ঢাকা শুক্রবার, ২৯ আগস্ট, ২০২৫

সীমান্ত হত্যায় বিএসএফ ডিজির  ব্যাখ্যায় দ্বিমত বিজিবি ডিজির, বিজিবি-বিএসএফ যৌথ সংবাদ সম্মেলন

রূপালী প্রতিবেদক
প্রকাশিত: আগস্ট ২৮, ২০২৫, ১১:০০ পিএম
সীমান্ত

বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে বিএসএফ সদস্যরা কোন পরিস্থিতিতে গুলি ছোড়ার পথ বেছে নিচ্ছে, তার একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের মহাপরিচালক (ডিজি) দালজিৎ সিং চৌধুরী, যার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছেন বিজিবির মহাপরিচালক আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী।

বিএসএফ ডিজি দালজিৎ সিং বলেছেন, সীমান্তে বিএসএফ সদস্যরা ‘অনুপ্রবেশকারীদের ধারালো অস্ত্রের আক্রমণের’ শিকার হচ্ছেন। ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতিতে ‘শেষ পদক্ষেপ’ হিসেবে গুলি ছোড়ার মতো প্রক্রিয়াকে বেছে নিচ্ছেন তারা।

কিন্তু সম্প্রতি অনেকটা প্রকাশ্য দিবালোকে সীমান্তে একজন অপ্রাপ্তবয়স্ককে গুলি করে হত্যা করেছে বিএসএফ। এর ব্যাখ্যা কী হতে পারে, সেই প্রশ্ন তুলেছেন আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী। 

বিজিবি-বিএসএফ মহাপরিচালক পর্যায়ের ৫৬তম সীমান্ত সম্মেলনের শেষ দিনে পিলখানায় বিজিবি সদর দপ্তরের আয়োজিত যৌথ সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে দুই মহাপরিচালক যার যার অবস্থান তুলে ধরেন।

গত ২৫ আগস্ট শুরু হওয়া চার দিনের এই সম্মেলনে সীমান্ত হত্যা বন্ধ, ভারত কর্তৃক পুশ ইন, সীমান্তে মাদক, জাল মুদ্রাসহ অন্যান্য চোরাচালান বন্ধ এবং দ্বিপক্ষীয় নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা হয় বলে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়।

এক প্রশ্নের জবাবে বিএসএফ ডিজি দাবি করেন, সীমান্তে পুশ ইন করা হচ্ছে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করেই। শুধু যারা অবৈধভাবে ভারতে বসবাস করছেন, তাদেরই নিয়ম মেনে বাংলাদেশে পাঠানো হচ্ছে। এখন পর্যন্ত ৫৫০ জনকে বিজিবির হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে এবং আরও ২ হাজার ৪০০ কেস যাচাই-বাছাইয়ে রয়েছে। যেসব ক্ষেত্রে বিজিবি পরিচয়পত্র যাচাই করতে পারেনি, তাদের প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থার মাধ্যমে নির্বাসনের জন্য ভারতীয় সংস্থাগুলোর কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। আমরা বিজিবিকে অনুরোধ করেছি, তারা যেন বিষয়টির নিশ্চিতকরণ দ্রুত সম্পন্ন করে। যদি ভারতীয় নাগরিক বা বাংলাদেশি নাগরিকদের দ্বারা সীমান্ত লঙ্ঘনের কোনো ঘটনা ঘটে, তাহলে উভয় দেশের মধ্যে নাগরিকদের একে অপরের কাছে ফেরত পাঠানো বা হস্তান্তরের জন্য একটি সুপ্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থা রয়েছে। উভয় বাহিনীই সমস্যা সমাধানের জন্য এই ব্যবস্থা অনুসরণ করে। 

কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভারতীয় নাগরিককেও বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে শুধু বাংলাভাষী হওয়ার কারণে। কিছু রোহিঙ্গাকেও বাংলাদেশে পুশ ইন করা হয়েছে, এগুলো কতখানি বৈধ জানতে চাইলে বিএসএফ মহাপরিচালক বলেন, আইনের মধ্য থেকে ‘যথাযথ চ্যানেলে’ পুশ ইন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হচ্ছে।

