- সমানতালে ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, করোনা ও ফ্লুতে ভুগছে মানুষ
- রোগী বাড়ায় ওয়ার্ড বাড়ানো হয়েছে মুগদা হাসপাতালে
- কোনো সিট ফাঁকা নেই ঢাকা মেডিকেলে
- মিটফোর্ডে রোগী বাড়ছে আশঙ্কাজনক হারে
- কুর্মিটোলায় জ¦র নিয়ে ভর্তি কয়েকশ রোগী
- বেসরকারি হাসপাতালেও পাওয়া যাচ্ছে না সিট
এ যেন ২০১৮ সালের পুনরাবৃত্তি। ওই বছর দেশজুড়ে মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ে ডেঙ্গু। একই সময়ে চিকুনগুনিয়া, ভাইরাল ফ্লুতেও আক্রান্ত হয়ে প্রতিদনই বাড়তে থাকে জ¦রের রোগী। বর্তমান সময়ে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা মহামারি পর্যায়ে না গেলেও রোগটিতে প্রতিদিনই ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণের পাশাপাশি চিকুনগুনিয়া, করোনা, ফ্লুসহ বিভিন্ন ধরনের জ¦রে দেশজুড়ে আক্রান্তের সংখ্যা ২০১৮ সালের জ¦রের মহামারি পরিস্থিতিই মনে করিয়ে দিচ্ছে।
রাজধানীসহ দেশের প্রায় সব এলাকায় বিভিন্ন ধরনের জ¦রে ভুগছে মানুষ। হাসপাতালগুলোতে গিজগিজ করছে জ¦রে আক্রান্ত রোগী। সরকারি হাসপাতালে তো বটেই, বেসরকারি হাসপাতালেও মিলছে না সিট। এমন পরিস্থিতিতে জ¦র আসার সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়ার কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
এডিসের লার্ভা ধ্বংসে দুই সিটির ব্যর্থতা, অতিবৃষ্টি-অতিগরমের মতো অনুকূল পরিবেশের কারণে চলতি বছরের জানুয়ারির শুরু থেকেই বাড়তে থাকে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা, যা বর্ষা শুরুর সঙ্গে আরও তীব্র হয়েছে। আগস্টের প্রথম ১২ দিনেই ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়ায় ৪ হাজারের বেশি। এর সঙ্গে রয়েছে চিকুনগুনিয়ার নতুন রূপে ফিরে আসা। পাশাপাশি মৌসুমজনিত ভাইরাল জ¦রের প্রকোপও। বিভিন্ন ধরনের এসব জ¦রের কারণে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
এদিকে জ¦রে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ায় রাজধানীসহ দেশের সব সরকারি হাসপাতালে বেড়েছে রোগীর চাপ। কয়েকটি হাসপাতালে রোগীর চাপ বেশি হওয়ায় বাড়াতে হয়েছে ওয়ার্ড। বিশেষ করে রাজধানীর ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল, মুগদা জেনারেল হাসপাতাল, স্যার সলিমুল্লাহ্ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল (মিটফোর্ড) ও কুর্মিটোলা হাসপাতালে হু হু করে বাড়ছে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ভর্তির সংখ্যা। অন্যদিকে বেশির ভাগ বেসরকারি হাসপাতালেও পাওয়া যাচ্ছে না সিট।
গত বৃহস্পতিবার মুগদা জেনারেল হাসপাতাল ঘুরে দেখা যায়, এখানে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি রয়েছে পাঁচজন। নতুন রোগী ভর্তি হয়েছে ১৫০ জন। একই সঙ্গে চিকুনগুনিয়া ও ভাইরাল জ¦রে আক্রান্ত হয়েও প্রতিদিন রোগী আসছে।
রোগীর চাপ বাড়ায় ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসায় আরেকটি ওয়ার্ড বাড়ানো হয়েছে জানিয়ে হাসপাতালের পরিচালক ডা. মো. মেজবাউর রহমান বলেন, ‘রোগী ভর্তির সংখ্যা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। জুন মাসে এখানে ১ হাজার ৮০০-এর বেশি রোগী ছিল। কিন্তু চলতি মাসের প্রথম চার দিনেই রোগীর সংখ্যা ৫০০-এর বেশি হয়ে গেছে। রোগী আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা করছি।’
ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বর্তমানে তিনটি ওয়ার্ডে ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। তৃতীয় তলায় নারী ওয়ার্ডে এবং ১০ তলায় পুরুষ ওয়ার্ডে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। শিশু ওয়ার্ডে ১২০ জনের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এ ছাড়া ১১ তলাও প্রস্তুত রয়েছে। জরুরি প্রয়োজনে সেখানেও রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হবে।’
