রাজধানী বেইজিংয়ের তিয়ানআনমেন স্কয়ারে চীনের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় সামরিক কুচকাওয়াজে নতুন অস্ত্রের প্রদর্শনী করে উপস্থিত ৫০ হাজারেরও বেশি দর্শকের উদ্দেশ্যে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বিশ^কে সতর্ক করে বলেছেন, ‘শান্তি বা যুদ্ধ, বিশে^র সামনে এখন এই দুইয়ের মধ্যে একটি বেছে নেওয়ার সময়’।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন ও উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট কিম জং উনসহ দুই ডজনেরও বেশি বিশ^নেতা এ সময় প্রেসিডেন্ট শি’র পাশে দাঁড়িয়ে সাক্ষী থেকেছেন সামরিক সক্ষমতা এবং বিশ^ব্যাপী প্রভাব বিস্তারে চীনের অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠার নতুন ইতিহাসের।
বিশ্বনেতাদের উপস্থিতিতে তিয়ানআনমেন স্কয়ার যেন সামরিক শক্তি প্রদর্শনের এক মহামঞ্চে পরিণত হয়েছিল। কুচকাওয়াজে প্রদর্শিত হয় চীনের আধুনিকতম যুদ্ধাস্ত্র, ট্যাংক, ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ও স্টেলথ ফাইটার জেট ও ড্রোনের সর্বাধুনিক সংস্করণ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের আনুষ্ঠানিক আত্মসমর্পণের দিনটি গতকাল বুধবার সাড়ম্বরে উদ্যাপন করেছে চীন। দিনটি ঘিরে রাজধানী বেইজিংয়ে বিশাল সামরিক কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হয়। ঐতিহাসিক এই কুচকাওয়াজ উপলক্ষে এবার প্রথমবারের মতো চীন, রাশিয়া ও উত্তর কোরিয়ার তিন রাষ্ট্রনেতা একসঙ্গে হয়েছেন। কুচকাওয়াজ চলাকালে পাশাপাশি বসেছিলেন শি ও কিম। এ সময় তাঁদের দুজনকে আলাপ করতেও দেখা গেছে। চীনের প্রেসিডেন্ট সামরিক কুচকাওয়াজে সভাপতিত্ব করেন। যুদ্ধবিমান, ক্ষেপণাস্ত্র এবং সমন্বিত শৃঙ্খলাপূর্ণ সৈন্যদলের মার্চপাস্ট প্রদর্শন করা হয় কুচকাওয়াজে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসানের ৮০তম বার্ষিকী উপলক্ষে ৮০ বার কামানের গোলা ছোড়া হয়। সেনারা চীনের জাতীয় পতাকা হাতে তিয়েনআনমেন স্কয়ারের লাল কার্পেটের ওপর দিয়ে কুচকাওয়াজ করেন। জাতীয় সংগীত চলাকালে দর্শকেরা ছোট পতাকা নেড়ে অভিবাদন জানান। পতাকা উত্তোলনের পর আকাশে ৮০ হাজার কবুতর ও ৮০ হাজার বেলুন ছেড়ে দেওয়া হয়। ৭০ মিনিটের এ প্রদর্শনীতে হেলিকপ্টার থেকে ব্যানার নামানো, সুশৃঙ্খলভাবে যুদ্ধবিমানের উড়ে যাওয়াও ছিল।
বর্তমান কমিউনিস্ট পার্টিকে বিপ্লবী অতীতের সঙ্গে যুক্ত করতে অনুষ্ঠানজুড়ে ছিল নানা প্রতীকী আয়োজন। প্রেসিডেন্ট শি ওই অনুষ্ঠানে মাও স্টাইলের পোশাক পরে হাজির হন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন বর্তমান ও সাবেক শীর্ষ চীনা নেতারা। পরে তিনি চীনে তৈরি ‘রেড ফ্ল্যাগ’ লিমুজিনের খোলা সানরুফে দাঁড়ান। এটিও মাও আমলের স্মৃতি বহন করে এবং চীনের শিল্প স্বনির্ভরতার উচ্চাকাক্সক্ষা প্রকাশ করে।
প্রেসিডেন্ট শি কুচকাওয়াজ পরিদর্শনের সময় চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মির সেনাদের বলেন, ‘কমরেডরা, শুভেচ্ছা! কমরেডরা, তোমরা কঠোর পরিশ্রম করছ!’। সেনারা যখন শি’র গাড়ির পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন, তাঁরা একসঙ্গে মাথা ঘুরিয়ে তাকে স্যালুট জানান এবং স্লোগান দেন, ‘দলকে অনুসরণ করো! জয়ের জন্য লড়ো’। যুদ্ধপ্রস্তুতি প্রদর্শন করতে বন্দুক হাতে সেনারা দৌড়ে ট্যাংক ও মিসাইলবাহী যানগুলোর পাশ দিয়ে দ্রুত তাঁদের যানবাহনে ওঠেন।
