে অবস্থান নিয়ে ট্রাক নৌকা থেকে বালু সংগ্রহ শুরু করে। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে অবৈধভাবে উত্তোলিত বালু নিয়ে ট্রাকগুলো বের হয়ে যায় জাফলং এলাকা থেকে। রাতের অন্ধকারেই একসময় এসব নৌকা হারিয়ে যায় জাফলং থেকে। আর সকাল হওয়ার আগেই ট্রাকের সারি সিলেটের সীমানা অতিক্রম করে চলে যায় অজানা গন্তব্যে। এগুলো দিয়ে প্রতি রাতে পরিবহন করা হয় এক থেকে দেড় লাখ ফুট বালু, যার বাজারমূল্য দেড় কোটি টাকারও ওপরে। এভাবেই প্রতি রাতে অবৈধভাবে বিপুল পরিমাণ বালু পাচার হয়ে যাচ্ছে জাফলং থেকে।

সূত্র জানায়, বিএনপির বহিষ্কৃত নেতা রফিকুল ইসলাম শাহপরান এবং জাফলংয়ের লর্ড খ্যাত আনোয়ার হোসেন খান আনু আলোচিত হচ্ছে বেশি। রফিকুল ইসলাম শাহপরান জেলা বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক। ইতিমধ্যে পরিবেশ অধিদপ্তর তার বিরুদ্ধে কয়েকটি মামলাও করেছে। শাহপরানের টিমে আছেন গোয়াইনঘাট উপজেলা শ্রমিক লীগের সভাপতি ছমেদ আহমদ, জাফলং ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি আমজদ বখত, সাধারণ সম্পাদক মাসুদ রানা, ছাত্রদল নামধারী সোহেল, ইউসুফ, রাজ্জাক ও আওয়ামী লীগের আলিম উদ্দিন।

রফিকুল ইসলাম শাহপরান ধরাছোঁয়ার বাইরে অবস্থান করে রাতের আঁধারে বালু চুরির কার্যক্রম চালিয়ে যান। অবৈধভাবে উপর্জাতি অর্থ সবার মধ্যে ভাগবাটোয়ারা হয় তার নির্দেশনায়। অতি গোপনে সেলিম জমিদার ও শাহ আলম স্বপনের ভাগও পৌঁছে দেওয়া হয়। তবে এই অভিযোগ অস্বীকার করেন রফিকুল ইসলাম শাহপরান। বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে মিথ্যাচার হচ্ছে।’

স্থানীয়রা জানান, জাফলংয়ের লর্ড খ্যাত আনোয়ার হোসেন খান আনু হচ্ছেন বালুখেকো সিন্ডিকেটের শীর্ষ কর্ণধার ও প্রভাবশালী। এই আনু আন্ডারওয়ার্ল্ডের সব সমস্যার সমাধান করে দেন। তার টিমের প্রধান সদস্যরা হলেন কাশেম, শাহজাহান, আবদুল আলিমসহ কয়েকজন। এই সিন্ডিকেট বালু উত্তোলন, পাথর উত্তোলনসহ অন্যান্য অবৈধ কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেন। তবে নেপথ্যে ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকেন আনু। আনুর কাজ হলো কোনো সমস্যা সৃষ্টি হলে তার সমাধান করে দেওয়া। সমস্যা সমাধানে তার জুড়ি নেই। জটিলতা নিরসনে আনু যেকোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।

বিছনাকান্দি: গত ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর বিছনাকান্দির ভারত সীমান্তবর্তী স্থান থেকেও শতকোটি টাকার পাথর উধাও হয়ে গেছে। যে পাথরের ওপর স্বচ্ছ পানির স্রোতধারা পর্যটকদের আকৃষ্ট করত, সেই যায়গায় এখন গভীর গর্ত ছাড়া কিছুই নেই। এই পাথর লুটের নেপথ্যে রয়েছে স্থানীয় একটি প্রভাশালী চক্র। এই চক্রের নেতৃত্বেই লুট করা হয়েছে শতকোটি টাকার পাথর।

সীমানা পিলারের ১৫০ মিটার নো ম্যানস ল্যান্ড হিসেবে চিহ্নিত থাকে। নোম্যানস ল্যান্ড হিসেবে চিহ্নিত স্থান থেকে যেকোনো ধরনের প্রাকৃতিক সম্পদ অপসারণ আন্তর্জাতিক আইনে নিষিদ্ধ। কিন্তু বিছনাকান্দি থেকে অবৈধভাবে পাথর উত্তলনকারীরা নো-ম্যানস ল্যান্ডের কয়েক মিটার ভেতর পর্যন্ত অবৈধভাবে পাথর উত্তলন করছে।