হাসপাতালের পরিচালক বলেন, ‘আমাদের ওয়ার্ড বাড়ছে। তাই চিকিৎসকের সংকটও তৈরি হচ্ছে। ইতিমধ্যে এখানে কয়েকজন চিকিৎসক পদায়ন করা হয়েছে। রেশনিং করে ডাক্তার ও নার্সদের দ্বারা চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। আগে যাত্রাবাড়ী, কাজলা, ধলপুর ও এর আশপাশের কিছু নির্দিষ্ট এলাকা থেকে বেশি রোগী আসত। কিন্তু এখন সব এলাকা থেকেই রোগী আসছে। ঢাকার বাইরে থেকেও ৫ শতাংশ রোগী হাসপাতালে ভর্তি রয়েছে। সব দিক থেকেই আমরা প্রস্তুত রয়েছি।’
একই অবস্থা রাজধানীর স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেরও (মিটফোর্ড)। ডেঙ্গু জ¦রে আক্রান্ত হয়ে রাজধানীর গেন্ডারিয়া থেকে এখানে চিকিৎসা নিতে এসেছেন সফিকুর রহমান। মশার যন্ত্রণায় বাড়িতে দিনের বেলায় মশারি টানিয়েও শেষ রক্ষা হয়নি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘সিটি করপোরেশন থেকে নামকাওয়াস্তে মশা নিধন কার্যক্রম করা হয়। ফগার মেশিনে ওষুধ দেয়, নাকি খালি ধোঁয়া দেয় কে জানে! মশা তো মরে না। প্রথমে ছোট মেয়েটা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়। পরে ছেলেটা। এখন আমি। ওরা বাড়িতে থেকে সুস্থ হলেও আমার অবস্থা খারাপ হয়ে যাওয়ায় পরশু রাতে স্ত্রী হাসপাতালে নিয়ে এসেছে। এখন আগের চাইতে একটু ভালো আছি।’
ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীরা একেবারে শেষ সময়ে হাসপাতালে এবার বেশি আসছে জানিয়ে হাসপাতালের এক চিকিৎসক জানান, ‘সাধারণ জ¦র ভেবেই অনেকে ঘরে বসে থাকছে। যখন রক্তপাত শুরু হচ্ছে, তখনই হাসপাতালে আসছে। সেই সময় এলে চিকিৎসকদের বেশি কিছু করার থাকে না। অনেকের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলে।’ উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘যেমন একটা রোগী এলো সন্ধ্যা ৬টায়। রাত দেড়টার সময় তার মৃত্যু হলো। তাই আমরা আহ্বান জানাব, জ¦র হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ডেঙ্গুর পরীক্ষা করান। চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন।’
এদিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডেঙ্গু ওয়ার্ডগুলোতে একটি সিটও ফাঁকা নেই। এ অবস্থায় রোগী বাড়লে ওয়ার্ড বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানিয়েছেন হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান।
রূপালী বাংলাদেশকে তিনি বলেন, ‘আমাদের এখানে শুধু ডেঙ্গু রোগী নয়, সারা দেশের বিভিন্ন জটিল রোগী আসে। সম্প্রতি ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যাও বাড়ছে। আমরা সেবা দেওয়ার সাধ্যমতো চেষ্টা করছি। রোগী যদি আরও বাড়ে, তাহলে ওয়ার্ড বাড়ানোর পরিকল্পনা আমাদের রয়েছে।’
জ¦রে আক্রান্ত রোগী ভর্তির সংখ্যা বাড়ছে রাজধানীর কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালেও। হাসপাতালটিতে ডেঙ্গু রোগীর জন্য আলাদাভাবে তৈরি করা হয়েছে ডেঙ্গু কর্নার। জ¦র বা ডেঙ্গুর লক্ষণ নিয়ে যারা আসছে তাদের রাখা হচ্ছে এই কর্নারে। পুরুষ ও নারীদের পাশাপাশি শিশুদের জন্যও রয়েছে আলাদা বেড। ডেঙ্গু পরিস্থিতি মোকাবিলায় বেডের সংখ্যা বাড়ানোর পাশাপাশি ডেডিকেটেড টিম প্রস্তুত রয়েছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকেরা।
আগেই আশঙ্কা করা হয়েছিল, ভরা মৌসুমে এবার ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে এডিস মশার দৌরাত্ম্য। আক্রান্ত এবং মৃত্যুর সংখ্যাও ছাড়াতে পারে আগের সব রেকর্ড। তারই সংকেত মিলল গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ডেঙ্গুবিষয়ক সরকারের নিয়মিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে।
বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে ২৫ হাজার ৫৭৬ জন। এর মধ্যে ৫৮ দশমিক ৯ শতাংশ পুরুষ ও ৪১ দশমিক ১ শতাংশ নারী রয়েছে, যা এর আগে কখনো হয়নি। এই ধারাবাহিকতা চলতে থাকলে আগস্টের শেষ পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা অন্য যেকোনো সময়ের চাইতে বেশি হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন চিকিৎসকেরা।