কুচকাওয়াজ পরিদর্শনের জন্য বেইজিংয়ে আমন্ত্রিত ২৬ জন রাষ্ট্রনেতার নামের একটি তালিকা প্রকাশ করেছে চীনের স্টেট কাউন্সিল। তাঁদের মধ্যে আছেন ভিয়েতনামের প্রেসিডেন্ট লুয়ং কুয়ং, বেলারুশের প্রেসিডেন্ট আলেকজান্ডার লুকাশেঙ্কো, ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান, জিম্বাবুয়ের প্রেসিডেন্ট এমারসন মনানগাগওয়া, সার্বিয়ার প্রেসিডেন্ট আলেক্সান্দার ভুচিচ, কিউবার প্রেসিডেন্ট মিগুয়েল দিয়াজ ক্যানেল।
তালিকায় আরও আছে মিয়ানমারের ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট মিন অং হ্লাইং, মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ, স্লোভাকিয়ার প্রধানমন্ত্রী রবার্ট ফিকো প্রমুখ রাষ্ট্রনেতার নাম। তবে আমন্ত্রিত ব্যক্তিদের সবাই বেইজিংয়ে গেছেন কি না, সেটা নিশ্চিত করতে পারেনি বিবিসি।
চীনা এক মহান জাতি: শি
তিয়েনআনমেন গেটের কুচকাওয়াজের মূল মঞ্চ গেট অব হেভেনলি পিস থেকে প্রেসিডেন্ট শি ঘোষণা করেন, চীনা জাতি এক মহান জাতি। এই জাতি কোনো অত্যাচারকে ভয় পায় না এবং নিজের শক্তিতে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে থাকে। তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ত্যাগ-তিতিক্ষা এবং আজকের চীনের চ্যালেঞ্জের মধ্যে সরাসরি যোগসূত্র টানেন।
তিনি বলেন, অতীতে ন্যায় ও অন্যায়, আলো ও অন্ধকার, অগ্রগতি ও পশ্চাৎপদতার লড়াইয়ে জীবন বাজি ধরে চীনা জনগণ ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিরোধ গড়েছে। আজও আমরা শান্তি, সংলাপ ও অগ্রগতির পক্ষে অবস্থান নেব।
শি তার ভাষণে জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও ভূখ-ের অখ-তা রক্ষা করতে প্রতিশ্রুতি দেন এবং বলেন, ‘চীনা মুক্তি সেনা সব সময়ই এক নায়কসুলভ শক্তি, যার ওপর দল ও জনগণ পুরোপুরি নির্ভর করতে পারে’।
প্রায় ১০ হাজার সেনার সামনে তিনি আরও বলেন, ‘মানবজাতি আজ দাঁড়িয়ে আছে এক সংকটময় মোড়ে। চীন বিশ্বের মানুষের সঙ্গে মিলে অভিন্ন ভবিষ্যৎ গড়ে তুলবে।’
ইতিহাসের সঠিক পাশে চীনের জনগণ অটল-অবিচল থাকবে, ভাষণে বলেন চীনা কমিউনিস্ট পার্টির এ শীর্ষনেতা। তিনি বলেন, তার দেশ ‘অদম্য’ এবং কখনোই ‘কোনো হুমকির কাছে মাথানত করবে না’।
নতুন অস্ত্র সামনে আনল চীন
কুচকাওয়াজ উপলক্ষে চীন প্রথমবারের মতো এমন পারমাণবিক সক্ষমতার ক্ষেপণাস্ত্র প্রদর্শন করেছে, যা সমুদ্র, স্থল ও আকাশÑ এই তিনটি মাধ্যম থেকে উৎক্ষেপণ করা যায়। দেশটি এটিকে ‘ট্রায়াড’ সক্ষমতা হিসেবে উল্লেখ করেছে। এতে রয়েছে দীর্ঘ পাল্লার বিমানভিত্তিক ক্ষেপণাস্ত্র জিংলেই-১, সাবমেরিন থেকে উৎক্ষেপণযোগ্য আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র জুলাং-৩ এবং স্থলভিত্তিক আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র ডংফেং-৬১ (ডিএফ-৬১) ও ডংফেং-৩১। কুচকাওয়াজে জাহাজ বিধ্বংসী হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রেরও প্রদর্শনী করা হয়েছে। চীন পূর্বে নকল মার্কিন বিমানবাহী নৌযানকে লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে এই ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা করেছে।
এর মধ্যে রয়েছে ইয়িংজি-১৯, ইয়িংজি-১৭ এবং ইয়িংজি-২০। অন্যান্য প্রদর্শিত ক্ষেপণাস্ত্রের মধ্যে রয়েছে-ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র চাংজিয়ান-২০এ, ইয়িংজি-১৮শি, চাংজিয়ান-১০০০ এবং আরও কিছু হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র ইয়িংজি-২১, ডংফেং-১৭ এবং ডংফেং-২৬ডি। ড্রোন হামলার বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষার জন্য লেজার অস্ত্র আপগ্রেড করছে চীন। কুচকাওয়াজে প্রদর্শিত ড্রোনবিরোধী সিস্টেমের মধ্যে ছিল ক্ষেপণাস্ত্র গান, উচ্চশক্তির লেজার অস্ত্র এবং উচ্চশক্তির মাইক্রোওয়েভ অস্ত্র। চীন এমন ড্রোন প্রদর্শন করেছে যা পানির নিচে এবং আকাশেÑ উভয় জায়গায় ব্যবহার করা সম্ভব। এর মধ্যে রয়েছে, অনুসন্ধান এবং লক্ষ্যবস্তুকে আঘাতের জন্য ব্যবহৃত ড্রোন। এতে জাহাজ থেকে চলাচলের জন্য ডিজাইন করা মনুষ্যবিহীন হেলিকপ্টারও ছিল। সমুদ্রভিত্তিক সিস্টেমের মধ্যে ছিলÑ সাবমেরিন, স্থলে ব্যবহারযোগ্য জাহাজ এবং একটি মাইন-লেইং সিস্টেম।
চীন-রাশিয়া-উত্তর কোরিয়া ষড়যন্ত্র করছে: ট্রাম্প
চীন, রাশিয়া ও উত্তর কোরিয়া যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে বলে অভিযোগ তুলেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। বেইজিংয়ে তিন পারমাণবিক শক্তিধর দেশের নেতা যখন একটি বিশাল সামরিক কুচকাওয়াজে যোগ দিচ্ছিলেন, তখন ট্রাম্পের এমন অভিযোগ এলো।
গত মঙ্গলবার রাতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট শি’কে উদ্দেশ করে নিজের ট্রুথ সোশ্যালে লিখেছেন, ‘ভøাদিমির পুতিন এবং কিম জং উনকে আমার উষ্ণ শুভেচ্ছা জানাই, কারণ আপনারা আমেরিকার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন।’
গত মঙ্গলবার এক রেডিও সাক্ষাৎকারে ট্রাম্প দাবি করেন, যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক শক্তি বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী এবং কেউ তাদের বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপ নেওয়ার কথা ভাবতেও সাহস করবে না। এটি হবে তাদের জীবনের সবচেয়ে ভয়াবহ ভুল।
চীন ও রাশিয়ার ক্রমবর্ধমান ঘনিষ্ঠতা নিয়ে যখন বিশ্বজুড়ে আলোচনা চলছে, তখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জানিয়েছেন, এ জোট যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কোনো হুমকি নয়। তিনি দাবি করেছেন, চীনের যুক্তরাষ্ট্রকে প্রয়োজন তার চেয়ে অনেক বেশি, যতটা যুক্তরাষ্ট্রের চীনকে প্রয়োজন।
বিশ্লেষকরা যা বলছেন
ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের জন এল থর্নটন চায়না সেন্টারের পরিচালক রায়ান হাস বলেছেন, শি জিন পিং চীনকে একটি কেন্দ্রীয় বৈশ্বিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছেন। তিনি আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাকে এমনভাবে বদলে দিতে চাচ্ছেন, যা চীনের স্বার্থ প্রতিষ্ঠায় কাজ করবে। এ অনুষ্ঠানে অন্য শক্তিধর নেতাদের উপস্থিতি তাঁর লক্ষ্য অর্জনের দিকে এগোচ্ছে বলে প্রমাণ দেয়।
আমেরিকান ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক জোসেফ টরিজিয়ান বলেন, শি ও পুতিন দুজনই বিশ্বাস করেন, যুদ্ধের জয় অনেক মূল্য দিয়ে এসেছে, কিন্তু তা সম্পূর্ণ হয়নি। তাঁরা মনে করেন, ‘প্রভুত্ববাদী শক্তি’ এখনো বিদেশি মডেল চাপিয়ে দিতে চায় এবং বিশ্বে তাদের প্রাপ্য অবস্থান আটকাতে চায়। তাঁরা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে পশ্চিমা মূল্যবোধ থেকে দূরে রাখতে এবং নিজেদের কল্পিত বিশ্বব্যবস্থাকে বৈধতা দিতে যুদ্ধের স্মৃতি ব্যবহার করতে চান।
সিঙ্গাপুর ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ইয়ান চং বলেন, এ কুচকাওয়াজের মূল বার্তা হলোÑ চীন বিশ্বশক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ কারো চাপ বা হুমকি তাদের বিচলিত করতে পারবে না।
পর্যবেক্ষকদের মতে, বেইজিংয়ের এ সামরিক প্রদর্শনী শুধু শক্তির প্রদর্শন নয়; বরং বিশ্বরাজনীতিতে চীনের অবস্থান পুনঃপ্রতিষ্ঠার কৌশলও বটে।