সম্প্রতি একজন ভারতীয় নাগরিকের মেয়েকে বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়ার তথ্য জানানো হলে বিএসএফ মহাপরিচালক বলেন, যদি এমন কোনো ঘটনা ঘটে থাকে, যথাযথ প্রক্রিয়ায় জানানো হলে ভারত তাদের গ্রহণ করবে।

শুধু ধর্মীয় বা ভাষাগত কারণেই কি ভারতীয় নাগরিকদের বাংলাদেশে পুশ ইন করা হচ্ছে? এ প্রশ্নে বিএসএফ ডিজি বলেন, সীমান্ত আইন লঙ্ঘনজনিত অপরাধের ক্ষেত্রে আমাদের দুই দেশের মধ্যে প্রত্যাবর্তনের (ডিপোর্টেশন) ওয়েল এস্টাবলিস্ট বৈধ চ্যানেল রয়েছে। যার মাধ্যমে এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হচ্ছে। এদের মধ্যে যদি কেউ ভারতীয় নাগরিক হয়ে থাকেন, তাহলে তাকে তাৎক্ষণিক গ্রহণ করা হবে।

সীমান্তে হত্যা বন্ধ করা নিয়ে প্রশ্নের জবাবে বিএসএফ ডিজি বলেন, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে ৩৫ জন বিএসএফ সদস্য গুরুতর আহত হয়েছেন অনুপ্রবেশকারীদের ধারালো অস্ত্রের হামলায়। সীমান্ত এলাকায় বিএসএফ সদস্যরা প্রথমে সতর্ক করে, বাধা দেয়। শেষ পদক্ষেপ হিসেবে গুলি ছোড়া হয়। ভারত সরকার সীমান্তে এ ধরনের দুর্ঘটনা বন্ধ করার জন্য বেড়া, বন্যা-আলো, ইলেকট্রনিক নজরদারিব্যবস্থা স্থাপনে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করেছে, যা দুর্ভাগ্যজনক ঘটনার দিকে পরিচালিত করে। 

তার এমন বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে বিজিবি মহাপরিচালক বলেন, সম্প্রতি একজন অল্প বয়সি বাংলাদেশি নাগরিককে প্রকাশ্য দিবালোকে গুলি করে হত্যা করেছে বিএসএফ। ওই শিশুটি সীমান্ত নিরাপত্তার জন্য কতটুকু ঝুঁকিপূর্ণ ছিলÑসেই প্রশ্ন ছুড়ে দেন বিজিবির ডিজি।

সীমান্ত হত্যা বন্ধের বিষয়ে বৈঠকে বিজিবি ও বিএসএফ কী ধরনের সিদ্ধান্তে উপনীত হলো জানতে চাইলে বিজিবি মহাপরিচালক বলেন, আমরা সীমান্ত হত্যার বিষয়ে উদ্বেগ উত্থাপন করেছি। এটি ছিল সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া অগ্রাধিকারমূলক এজেন্ডার বিষয়গুলোর মধ্যে একটি। বিএসএফের মহাপরিচালক বলেছেন, বিএসএফ শুধু আত্মরক্ষার জন্য গুলি চালায়। কিন্তু আমরা এটিকে চ্যালেঞ্জ করেছি। যাই হোক, শেষ পর্যন্ত উভয় পক্ষই সম্মত হয়েছে যে ইচ্ছাকৃতভাবে বা অনিচ্ছাকৃতভাবে যাতে কোনো ক্রসিং না ঘটে এবং আমরা চেষ্টা করি, যাতে কোনো প্রাণহানি না হয়। আমরা অপেক্ষা করছি এবং মাঠ পর্যায়ে সেগুলো বাস্তবায়নের চেষ্টা করব এবং আমরা বিএসএফ কর্তৃপক্ষের কাছেও একই অনুরোধ করেছি। এ বিষয়ে এবারের সীমান্ত সম্মেলনে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা হয়েছে। 

উভয় পক্ষ যৌথভাবে সচেতনতামূলক কর্মসূচি গ্রহণ, ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নমূলক কর্মসূচি গ্রহণ, সীমান্তের অলঙ্ঘনীয়তা সম্পর্কে প্রেষণা প্রদান এবং অপরাধীদের আন্তর্জাতিক সীমান্ত অতিক্রম প্রতিরোধের মাধ্যমে এ ধরনের আক্রমণ, নির্যাতন ও হামলার ঘটনা শূন্যে নামিয়ে আনার বিষয়ে সম্মত হয়েছে বলে আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী জানান।

সাম্প্রতিক সময়ে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে নি¤œমুখী প্রবণতা দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য বিজিবি এবং বিএসএফের মধ্যে সমন্বয় উন্নত করার ক্ষেত্রে কী করা যেতে পারে? এর উত্তরে বিজিবি ডিজি বলেন, বেশির ভাগই সীমান্তবর্তী এলাকা এবং বিভিন্ন মন্ত্রণালয় থেকে প্রাপ্ত এজেন্ডা পয়েন্টগুলোর সঙ্গে সম্পর্কিত। তবে এজেন্ডা পয়েন্টগুলো সীমান্তের সঙ্গে সম্পর্কিত হোক বা না হোক অথবা নদী বণ্টনের সঙ্গে সম্পর্কিত হোক। পানি বণ্টন, সীমান্ত হত্যা বা সীমান্তে বেড়া থাকা উচিত কি নাÑ এসব বিষয় অবশেষে যদি স্থলভাগে সমাধান করা হয়, তবে এগুলো দুই দেশের সাথে সম্পর্ক উন্নত করতে ব্যাপক অবদান রাখবে। তাই আমাদের মনোযোগÑ এই উপাদানগুলোর ওপর, এই এজেন্ডা পয়েন্টগুলোর ওপর। আমরা চেষ্টা করছি, উভয় পক্ষের জন্য একটি উন্নত এবং নিরাপদ সীমান্ত তৈরি করা হোক। যাতে শেষ পর্যন্ত সীমান্তে কোনো উত্তেজনা তৈরি না হয়। 

সর্বশেষ বিজিবির ডিজির কাছে সম্মেলনের ফলাফল কী, জানতে চাওয়া হয়। উত্তরে বিজিবি ডিজি বলেন, সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার ছিল সীমান্ত হত্যা, তারপর চোরাচালান প্রতিরোধ, বেশির ভাগই মাদক চোরাচালান, অস্ত্র চোরাচালান, অবৈধ অস্ত্র ভেতরে আসা, মানব পাচার এবং একশ পঞ্চাশ গজের মধ্যে অবৈধ নির্মাণ। আর বিএসএফের পক্ষ থেকে চোরাকারবারি এবং অপরাধীদের ভারতীয় ভূখ-ে প্রবেশ বন্ধ করা, প্রতিরক্ষার কোনো সম্ভাবনা নেইÑ এমন উন্নয়ন প্রকল্প বিজিবি কর্তৃক বন্ধ করা, তারপর জাল ভারতীয় মুদ্রার নোট বন্ধ করা এবং জরিপ ও পানি বণ্টন সম্পর্কিত বিষয়গুলো নিয়েও আলোচনা হয়েছিল। 

সম্মেলনে বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকীর নেতৃত্বে ২১ সদস্যের বাংলাদেশ প্রতিনিধিদল অংশগ্রহণ করে।

বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলে বিজিবির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ছাড়াও প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়, সড়ক বিভাগ, ভূমি জরিপ অধিদপ্তর, যৌথ নদী কমিশন এবং মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারাও প্রতিনিধিত্ব করেন। অপরদিকে, বিএসএফ মহাপরিচালক শ্রী দালজিৎ সিং চৌধুরী, আইপিএসের নেতৃত্বে ১১ সদস্যের ভারতীয় প্রতিনিধিদল সম্মেলনে অংশগ্রহণ করে। ভারতীয় প্রতিনিধিদলে বিএসএফের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ছাড়াও ভারতের স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং ঢাকাস্থ ভারতীয় হাইকমিশনের কর্মকর্তারাও অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।