ডেঙ্গুর প্রজননস্থল ধ্বংসে ব্যর্থতাকে দায়ী করছেন চিকিৎসকেরা। একই সঙ্গে আবহাওয়ার অনুকূল পরিবেশও সমানভাবে দায়ী উল্লেখ করে তারা বলছেন, এখনই এডিসের জীবাণুবাহী মশার প্রজননস্থল ধ্বংস না করতে পারলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।
এদিকে ডেঙ্গুর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে চিকুনগুনিয়ার রোগীও। চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা রফিকুজ্জামান ঢামেক হাসপাতালে সিট না পেয়ে রাজধানীর মগবাজারের একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হতে যান। কিন্তু এখানেও সিট-কেবিন ফাঁকা না পেয়ে মহাখালীর আরেকটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হন।
তিনি বলেন, ‘শরীরে তীব্র ব্যথা আর জ¦লুনির কারণে কোনোভাবেই বাড়িতে থাকতে পারছিলাম না। তাই হাসপাতালে ভর্তি হয়েছি। এখনো শরীরে ১০৩ জ¦র। সঙ্গে শরীরে ব্যথা আর জ¦লুনি।’
শ্যামলির আরেকটি বেসরকারি হাসপাতালে প্রায় চার ঘণ্টা অপেক্ষার পর শিশুসন্তান আফরানকে ভর্তি করাতে পেরেছেন জানিয়ে গোলাম মর্তুজা বলেন, ‘দুই বছরের বাচ্চা। ১০৪ জ¦র। বাসায় রাখার সাহস পাইনি। প্রথমে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু সেখানে শিশু ওয়ার্ডে কোনো সিট ফাঁকা নেই। বাচ্চাকে তো আর মেঝেতে রাখতে পারি না। তাই এখানে নিয়ে আসি। কিন্তু এখানেও চার ঘণ্টা অপেক্ষার পর একটি কেবিন পেলাম।’
এবার বেসরকারি হাসপাতালেও এত রোগী কেন জানতে চাইলে রাজধানীর মহাখালীর ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. আশীষ চক্রবর্তী রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, বিভিন্ন রকমের জ¦রের প্রকোপ একই সময়ে হওয়ায় রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। পাশাপাশি ঘরে একজন আক্রান্ত হলে পরে পুরো পরিবারই আক্রান্ত হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, ‘সরকারি হাসপাতালগুলোর শয্যার সীমাবদ্ধতা রয়েছে, এটা আমরা সবাই জানি। তার পরও তারা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন সুচিকিৎসা দেওয়ার। আমরাও তাই করছি। রোগীর সুস্থতাই আমাদের অগ্রাধিকার।’
চলতি বছরের শুরু থেকেই সারা দেশে ডেঙ্গু রোগীর প্রকোপের বিষয়ে ঢামেকের মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসক ডা. সালেহ মাহমুদ তুষার রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘উষ্ণ-আর্দ্র আবহাওয়া বাংলাদেশ মশা ও মশাবাহিত রোগ বিস্তারের জন্য উত্তম জায়গা। উপযুক্ত তাপমাত্রা, আর্দ্রতার সঙ্গে যোগ হয়েছে অপরিকল্পিত নগরায়ণ। বছরের শুরু থেকে ডেঙ্গুর চোখরাঙানি আরও আতঙ্কিত করে তুলেছে নগরবাসীকে। এমন পরিস্থিতিতে আর নির্দিষ্ট সময় নয়, বরং সারা বছর এডিস মশা নিধনে অভিযান পরিচালনা করতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘ডেঙ্গুর মতোই মশাবাহিত চিকুনগুনিয়া রোগটিও সম্প্রতি প্রাণঘাতী হয়ে উঠছে। এডিস মশবাহিত এই রোগে জ¦র-পরবর্তী সময়ে গিঁটের ব্যথায় ভুগতে হচ্ছে রোগীদের। ফলে সহজেই কাবু হয়ে যাচ্ছে রোগীরা। ২০০৫ সালে বিশ্বের নানা দেশে আতঙ্কের কারণ হয়ে উঠেছিল ডেঙ্গুর তুলনায় উপেক্ষিত এই চিকুনগুনিয়া রোগ। কিন্তু এর চিকিৎসায় কমতি থেকে গেছে বিস্তর। তাই আবারও মাথাচাড়া দিয়েছে ভাইরাসটি। ভাইরাসটি আবার নতুন রূপে ফিরে এসেছে বলে সতর্ক করেছে খোদ বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থাও। আর ভাইরাল ফ্লু তো রয়েছেই। সব মিলিয়ে পরিস্থিতিটা আসলেই খারাপ। সাধারণ মানুষের সচেতনতার পাশাপাশি এডিস মশার প্রজননস্থল ধ্বংস না করতে পারলে আগস্টের শেষ দিকে কী হবে কিছুই বলা যাচ্ছে না। কারণ ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া দুটিই এডিস মশার কামড়ে হয়। তাই সরকারের পক্ষ থেকে এই দিকটিতে বিশেষ নজর দিতে হবে বলে আমি মনে করি।’
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন