ঢাকা শুক্রবার, ২৯ আগস্ট, ২০২৫

নির্বাচনি রোডম্যাপ - বিএনপিসহ স্বাগত জানাল সবাই, আছে কিছু শর্তও

মাইদুর রুবেল ও এফ এ শাহেদ
প্রকাশিত: আগস্ট ২৮, ২০২৫, ১০:৫৫ পিএম
নির্বাচনি রোডম্যাপ

নির্বাচন কমিশনের বহুল প্রত্যাশিত নির্বাচনি রোডম্যাপ ঘোষণার পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে প্রায় সব রাজনৈতিক দল। বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), গণসংহতি আন্দোলন, এবি পার্টিসহ আরও কিছু দল রোডম্যাপকে স্বাগত জানালেও অনেকে যুক্ত করেছে কিছু শর্ত। 

রোডম্যাপকে স্বাগত জানিয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের বলেন, রোডম্যাপ ঘোষণায় আমরা খুবই খুশি। মানুষ এই অনিশ্চয়তা থেকে বের হয়ে আসার জন্য ভীষণভাবে নির্বাচনটা চাইছে। পানের দোকানদার থেকে শুরু করে শিল্পোদ্যোক্তা পর্যন্ত সবাই নির্বাচন চাইছে। দেশের সমস্যা সমাধানে নির্বাচনের বিকল্প নেই। 

যারা নির্বাচনে বাধা দেওয়া কিংবা বর্জনের সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, তাদের উদ্দেশে বিএনপি মহাসচিব বলেন, যারা হটকারী সিদ্ধান্ত নেবে, তারা নিজেরাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এবারের নির্বাচন হবে অবাধ ও সুষ্ঠু। গণতান্ত্রিক দল হিসেবে বিএনপি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে আগেও সহযোগিতা করেছে, সামনেও সব ধরনের সহায়তা করবে বলেও আশ্বস্ত করেন দলটির মহাসচিব।

দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, মানুষ এখন নির্বাচনমুখী। পুরো জাতি ভোটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। নির্বাচন হলে দেশের অর্থনীতিতে বড় একটা পরিবর্তন আসবে। এখন রাজনীতির সময় শেষ হয়ে গেছে, জাতি গঠনের সময় এসেছে। তবে নির্বাচনের জন্য সব অংশীজনকে প্রস্তুতি নিতে হবে। রাজনীতিতে সব দলের জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। যে দল জনআকাক্সক্ষা ধারণ করতে ব্যর্থ হবে, তারাই আগামীতে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়বে। তিনি আরও বলেন, জনগণ জবাবদিহিমূলক একটি সরকার চায়। ভোটের পর অর্থনীতির পাশাপাশি দক্ষতা উন্নয়ন সবচেয়ে বড় লক্ষ্য হবে। ১৮ মাসে ১ কোটি মানুষকে চাকরি দেওয়ার প্রস্তুতি রয়েছে বিএনপির।

জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের বলেন, নির্বাচন কমিশনের (ইসি) জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ দেওয়া একটি রুটিন ওয়ার্ক। তবে সংস্কারের বিষয় বিবেচনা করলে আরও উত্তম হতো। সেই সঙ্গে সংলাপের বিষয়ে তিনি বলেন, দেশের রাজনীতি নির্বাচন ও সংস্কার নিয়ে হবে। কেউ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে, কেউ করবে না, তাহলে দেশে আবারও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতে পারে। ইসিকে পিআর পদ্ধতি ঠিক করে রোডম্যাপ ঘোষণার দাবিও জানান তিনি।

একই সঙ্গে, নির্বাচন কমিশনের রোডম্যাপের নানা দিকের কথা ও জুলাই আন্দোলনের প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন। পাশাপাশি আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন পিআর পদ্ধতির দাবি জানান। ডা. তাহের বলেন, আজকের এই অন্তর্বর্তী সরকার আছে, এটা তো সংবিধানে লেখা ছিল না। সরকারকে যেভাবে মেনে নেওয়া হয়েছে, সেভাবে সংস্কারের বিষয়টি দেখতে হবে। 

এদিকে রোডম্যাপ নিয়ে তাৎক্ষণিক এক প্রতিক্রিয়ায় জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) বলেছে, জুলাই সনদের আগে রোডম্যাপ ঘোষণা প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের শামিল; জুলাই গণঅভ্যুত্থানে হাজারো শহিদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে জনগণের প্রত্যাশা ছিল বিচার ও সংস্কার। সেই লক্ষ্যে সরকার বিভিন্ন সংস্কার কমিশন গঠন করে, যেখানে অন্যান্য রাজনৈতিক দলের মতো জাতীয় নাগরিক পার্টিও নিজেদের মতামত তুলে ধরে।

এই সংস্কার কার্যক্রম চূড়ান্ত করার লক্ষ্যে ঐকমত্য কমিশন প্রণীত জুলাই সনদের খসড়া কিছুদিন আগে আমাদের কাছে এসে পৌঁছায় এবং এ বিষয়ে আমরা আমাদের মতামত তুলে ধরে তা কমিশনের কাছে জমা দিয়েছি। যদিও, জুলাই সনদের খসড়ায় সনদ বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া সম্পর্কে পরিষ্কার কোনো রোডম্যাপ না থাকা আমাদের হতাশ করেছে। জুলাই সনদ চূড়ান্ত না করে এবং জুলাই সনদ বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ততে উপনীত না হয়ে নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা ঐকমত্য কমিশন ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের শামিল। আমরা মনে করি, ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা থেকে রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তরের জন্য নির্বাচন আয়োজন প্রয়োজন। আমরা কোনোভাবেই নির্বাচনবিরোধী নই। সেদিক থেকে রোডম্যাপ ঘোষণা ইতিবাচক। তবে, যত দ্রুত জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি হবে, তত দ্রুত নির্বাচনের দিকে যাওয়া যাবে। সনদ বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া চূড়ান্ত না করে নির্বাচনের প্রস্তুতি গ্রহণ ভবিষ্যতে সংকট তৈরি করতে পারে, যার দায় সরকারকেই নিতে হবে।

এদিকে রোডম্যাপ নিয়ে তাৎক্ষণিক এক প্রতিক্রিয়ায় জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার বলেন, নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের বিষয় এই রোডম্যাপে আসেনি। সংস্কারের বিষয়ে সুরাহা হওয়ার আগে এই রোডম্যাপ দেশকে নির্বাচনের প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যাবে, সংস্কারের বিষয়টা অনিশ্চয়তায় পড়বে। জুলাই সনদের পর নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষিত হলে তা গ্রহণযোগ্যতা পেত।

নির্বাচন কমিশন ঘোষিত রোডম্যাপকে স্বাগত জানিয়ে গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেছেন, ‘বিচার, সংস্কার ও নির্বাচন এই মুহূর্তে আমাদের প্রধান জাতীয় স্বার্থ। নির্বাচন কমিশনের ঘোষিত রোডম্যাপ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নির্বাচন রোডম্যাপেরই আনুষ্ঠানিক ঘোষণা। আমরা এই রোডম্যাপ ঘোষণাকে স্বাগত জানাই। নির্বাচন বানচাল হওয়ার বা নির্বাচনের পরিবেশ নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনাকে গুরুত্ব না দিয়ে বরং এ ধরনের আশঙ্কার জায়গা তৈরির কোনো সুযোগ যাতে সৃষ্টি না হয়, সে ব্যাপারে নির্বাচনের সঙ্গে যুক্ত সব অংশীজনকে ভূমিকা নিতে হবে। 

তিনি আরও বলেন, নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া এগিয়ে নেওয়ার জন্য অনেক বড় দায়িত্ব রাজনৈতিক দলগুলোর। তা না হলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে রাজনৈতিক দলগুলোই। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নির্বাচনের পরিবেশ ঠিক রাখার দায়িত্ব মনিটরিং করার জন্য আন্দোলনকারী সব রাজনৈতিক দল থেকে প্রতিনিধি নিয়ে একটা কমিটি করা দরকার। একই সঙ্গে যত দ্রুত সম্ভব সবার অংশগ্রহণে নির্বাচনের পরিবেশসংক্রান্ত একটা আচরণবিধি তৈরি করা দরকার। দেশের যেকোনো স্থানে যেকোনো সমস্যা হলে বা নির্বাচনি আচরণবিধি ভঙ্গ হলে, তা মীমাংসার ক্ষেত্রে এই কমিটি ভূমিকা রাখবে।

রোডম্যাপ ঘোষণাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছে আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টি। সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণ, ভোটার তালিকা চূড়ান্তকরণ, রাজনৈতিক দল নিবন্ধন ও দেশীয় পর্যবেক্ষক সংস্থার নিবন্ধন চূড়ান্ত করাসহ ২৪টি গুরুত্বপূর্ণ কার্যাবলিকে প্রাধান্য দিয়ে উপস্থাপিত রোডম্যাপ সম্পর্কে এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, আমরা আশা করেছিলাম কমিশন নির্বাচনি রোডম্যাপ ঘোষণার আগে রাজনৈতিক দল ও অংশীজনদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে একটা মতবিনিময় করবেন।

সরকার ও নির্বাচন কমিশন নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যপারে দৃঢ় অবস্থান প্রকাশ করলেও জনমনে নির্বাচন নিয়ে একটা সংশয় লক্ষ করা যাচ্ছে; এর প্রধান কারণ জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে অনিশ্চয়তা। প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যাপারে আস্থাশীল পরিবেশ সৃষ্টি করতে না পারলে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করা কঠিন হতে পারে বলেও মনে করেন তারা।